যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২০ এপ্রিল ইতালির দ্বীপ ক্যাপ্রিতে জি-৭-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককালে চীনের দিকে একগুচ্ছ সতর্কবার্তা ছুড়ে দিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এই শীর্ষ কূটনীতিক অভিযোগ তোলেন যে রাশিয়ায় অস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রযুক্তির ‘প্রধান দাতা’দেশ চীন। ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘শীতল যুদ্ধ শেষে ইউরোপের নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকিতে’ জ্বালানি জোগাচ্ছে বেইজিং।
এ সপ্তাহে ব্লিঙ্কেন যখন বেইজিং সফরে এলেন, তখন তিনি চীনের কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। ইউক্রেন যুদ্ধের সময়টাতে যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে চীন রাশিয়ার কাছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রি না করলেও এমন সব উপকরণ বিক্রি করছে, যেগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করা হয়। এর একটা তালিকা ব্লিঙ্কেন চীনের হাতে তুলে দিয়েছেন। এর মধ্যে সেমিকন্ডাক্টর, হেলমেট, ড্রোন, ভেস্ট, যন্ত্রাংশ ও রেডিও রয়েছে।
আপাতভাবে, রাশিয়ার শিল্প খাতে চীন যে কাঁচামাল সরবরাহ করে যাচ্ছে, সেটাও ইউক্রেনের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, চীন ও চীনের বিভিন্ন কোম্পানির সমর্থন পেয়ে রাশিয়া যেভাবে তার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছে, তাতে এসব কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞায় পড়তে পারে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চীনের অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিলে সেটা আরও দুর্বল হয়ে পড়বে, সেটা জেনেও বেইজিং কেন এত প্রবলভাবে মস্কোকে সহযোগিতা করে যাচ্ছে? এককথায় উত্তর হলো, অস্তিত্ব।
চীন এটা বুঝতে পারে যে বৈশ্বিক ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্রের মনোপলি ভেঙে দিতে হলে তারা সেটা একা পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে পরিচালিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় সংস্কার আনতে গেলে একটা শক্তিশালী রাশিয়াকে দরকার চীনের। সে কারণেই চীন চায়, রাশিয়া যেন দীর্ঘস্থায়ীভাবে টিকে থাকতে পারে।
চীনের বিখ্যাত একটা প্রবাদ হলো, ‘যখন কারও ঠোঁট খোয়া যায়, ঠান্ডা গিয়ে দাঁতে কামড় দেয়’। এর অর্থ হচ্ছে, যখন দুটি জিনিস পরস্পর নির্ভরশীল, তখন একটি ক্ষতি হলে তার প্রভাব অন্যটির ওপর গিয়ে পড়ে। বর্তমানে পশ্চিমারা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে বোঝাপড়া করছে। বেইজিং এটা বোঝে যে রাশিয়ার যদি পতন হয়, তাহলে পশ্চিমারা তাদের সম্পদকে একত্র করে ‘চীনা হুমকি’ মোকাবিলার কাজে ব্যবহার করতে শুরু করবে। সে কারণেই বেইজিং মস্কোকে সহায়তা করে।
বর্তমানে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব বিরাজ করছে। দুই সরকারের মধ্যে সম্পর্ক কতটা ঘনিষ্ঠ, সেটার আঁচ করা যায় ২০২২ সালে ৪ ফেব্রুয়ারি যৌথ বিবৃতি থেকে। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, চীন-রাশিয়া সম্পর্কের কোনো ‘সীমারেখা’ নেই, দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রেও কোনো ‘নিষিদ্ধ এলাকা’ নেই।
১৯৬১ সালে চীন-উত্তর কোরিয়া যে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, ২০২১ সালে তার নবায়ন করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওপরের আশঙ্কাগুলোর কথা শুনতে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপরের পাতলা আবরণের নিচে গভীর অসন্তোষ রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই অসন্তোষ চলে আসছে।
কিন্তু একটা বাস্তবতা সরাসরি বলা প্রয়োজন। চীন-রাশিয়া সম্পর্ক সব সময় পুষ্পময় নয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন দুই দেশের সঙ্গে কমিউনিস্ট মতাদর্শ নিয়ে প্রবল উত্তেজনা চলেছিল। সীমান্ত নিয়েও তাদের মধ্যে বড় বিরোধ ছিল।
