মতামত

পরীক্ষায় খারাপ ফল: মোমো, মিষ্টিরা কেন চলে যাবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার আনুষ্ঠানিকতা অল্প কথায় শেষ করলেও পরীক্ষায় ‘অকৃতকার্য’ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কয়েকটি কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি অকৃতকার্য ছাত্রদের বলব, হতাশ হওয়ার কিছু নেই। তুমি অকৃতকার্য হয়েছ; কিন্তু যদি একটু মনোযোগী হও, তবে তুমি ভালো ফলাফল পেতে পারো।’ অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরা যাতে ভবিষ্যতে ভালো ফল করতে পারে, সেদিকে শিক্ষকদের আরও মনোযোগী হতে বলেছেন। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান কথা তিনি বলেছিলেন অভিভাবকদের উদ্দেশে। সেটাই ছিল প্যারেন্টিংয়ের সারকথা। বলেছেন, ‘আপনার শিশুদের অন্য ব্যক্তির শিশুদের সঙ্গে তুলনা করবেন না বরং তাদের মেধা অনুযায়ী দক্ষতা বিকাশ করতে দিন। তাদের তিরস্কার করবেন না বরং তাদের আরও স্নেহ-ভালোবাসা দিন, যাতে তারা তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে।’

প্রধানমন্ত্রীর কথা শুনে অভিভাবকেরা যদি তিরস্কারের জিবটায় একটু লাগাম দিতেন, তাহলে একের পর এক আত্মহত্যা আর আত্মহত্যাচেষ্টার খবর এসে বার্তাকক্ষের কড়া নাড়াত না। নাটোরের লালপুর পাইলট বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মিষ্টি মেয়ে মোমো। মাত্র ১৬ বছর বয়স। হালকা-পাতলা গড়নের কিশোরী প্রায়ই অসুস্থ থাকত। প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, অসুস্থতার জন্য নিয়মিত বিদ্যালয়ে আসত না। শিক্ষকদের মূল্যায়নে ‘মাঝারি মানের শিক্ষার্থী’ ছিল সে। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৩.৮০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিল। শিক্ষকদের মতে, ‘তার প্রাপ্ত ফলাফল সন্তোষজনক।’ মুসলিমা আক্তার মোমো নিজেও খুব একটা অখুশি ছিল, সেটা বলা যাবে না। মোমোর বাবা মো. মহসিন আলী জানান, তাঁর মেয়ে দীর্ঘদিন ধরে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত ছিল। এ অবস্থায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ–৩.৮০ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। তাতে তাঁরা অনেক খুশি ছিলেন। কিন্তু মেয়ের মা অর্থাৎ তাঁর স্ত্রী মেয়ের ফলাফলে মোটেও খুশি হননি। তিনি তাঁর ক্ষোভ-দুঃখ প্রকাশে কোনো কার্পণ্য করেননি। মোমো মায়ের ক্ষোভ আর বাড়াতে চায়নি, বেলা গড়ানোর আগেই সে আত্মহত্যা করে।

আমরা জানি, এসএসসি ২০২৩-এর ফলাফল আগের তিনটি এসএসসির থেকে ভালো হয়নি। এবার সার্বিকভাবে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৫.৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার। অন্যান্য কিছু সূচকেও নেতিবাচক ফলাফল ‘দৃশ্যমান’। যেমন সবাই ফেল, এমন স্কুলের সংখ্যা এবার বেড়েছে। এবার প্রায় ৫০টি স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।

পাস করার পরও আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের শিক্ষার্থী মিষ্টি রায়। সে ভেবেছিল জিপিএ–৫ পাবেই পাবে। বাবা প্রেমানন্দ রায়ের মেয়ে মিষ্টি রায় খোচাবাড়ী গার্লস স্কুল থেকে এবার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ–৪.২৮ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। অনেক সময় খাতা থেকে ভুল নম্বর উঠে যায় মার্কশিটে। খাতায় নম্বর লিখতেও ভুল করেন পরীক্ষক। শিক্ষার্থীর সন্দেহ হলে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা আছে। তারপরও অভিমানী কিশোর-কিশোরীরা আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে সব পাবলিক পরীক্ষার পর।

