হাল আমলের কোনো রাজনৈতিক প্রবণতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দটি ব্যবহার করতে গেলে সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ এটি এমন একটি ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মতো যা কিনা যে প্রেক্ষাপটকে বর্ণনা করতে চায়, সেটিকেই চিড়েচ্যাপ্টা করে ফেলে। ফ্যাসিবাদ শব্দটি ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট অর্থে এতটাই ভারাক্রান্ত যে, স্থান কাল ভেদে এর ব্যবহার অনেক সময় অতিরঞ্জিত বা বাড়াবাড়ি বলে মনে হতে পারে।
তার পরও, আধুনিক দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিকে যখন ফ্যাসিবাদের সঙ্গে (বিশেষ করে ফ্যাসিবাদের নাৎসি বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে) তুলনা করা হয়, তখন তার মধ্য দিয়ে দুটি বিষয় সামনে আসে। এক, এই তুলনা আধুনিক ভারতের সংখ্যাগুরুবাদকে তার আদর্শিক পূর্বসুরীদের সঙ্গে বাঁধা গাঁটছড়ার কথা মনে করিয়ে দেয় এবং দুই, তুলনাটি আমাদের সেই আদর্শিক উপাদানটিকে চিহ্নিত করতে সহায়তা করে যা ফ্যাসিবাদের মূল হিসেবে টিকে আছে।
ভারতের শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) একটি হিন্দু মিলিশিয়া সংগঠনের রাজনৈতিক শাখা। আরএসএস ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঠিক সেই সময়ে অ্যাডলফ হিটলার পরাজিত ও ক্ষুব্ধ জার্মানিতে তাঁর রাজনৈতিক ভিত পোক্ত করার চেষ্টা করছিলেন।
আরএসএস এমন এক জাতীয়তাবাদী জঙ্গি সংগঠন যা ভারতকে একটি হিন্দু দেশ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে। শুধুমাত্র হিন্দুরাই এই সংগঠনের সদস্য হতে পারেন। এই আরএসএস এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগের দশকের ফ্যাসিস্ট আধা সামরিক সংগঠনগুলোর মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়। যেমন ইউনিফর্ম পরা, বিশেষ ভঙ্গিমায় স্যালুট ঠোকা, পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে স্থায়ী উদ্বেগ ধরে রাখা, ইত্যাদি।
আর তাদের উভয়ের আদর্শিক চেতনার কেন্দ্রে রয়েছে জাতিগত জাতীয়তাবাদ যা কিনা একটি ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যাগুরু শ্রেণিকে আগে থেকেই কোণঠাসা হয়ে থাকা সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। গত দশকে ভারতে সংখ্যালঘু ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর ওপর, বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সহিংসতার সঙ্গে আমরা পরিচিত হয়ে উঠেছি।
গরু সম্পর্কিত গণপিটুনি, দাঙ্গা, মুসলমানদের বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, হিন্দু নারীর সঙ্গে মুসলমান পুরুষের প্রেমকে ‘লাভ জিহাদ’ আখ্যা দিয়ে অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করা, ইত্যাদি নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বকালের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে সংখ্যালঘুদের প্রতি বিজেপির এই অল্প সময়ের মধ্যে নেওয়া পীড়নমূলক পদক্ষেপের জার্মান অনুপ্রেরণা আমাদের ১৯৩০-এর দশকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