এই উত্তেজনা চরমে পৌঁছালে ১৯৬১ সালে দুই দেশের কমিউনিস্ট সরকার তাদের আনুষ্ঠানিক মৈত্রী ভেঙে দিয়েছিল। এরপর চীন ও রাশিয়ার সেনারা উত্তর-পূর্ব চীন ও জিনজিয়ান প্রদেশে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিলেন।
সে কারণেই চীন ও রাশিয়া দুই পক্ষের মধ্যে অবিশ্বাস থাকা এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে রাশিয়া তাদের নিজেদের স্বার্থ দেখছে, চীনের বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এমন মনোভাব থাকা মোটেই আশ্চর্যজনক বিষয় নয়।
এখন যদি দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়ে আসেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়া কমিয়ে দিতে পারে, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে ক্রেমলিনের কাছে অগ্রাধিকারে বিষয় হতে পারে, পশ্চিমের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের যে লড়াই চলছে, তা থেকে সমর্থন তুলে নিতে পারে রাশিয়া।
ঘটনাক্রমে রাশিয়ার প্রতি চীনের অবিশ্বাস ও অস্তিত্বগত উদ্বেগের প্রশ্নটি আরও স্পষ্ট হয়েছে উত্তর কোরিয়ায় চীনের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সফরের মধ্য দিয়ে। ১৩ এপ্রিল চীন শীর্ষ আইনপ্রণেতা ও কমিউনিস্ট পার্টির তৃতীয় শীর্ষ নেতা জাও লেজি পিয়ংইয়ং সফর করেন।
উত্তর কোরিয়ার লৌহমানব কিম জং-উনের সঙ্গে জাও লেজির বৈঠক সম্পর্কে বলা হয়, এর অর্থ হলো, দুই দেশের মধ্যকার ভালো সম্পর্ক ও দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও গভীর হলো। জাওয়ের এই সফর কেবল কি সৌজন্য সাক্ষাৎ?
এই সফর যে সময়ে হলো, সেটা খুব কৌতূহলোদ্দীপক। উত্তর কোরিয়া-রাশিয়া সম্পর্ক যখন উথলিয়ে উঠছে, সে সময়েই এই সফর। খবরে প্রকাশ, উত্তর কোরিয়া থেকে রাশিয়া বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ কিনছে। তা দিয়ে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যবহার করছে। এ ঘটনা মস্কো ও পিয়ংইয়ংকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে।
বাস্তবতা হলো, উত্তর কোরিয়া রাশিয়া ও চীনের যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেটাকে ব্যবহার করে ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করে আসছে। একটা বাস্তবতা হচ্ছে, রাশিয়া হোক আর আমেরিকা, উত্তর কোরিয়ার ওপর যারাই প্রভাব তৈরির চেষ্টা করুক না, সেটা বেইজিং চাইবে না। কারণ, সেটা চীনের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত প্রশ্ন।
এই ভয় অস্বীকার করতে পারে না চীন। কেননা, উত্তর কোরিয়া ঐতিহ্যগতভাবেই চীনকে পরোয়া না করা দেশ উত্তর কোরিয়া। চীনকে পরোয়া না করার একটা বড় উদাহরণ হলো, কিম জং-উনের চীনাপন্থী চাচা কিম জং-ন্যামের হত্যাকাণ্ড।
মালয়েশিয়ায় গিয়ে উত্তর কোরিয়ার গুপ্তঘাতকেরা তাঁকে হত্যা করেছিল। উত্তর কোরিয়া যে একের পর উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে, সেটাও চীনের জন্য হুমকি।
আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উত্তর কোরিয়া যদি একেবারে পূর্ণ সক্ষম পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়, তাহলে তারা চীনের মাটিতেও তার বিস্ফারণ ঘটাতে পারে।
১৯৬১ সালে চীন-উত্তর কোরিয়া যে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছিল, ২০২১ সালে তার নবায়ন করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ওপরের আশঙ্কাগুলোর কথা শুনতে অদ্ভুত বলে মনে হতে পারে। কিন্তু দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপরের পাতলা আবরণের নিচে গভীর অসন্তোষ রয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী সেই অসন্তোষ চলে আসছে।
একসময় সাম্রাজ্যবাদী চীনের সম্পদের জোগানদাতা দেশ হিসেবে কোরিয়া ব্যবহৃত হতো। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা চীনের অধীন দেশ। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে সময়-সময় সেই ক্ষত উসকে ওঠে।
চি মেং টান, নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় অর্থনীতির অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত