দেশে এখন কোনো সরকার নেই। দেশটা কীভাবে চলছে আসলে? ছাত্রজনতার আন্দোলনকে দমন করতে পুলিশ যে ভয়াবহ ভূমিকা পালন করল, তাদের ওপর জনগণ ক্ষুব্ধ। পুলিশও ভয়াবহভাবে আক্রান্ত হয়েছে। থানায় পুলিশ নেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষারও কোনো বালাই নেই। ফলে গোটা দেশে অরাজকতা ছড়িয়ে পড়েছে।
সকালে অফিসে এসে এসব বিষয় নিয়েই সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ হচ্ছিল। আক্ষেপ, অনিশ্চয়তা, দোষারোপ; আবার স্বস্তি ও সম্ভাবনা—সবকিছুই মিলেমিশে একাকার যেন। এমন সময় অফিস থেকে বলা হলো, যান তো ঢাকার রাস্তা ঘুরে আসেন, দেখে আসেন কীভাবে চলছে শহরটা।
দুপুরে অফিস থেকে নামতেই কারওয়ানবাজার। রাজধানীর অন্যতম এ মোড়েই গিয়ে দেখলাম কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। কিছু ছেলেমেয়ে দেখলাম ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। এমন দৃশ্য আমরা কয়েক দিনের জন্য দেখেছিলাম ২০১৮ সালের সড়ক আন্দোলনের সময়। তবে আগের দিন তারা একাই এ কাজ করলেও, গতকাল তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন আনসার সদস্যরাও। গাড়ির চাপ কিছুটা কম। তবে এরপরেও ঢাকার একটি প্রধান সড়কের মোড়ে যেভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে অভিভূত হতেই হয়।
সেখানে সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেহেদি হাসান নামে এক তরুণ শিক্ষার্থী গোটা বিষয়টি তদারকি করছিলেন। আলাউদ্দিন নামে বঙ্গবাজারের একজন দোকান ব্যবসায়ীকেও পেলাম। তিনি বললেন, ‘কয়েক দিন ধরে মার্কেট বন্ধ। চিন্তা করলাম, মানুষের জন্য কিছু করি। তাই গতকাল থেকে রাস্তায় সময় দিচ্ছি।’ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের শিক্ষার্থী মারজান জাহান বললেন, ‘এটি আমার দেশ। আমাদেরই তো এগিয়ে আসতে হবে।’
ট্রাফিক আইল্যান্ডে দেখলাম, কিছু স্বেচ্ছাসেবী দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁরা জানালেন, মানুষই এসে তাদের নাশতা, খাবার, পানি দিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার আরেক পাশে আসতেই একটি মোটরসাইকেলে করে পানি ও নাশতা নিয়ে দাঁড়ালেন দুই ব্যক্তি। তাঁদের সঙ্গে কথা বললাম। জানালেন, তাঁরা দুই দিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় স্বেচ্ছাসেবীদের খাদ্য বিতরণ করছেন।
পাশেই দাঁড়ানো এক ব্যক্তি নিজ থেকে বলে উঠলেন, ‘ছাত্রদের আন্দোলন তো দেখি এখনো শেষ হয়নি।’ একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা তিনি। জানালেন, অফিসের কাজে কাকরাইল ও মগবাজার গিয়েছেন তিনি।
বললেন, ‘আজকে (গতকাল) বিএনপির কর্মসূচির কারণে কাকরাইলের ওদিকে খুব বিশৃঙ্খলা। এরপরেও সেখানে ছাত্ররা যেভাবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে খুবই প্রশংসনীয়। ওরা ট্রাফিক পুলিশের মতো প্রশিক্ষিত না। এরপরেও তারা পুলিশের চেয়ে ভালো করছে। কারণ পুলিশ ভিআইপিদের আগে যেতে দিত, শিক্ষার্থীরা তা করছে না। তারা বরং অ্যাম্বুলেন্সকে আগে গুরুত্ব দিচ্ছে।’
মেট্রোরেল স্টেশনের নিচে গেলাম। সেখানে লাইন ধরে সব রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেল চালকেরা। যেটি আগে কখনো দেখা যেত না। মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন করে দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। যাত্রীবাহী বাসগুলোকে যেখানে সেখানে থামতে দিচ্ছে না। কেউ ট্রাফিক আইন না মানলে তাঁকে ‘স্যরি’ বলতে বাধ্য করছে। সবকিছু দেখতেই কেমন জানি ভালো লাগছিল।
সেখান থেকে একটি রাইড শেয়ারিং বাইক নিয়ে বের হলাম ঢাকার রাস্তায় ঘুরতে। রাজধানীর ‘প্যারাদায়ক’ সিগন্যাল বিজয় সরণি মোড় আগের তুলনায় অল্প সময়েই পার হয়ে গেলাম। সেখানেও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ শিক্ষার্থীদের, সঙ্গে আনসার সদস্য।
এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে চাইলাম। সেখানেও শিক্ষার্থী বাধা হয়ে দাঁড়াল। কারণ আগ থেকেই মোটরসাইকেল চলাচল নিষেধ সেখানে। যদিও আমার বাইকচালক বললেন, গতকাল সেখানে রিকশাও চলেছে। রীতিমতো মেলা বসে গিয়েছিল। ঝালমুড়িওয়ালাসহ নানা হকার পসরা বসিয়ে ফেলেছিল। আজকে সব আগের নিয়মে ফেরত গিয়েছে। তবে জানলাম, টোল নেওয়া এখন বন্ধ। কারণ টোল নেওয়ার মানুষ এখন নেই।
পরে তেজগাঁও হয়ে মহাখালী পর্যন্ত গেলাম। সবখানেই শিক্ষার্থীরা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়—সবাই দেখি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঢাকার রাস্তা সামলাচ্ছে। একইভাবে কাকলির মোড়, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট মোড় হয়ে একেবারে উত্তরা সেক্টর ৪ পর্যন্ত। ফ্লাইওভারগুলোর মুখেও দণ্ডায়মান শিক্ষার্থীরা। সেখানে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন স্থানীয় জামেয়াতুল মানহাল কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও।
তাদের সঙ্গে কথা বললাম। জিজ্ঞাসা করলাম, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে তো একটা দূরত্ব আছে। তাদের সঙ্গে কাজ করতে কেমন লাগছে? তারা বলল, ‘সবাই মিলেমিশে একসঙ্গে দেশের জন্য কাজ করছি, এটি খুব ভালো লাগছে। আমাদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই।’ একই কথা পরে মাইলস্টোন কলেজের এক ছাত্রীকেও জিজ্ঞাসা করলাম, সেও দেখলাম অনেকটা একই কথা বলল। একটা আন্দোলন আসলে কত দিকে প্রভাব ফেলেছে, তা কি আসলে ভাবা যায়!
রাস্তার পাশেই উত্তরা পূর্ব থানা। ভবনের সামনে দাঁড়াতেই বোঝা যায়, কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনা ঘটেছে এখানে। ভবনটি পুড়ে কঙ্কাল হয়ে গেছে। ভবনের বিভিন্ন তলার জানালার কাচ ও জিনিসপত্র ভাঙা। ভবনের সামনে পড়ে আছে আগুনে পোড়া পুলিশের সাঁজোয়া যান ও অনেকগুলো গাড়ি।
থানাটিতে ঢুকতেই দেখলাম ভবনটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করছে শিক্ষার্থীরা, সবার মুখে মাস্ক। সেখানে আনসার ব্যাটালিয়নের কয়েকজন সদস্যও আছেন। তাঁদের একজন হাবিলদার মানিক মিয়া বললেন, ‘সবকিছু এতটাই ভস্মীভূত হয়েছে যে গতকাল তো ঢোকাই যায়নি, নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। গতকাল (আগের দিন) সকাল থেকে শিক্ষার্থীরা থানা ভবন পরিষ্কার করা শুরু করেছে।’
এরপর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা হলো। তাঁরা ঘুরে ঘুরে থানা ভবনটি দেখাল। তাদের মুখেই শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী দেশ ছাড়ার পরেও এখানে স্থানীয় জনতা, পুলিশ সদস্য ও ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের গুলি চালিয়েছে, জনতাও হামলা চালিয়েছে। পুলিশসহ ২৩ জন নিহত হয়েছেন সেখানে।
সেখানে স্বেচ্ছাসেবী কাজ করা দুই তরুণ বেলায়েত হোসেন ও আল আমিন জানালেন, আশপাশের অন্তত ১৫টি স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল থেকে এখানে কাজ করছেন। আজকে দুই তলা পর্যন্ত তারা পরিষ্কার করেছেন। আগামীকাল তৃতীয় তলায় তারা হাত দেবেন।