যখনই মূল ধারার রাজনীতিবিদেরা অনুপ্রবেশকারী, ফিফথ কলামিস্ট (‘ফিফথ কলামিস্ট’ বলতে এমন গোষ্ঠীকে বোঝায় যারা একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী বা জাতির ভেতর থেকে ক্ষতি করে এবং সাধারণত শত্রু গোষ্ঠী বা অন্য কোনো জাতির পক্ষে কাজ করে) এবং বহু খণ্ডকে ফের অখণ্ড করার কথা বলতে শুরু করেন, তখন সেখানেই ফ্যাসিবাদের গন্ধ ধরা দেয়।
১৯৩৯ সালের মার্চে আরএসএস-এর প্রধান তাত্ত্বিক এম এস গোলওয়ালকর উই, অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড শীর্ষক একটি বই লিখেছিলেন। ওই বইয়ে তিনি আরএসএস-এর হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে।
এখানে বইটির একটি অনুচ্ছেদ প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে: ‘জার্মান হিসেবে জাতীয় গর্ব আজকের আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। নিজ জাতি এবং সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে জার্মানি সেমেটিক জাতিদের তথা ইহুদিদের নির্মূল করে বিশ্বকে একটি ধাক্কা দিয়েছে। জাতি হিসেবে গৌরব বোধ করার সর্বোচ্চ পর্যায়টি এখানে প্রকাশিত হয়েছে। জার্মানি দেখিয়েছে, জাতি এবং সংস্কৃতির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা অবস্থায় সর্বাংশে এক জাতি হওয়া কতটা অসম্ভব। এটি হিন্দুস্থানে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় ও লাভবান হওয়ার একটি উত্তম পাঠ।’
বিজেপি এই পাঠকে গভীরভাবে গ্রহণ করেছে। দলটির স্থানীয় নেতা ও কর্মীরা মুসলমানদের আকারে ইঙ্গিতে এবং ক্ষেত্র বিশেষে সরাসরি বহিরাগত হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁরা মুঘল আমলে নির্মিত মসজিদগুলোর টিকে থাকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। বিজেপি মুসলমানদের কোণঠাসা এবং রাজনৈতিকভাবে অপ্রাসঙ্গিক করার জন্য সংগঠিতভাবে চেষ্টা চালিয়েছে। এর ফল হিসেবে আমরা দেখতে পাই, বিধান সভা ও লোকসভায় দলটির নির্বাচিত হাজারো আইনপ্রণেতার মধ্যে একজন মুসলমানও নেই।
মুসলমানদের গরু ব্যবসায় নিষেধাজ্ঞা, সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিজাবকে খারাপ পোশাক হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে ধর্মীয় পরিচয়কে পরীক্ষার মুখে ফেলাকে মুসলমানদের আতঙ্কিত করার এবং সমান অধিকার সম্পন্ন নাগরিকত্বের মর্যাদা থেকে তাঁদের সরিয়ে রাখার পদ্ধতিগত প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা যায়।
আধুনিক সংখ্যাগুরুবাদীরা নাৎসিবাদ থেকে যে পাঠ নিয়েছেন, তা হলো, একটি সংখ্যালঘু শ্রেণিকে সমন্বিতভাবে শয়তান প্রকৃতির প্রতিপন্ন করা সংখ্যাগুরুকে রাজনৈতিকভাবে দানবে রূপান্তরিত করার সবচেয়ে সহজ পথ। ইউরোপের সবচেয়ে একীভূত হয়ে বাস করা সংখ্যালঘুদের (ইহুদিদের) ২০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অচ্ছুত পর্যায়ের নিম্নবর্গে পরিণত করাটা হিটলারের সবচেয়ে বড় সফলতা ও সংখ্যাগুরুবাদের সবচেয়ে বড় উদাহরণ।
