গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায়। এই সময়ে পুঁজিবাজারে সক্রিয় হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত।
গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায়। এই সময়ে পুঁজিবাজারে সক্রিয় হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত।

মতামত

শেয়ারবাজারে হাজার হাজার মানুষ কেন সব পুঁজি হারিয়েছেন?

বাংলাদেশের পুঁজিবাজার সম্প্রতি অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে। পুঁজিবাজারের অবস্থা অবশ্য বেশ কয়েক বছর ধরেই রুগ্‌ণ, কিন্তু হাল আমলে এই রুগ্‌ণতা অসাড়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে। পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থা ও এর পরিপ্রেক্ষিতে নীতিনির্ধারকদের প্রয়োগকৃত কিছু সিদ্ধান্ত আমার কিশোর বয়সে শোনা বাংলা সিনেমার একটি অতি পরিচিত সংলাপের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেখানে সিনেমার নায়িকা খলনায়কের অশালীন ও অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পরিপ্রেক্ষিতে নিতান্ত অসহায় হয়ে বলে, ‘আমার হাত বাঁধবি, পা বাঁধবি কিন্তু মন বাঁধবি কী করে?’

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের বর্তমান অবস্থার আলোকে কে নায়িকা বা কে খলনায়ক, সেই বিশ্লেষণ এ লেখার উদ্দেশ্য না হলেও নীতিনির্ধারকদের প্রণয়ন করা কিছু নীতি যে পুঁজিবাজারের হাত-পা বেঁধে রাখার কাজ করছে, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বেশ কিছু বছর ধরে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সূচক ও লেনদেন অব্যাহতভাবে অবদমিত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে ক্ষণিকের জন্য ঊর্ধ্বগতি পরিলক্ষিত হলেও নিমেষেই সেই গতির দিক পরিবর্তিত হয়ে বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্তকরণের প্রয়াস চালাচ্ছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবরে এ কথা স্পষ্ট যে গত পাঁচ বছরে পুঁজিবাজারের প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায়। এই সময়ে পুঁজিবাজারে সক্রিয় হাজার হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের পুঁজি হারিয়ে হয়েছেন সর্বস্বান্ত।

পুঁজিবাজারের এই দুরবস্থা-সংক্রান্ত তথ্যাদি হরহামেশাই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে, আর সে কারণে এ লেখায় তার পুনরাবৃত্তি করছি না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পুঁজিবাজারের এই দুরবস্থা দূরীকরণে নীতিনির্ধারকেরা কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, আর তার ফলাফলই-বা কী হচ্ছে? সর্বোপরি বাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, তার বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের রুগ্‌ণদশা উত্তরণকল্পে দুটি পদক্ষেপ বেশ দৃশ্যমান। এদের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে শেয়ার মূল্যের পরিবর্তনের উচ্চসীমা ও নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া। শেয়ারবাজারে মূল্য পরিবর্তনের সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রচলন পৃথিবীর অনেক দেশেই রয়েছে এবং এটি প্রচলিত কয়েক ধরনের সার্কিট ব্রেকারের মধ্যে একটি। শেয়ারবাজারে যদি হঠাৎ ব্যাপক মূল্য পরিবর্তনের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, তবে স্বল্প সময়ের জন্য সার্কিট ব্রেকার ব্যবহার করে শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। সার্কিট ব্রেকার সাধারণত ব্যবহার করা হয় বিশেষ সময়ের বিশেষ অবস্থা মোকাবিলার জন্য।

যেমন ১৯৮৭ সালের অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শেয়ার এর ব্যাপক দরপতনের (যা ব্ল্যাক মানডে হিসেবে পরিচিত) পরিপ্রেক্ষিতে সার্কিট ব্রেকার প্রথম ব্যবহৃত হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সংকটময় সময়ে এটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোভিড মহামারির সময়ে এর ব্যবহার ব্যাপকতা লাভ করেছে। এ প্রসঙ্গে দুটি বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, সার্কিট ব্রেকার ব্যবহৃত হয় অত্যন্ত সংবদনশীল ও সংকটময় সময়ে; এবং দ্বিতীয়ত, এটির ব্যবহার হয় স্বল্প সময়ের জন্য।

কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে দীর্ঘ সময় ধরে মূল্য পরিবর্তনের সীমা ব্যবহারের কারণে বাজারে সংকট ঘনীভূত হচ্ছে এবং বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শেয়ার মূল্যের সীমা নির্ধারণের ফলাফল-সংক্রান্ত গবেষণায় দেখা গেছে যে এই ব্যবস্থার কারণে পুঁজিবাজারের অস্থিরতা কমার চেয়ে বরং তা আরও বেড়ে যায়। এ প্রসঙ্গে বেশ কিছু তত্ত্বের ব্যবহার থাকলেও ‘ম্যাগনেট থিওরি’ বেশ প্রাসঙ্গিক।

বাজারে শেয়ার ম্যানিপুলেশন নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। শেয়ার ম্যানিপুলেশন শনাক্তকরণ কোনো কঠিন কাজ নয় এবং শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে যেন শেয়ার বা অন্যান্য আর্থিক সম্পদগুলোর বাজারদর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে।

এই থিওরি অনুযায়ী, শেয়ারের দাম যখন কমতে থাকে সে অবস্থায় দাম পরিবর্তনের নিম্নসীমা বেঁধে দেওয়া হলে নিম্নসীমায় পৌঁছালে শেয়ার তার তারল্য হারাবে, এই ভীতি বিনিয়োগকারীদের পেয়ে বসে। ফলে তাঁরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দ্রুত শেয়ার বিক্রি করে দিতে চান আর ফলে শেয়ারের দাম কমে নিম্নসীমায় অতি দ্রুত পৌঁছে যায়। বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করলে ম্যাগনেট থিওরির কার্যকারিতা প্রকটভাবে প্রতীয়মান হয়। সুতরাং নীতিনির্ধারকদের উচিত, যত দ্রুত সম্ভব মূল্য পরিবর্তনের সীমা বেঁধে দেওয়ার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা।

যতটুকু বোধগম্য হয়, তা থেকে বলা যায় যে নীতিনির্ধারকেরা পুঁজিবাজারের সূচকের সঙ্গে গভীর প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। এই প্রেমের কারণ বহুবিধ হতে পারে, তবে আপাতদৃষ্টে তাদের সুনাম রক্ষাই বড় কারণ বলে মনে হয়। তবে মনে রাখা ভালো, সূচককে বেঁধে রেখে বাজারের মন পাওয়া যায় না, বরং বাজারের সঙ্গে দূরত্ব ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকবে, যে কারণে বিনিয়োগকারীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। বিনিয়োগকারীদের অব্যাহত ক্ষতির বিনিময়ে অর্জিত সুনাম কত দিন স্থায়ী হবে, তার অনুধাবন অবশ্যই দুরূহ কাজ।

বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের সমস্যা উত্তরণের জন্য অধিক প্রচলিত দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটি হলো বাজারের তারল্য বৃদ্ধি করা। এই প্রসঙ্গে নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই বাজারে আরও বেশি টাকা বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো সংস্থাকেও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে অনুরোধ করা হয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে আমরা পুঁজিবাজারের তারল্যের প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতে পারছি না।

পুঁজিবাজারের তারল্য হচ্ছে বাজারের মাধ্যমে নির্ধারিত মূল্যে অত্যন্ত স্বল্প সময়ে শেয়ার কেনাবেচা নিশ্চিত করা। যদিও নগদ অর্থের প্রবাহ লেনদেনকে প্রভাবিত করে, মূল্যের সীমা নির্ধারণের কারণে শেয়ারের মূল্য যখন স্বাভাবিক নিয়মে নির্ধারিত হতে পারে না বা শেয়ার যখন তার তারল্য হারায়, তখন অধিক নগদ প্রবাহ বাজারের সামগ্রিক তারল্য ফিরিয়ে আনতে পারে না, বরং তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।

বাজারে নগদ প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে বিনিয়োগযোগ্য অর্থের জোগান বৃদ্ধি পাবে এবং তার ফলে তারা অধিক বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। ক্ষেত্রবিশেষে আগের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে পারেন। কিন্তু পুঁজিবাজারের বর্তমান মূল্যসীমার কারণে শেয়ারের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ দুরূহ হয়ে যায়, আর তার ফলে সঠিক বিনিয়োগ সম্ভব হয় না।

উপরন্তু, পুঁজিবাজারের মার্জিন অ্যাকাউন্টগুলোর রহস্যজনক শিথিলতা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। বিশ্ববাজারে যেখানে মার্জিন অ্যাকাউন্টগুলো কঠোর নীতিমালা অনুসরণের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অধিক ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, সেখানে বাংলাদেশে এর শিথিল ব্যবহার নিতান্তই অবোধগম্য। সুতরাং বাজারে যদি অতিরিক্ত নগদ প্রবাহ বাড়ানো হয়, তবে তার আগে শেয়ারের মূল্যসীমা শিথিল করা বিশেষ প্রয়োজন এবং তার সঙ্গে মার্জিন অ্যাকাউন্টের বিধিবদ্ধ ব্যবহার অত্যন্ত জরুরি।

এ কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অনেক দিন থেকেই আস্থার সংকটে ভুগছে। এই সংকটের মূল কারণ নীতিনির্ধারকদের এবং বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অব্যাহত দূরত্ব। নীতিনির্ধারকেরা বিভিন্ন সময়ে বাজারে অমূলক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। পুঁজিবাজারের সামগ্রিক কার্যকলাপকে যেহেতু ‘জিরো সাম গেম’ হিসেবে দেখা হয়, তাই একটি গোষ্ঠী লাভবান হলে তা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতির সৃষ্টি করে। তাই নীতিনির্ধারকদের উচিত, তাঁদের দৃষ্টি বিশেষ গোষ্ঠীকেন্দ্রিক না হয়ে যেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের দিকে কেন্দ্রীভূত হয়।

রাজনৈতিক আনুগত্যকে নিজের আখের গোছানোর কাজে ব্যবহার না করে তাঁদের উচিত পুঁজিবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারিমহলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এমন নীতি নির্ধারণ করা, যা বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষা করবে। বাংলাদেশে সঞ্চয়ী হিসাবগুলো যেখানে ১০%-এর বেশি রিটার্ন আয় করা সম্ভব, সেখানে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে রিটার্ন যেন আরও বেশি হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে আর তার জন্য রাজস্বনীতির সমন্বয় সাধন একান্ত প্রয়োজন।

বাজারে শেয়ার ম্যানিপুলেশন নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। শেয়ার ম্যানিপুলেশন শনাক্তকরণ কোনো কঠিন কাজ নয় এবং শনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে হবে। সর্বোপরি বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে যেন শেয়ার বা অন্যান্য আর্থিক সম্পদগুলোর বাজারদর অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকাণ্ডকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করে।

  • মসফিক উদ্দিন, অধ্যাপক লিডস বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য