সেখানে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীর সঙ্গেও কথা হলো। একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো, তাদের বেশির ভাগই একজন আরেকজনকে এর আগে চিনত না। সেখানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করেছে, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, মাইলস্টোন কলেজ, রাউজক উত্তরা মডেল কলেজ, নবাব হাবিবুল্লাহ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, উত্তরা টাউন কলেজ, আইইউবিএটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, উত্তরা স্কুল অ্যান্ড কলেজ, টঙ্গী সরকারি কলেজ, গাজীপুর ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, দারুল আজহার মাদ্রাসা, মাহনাতুল উম্মাহ ফাউন্ডেশন, উত্তরা ক্যাডেট কলেজ ও ইউনাইটেড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।
কিশোর-কিশোরী থেকে তরুণ-তরুণী—সবার মধ্যে কী উদ্যোমতা, কী স্পৃহা। এসব দেখে মনে হচ্ছিল, এসব বাচ্চাকাচ্চা-তরুণেরা আসলে একটি থানা ভবন নয়, যেন দেশের জঞ্জাল পরিষ্কার করতে নেমেছে। তরুণ ও আনসারের সদস্যরা আলাপ করছিলেন, পোড়া গাড়ির ভাঙারি লুটে নিতে টোকাইদের রাতে কীভাবে ঠেকাতে হবে। গতরাতে প্রায় এক শ জন ঠেকিয়ে দিয়েছে তারা।
তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বুক ভরা আশা নিয়ে রাস্তায় নেমে পাশের গলিতে দাঁড়ালাম। দেখলাম গলির ভেতরে সব রিকশা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে। পাশের চায়ের দোকানদার জানালেন, ‘অন্য সময় মূল রাস্তার প্রায় মাঝখানে এসে জটলা পাকিয়ে থাকত। এখন ছাত্রদের ঠেলায় পড়ে সব লাইন হয়ে গেছে।’
বিকেল হয়ে এল। এবার অফিসের ফেরার পালা। ফেরার সময়েও একই দৃশ্য দেখতে দেখতে মনটা ভরে ওঠল। এবার একজন বাসচালকের সঙ্গে কথা হলো। লাব্বাইক বাসের চালক রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ছাত্ররা যা করতেছে, আমরা খুব খুশি। কোনো জ্যাম নাই, পুলিশকেও টাকা দিতে হইতেছে না। তবে পরিবহন সমিতির চাঁদা এটা সহজে বন্ধ হইব না।’ আমাদের সামনে কত চ্যালেঞ্জ তাঁর শেষের কথাতেই অনেকটা স্পষ্ট হয়।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সামনে দাঁড়ালাম। আশপাশে সেনাবাহিনী সতর্ক অবস্থান। আগের দিন এখানে অনেক মানুষ ঢুকে সবকিছু তছনছ করে ফেলেছে। সেখানে আর্মির সঙ্গে পরিস্কার–পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিল শিক্ষার্থীদের একটি দল।
সেনাসদস্যরা তা দেখছিলেন। তাঁদের ‘কঠিন’ মনও নিশ্চয়ই আবেগে আপ্লুত হচ্ছিল। মূল ফটকের সামনে দেখলাম একজন তরুণী ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। ঝাড়ু দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে কথা হলে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফরিন মমতাজের সঙ্গে। ফিক করে হেসে দিয়ে বললেন, ‘আমার দেশ, আমারই তো দায়িত্ব।’
এখানেও সেই অদ্ভুত ব্যাপার, এখানেও কাজ করা শিক্ষার্থীরা আগ থেকে অনেকে অনেককে চিনতেন না। জেন জি প্রজন্মরা বোধ হয় এমনই। কেউ কাউকে চিনে না, এরপরেও সবার মধ্যে কী চমৎকার সংযোগ! তা না হলে কি, এমন আন্দোলন গড়ে তোলা, এমন পরিবর্তন আনা কি সম্ভব হতো!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: rafsangalib1990@gmail.com