মোমো, মিষ্টির মতো পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আত্মহত্যা করেছে রতনপুর গ্রামের জীবু মিয়ার মেয়ে মাহিনুর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের চাতলপাড় ওয়াছ উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয়ে মানবিক শাখা থেকে সে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছিল। টেস্টে খুব ভালো ফলাফল ছিল গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার মেয়ে জুঁই সমাদ্দারের। শিক্ষকেরা বলছেন, জুঁই ফেল করার মতো ছাত্রী ছিল না। রেজাল্ট শিটে দেখা যায় সে শুধু গণিতে ফেল করেছে। এই কষ্ট সে নিতে পারেনি। বাড়ি ফিরে সে-ও আত্মহত্যা করে।

আমরা জানি, এসএসসি ২০২৩-এর ফলাফল আগের তিনটি এসএসসির থেকে ভালো হয়নি। এবার সার্বিকভাবে পাসের হার ও জিপিএ-৫ দুটোই কমেছে। গত বছরের চেয়ে পাসের হার কমেছে ৫.৭ শতাংশ আর জিপিএ-৫ কমেছে ৮৬ হাজার। অন্যান্য কিছু সূচকেও নেতিবাচক ফলাফল ‘দৃশ্যমান’। যেমন সবাই ফেল, এমন স্কুলের সংখ্যা এবার বেড়েছে। এবার প্রায় ৫০টি স্কুলের কোনো শিক্ষার্থী পাস করতে পারেনি।

ফলাফলের এ অবনমনের কারণ হয়তো একসময় বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়ায় উপযুক্ত ব্যক্তিদের দিয়ে খতিয়ে দেখা হবে। যদিও তার সম্ভাবনা খুবই কম, তারপরও আশা করতে বাধা নেই। শিক্ষা বোর্ডগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ইতিমধ্যে তাঁদের ধ্যানধারণার বশবর্তী হয়ে নানা কারণের বয়ান তৈরি করেছেন। তাঁরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে গোটা পাঁচেক কারণের হদিস দিয়েছেন। করোনার ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েছেন যথারীতি। তা ছাড়া তাঁরা আর যেসব কারণের কথা বলেছেন, সেগুলো হচ্ছে— ১. এসএসসিতে সব বিষয়ে পূর্ণ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া। ২. গণিত ও ইংরেজির প্রশ্ন কঠিন হওয়া। ৩. মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীরা বেশি খারাপ করায় পাসের গড় সংখ্যা কমে যাওয়া। ৪. কয়েকটি শিক্ষা বোর্ডের খারাপ ফলাফল জাতীয় গড়ের ওপর প্রভাব ফেলেছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

সরকারের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও স্কুল নিয়ে, পাঠদান প্রক্রিয়া নিয়ে ভাবতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাদের যেতে হবে, দেখতে হবে উত্তরণের সঠিক পথে তারা হাঁটছে কি না। খোঁজ রাখতে হবে শিশু-কিশোরদের মনে কী হচ্ছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রান্তিক উপজেলা বাঞ্ছারামপুরের উজানচরের মানুষেরা যদি পারে, অন্যরা কেন পারবে না। সেখানকার বেসরকারি স্কুল ‘কে এন উচ্চবিদ্যালয়’ টানা সাত বছর ধরে এসএসসি পরীক্ষায় শতভাগ পাসের নজির তৈরি করেছে। বিদ্যালয়ের সব শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার খোঁজ নেন। পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করা হয়। কী তাদের প্রণোদনা? কেন তারা এগুলো করে? অন্যরা কেন পারে না?

  • গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক

    nayeem5508@gmail.com