সেই নাৎসি চেতনার প্রতিধ্বনি হিসেবে গোলওয়ালকর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে লিখেছিলেন, ভারতের সব ‘অ-হিন্দু’ লোকদের সম্পূর্ণরূপে হিন্দু সংস্কৃতিতে একীভূত হতে হবে অথবা ‘… তাদের দেশের মধ্যে হিন্দু জাতির সম্পূর্ণ অধীনস্থ হয়ে থাকতে হবে, তারা কিছু দাবি করার যোগ্য হবে না, কোনো সুবিধা পাওয়ার যোগ্য হবে না এবং নাগরিকত্বের অধিকারও তারা পাবে না।’
নাৎসিবাদকে দুটি কারণে অনন্য মনে হয়। প্রথম কারণ হলো, পরাজিত জাতি থেকে জার্মানির গণহত্যামূলক রাইখে রূপান্তরের অস্বাভাবিক গতি এবং দ্বিতীয় কারণ হলো, শিল্পায়নের প্রক্রিয়া যা হলোকাস্ট সংঘটনকে ত্বরান্বিত করেছিল। তবে আমরা যদি এই রাজনৈতিক প্রকল্পের ক্ষিপ্র গতির দিকে মনঃসংযোগ করার বদলে প্রকল্পটির ধারাবাহিক লক্ষ্যের দিকে তথা মানবেতর সংখ্যালঘুদের অধীনস্থ করে সংখ্যাগুরুর আধিপত্য বিস্তারের দিকে নজর দিই, তাহলে তাদের উত্তরাধিকারীদের চিহ্নিত করা সহজ হয়।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে নাৎসিবাদ হলো সবচেয়ে দ্রুত গতিতে বিস্তার লাভ করা সংখ্যাগুরুবাদ। এর বিপরীতে, দক্ষিণ এশিয়ার আধুনিক সংখ্যাগুরুবাদ হলো ধীর গতির ফ্যাসিবাদ।
আধুনিক ভারতে গণতন্ত্রের একটি ভাইমার-সদৃশ (ভাইমার প্রজাতন্ত্র ১৯১৯ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত যে জার্মান রাজ্য বিদ্যমান ছিল সেটিকে ‘ভাইমার’ বলা হয়) পতন খোঁজা বোকামি; কারণ ভারত একটি উপমহাদেশীয় প্রজাতন্ত্র। এখানে একটি ত্রুটিপূর্ণ কিন্তু প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। এটিকে একটি শ্রেষ্ঠত্ববাদী হিন্দু জাতিতে পুনর্গঠন করা একটি দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার হবে।
ভারতের সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচন থেকে আমরা যে ইঙ্গিত পাই, তা হলো, দক্ষিণ এশিয়ায় ফ্যাসিবাদের পূর্ণাঙ্গ বিকাশ কখনো ঘটতে নাও পারে। তবে, এটি বলার অর্থ এই নয় যে, আধুনিক সংখ্যাগুরুবাদের প্রক্রিয়া সব সময় ধীর গতির। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠতা মুসলমান রোহিঙ্গাদের গণহত্যার চূড়ান্ত পরিণতি তৈরি করেছে। শ্রীলঙ্কা তার তামিল সংখ্যালঘুকে নিষ্ঠুর যুদ্ধের মাধ্যমে সিংহলি বৌদ্ধ আধিপত্যকে সংহত করেছে।
ধীর গতির হোক কিংবা দ্রুত গতির হোক, এএফডি (অলটারনেটিভ ফর জার্মানি) হোক কিংবা বিজেপি হোক, মোদ্দা কথা, সংখ্যাগুরুবাদী দলগুলোর মধ্যে নাৎসিবাদের প্রতি আকর্ষণ আছে। সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের এক ধরনের ঘৃণা আছে।
যখনই মূল ধারার রাজনীতিবিদেরা অনুপ্রবেশকারী, ফিফথ কলামিস্ট (‘ফিফথ কলামিস্ট’ বলতে এমন গোষ্ঠীকে বোঝায় যারা একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী বা জাতির ভেতর থেকে ক্ষতি করে এবং সাধারণত শত্রু গোষ্ঠী বা অন্য কোনো জাতির পক্ষে কাজ করে) এবং বহু খণ্ডকে ফের অখণ্ড করার কথা বলতে শুরু করেন, তখন সেখানেই ফ্যাসিবাদের গন্ধ ধরা দেয়।
মুকুল কেশবন একজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ, ঔপন্যাসিক এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রবন্ধ লেখক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