আইনজীবী ও সাহিত্যিক অতুলচন্দ্র গুপ্ত চিলমারী বন্দর নিয়ে লিখেছিলেন : ‘বেলা একটায় চিলমারী এলুম। চিলমারীর কাঁসা-পিতলের বাসন, বিশেষ করে এখানকার অতি সুডৌল গাড়ু একসময় বিখ্যাত ছিল। এখন কিছু নেই। চিলমারীর বন্দরে এখন যে কারবার চলে, সে শুধু পাট ও অন্য কৃষিবস্তু চালান দেবার। দেশ হয়তো ইন্ডাস্ট্রিলিজড হচ্ছে, কিন্তু বাংলার গ্রামগুলিকে আমরা খুব দ্রুতগতিতে বিশুদ্ধ এগ্রিকালচারালাইজ করছি। সঙ্গে যে দুই ফ্ল্যাট এসেছিল, তার একখানিকে এখানে রেখে যাওয়া হল; ওতে পাট বোঝাই হয়ে চালান যাবে। চিলমারী থেকে গারো পাহাড়ের সার আকাশের সীমান্তে ঝাপসা দেখা যাচ্ছে।’ অতুলচন্দ্র গুপ্ত, ‘নদীপথে’, ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৩৬
২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৩। চিলমারী নদীবন্দর। আবার চালু হয়েছে চিলমারী-রৌমারী ফেরি চলাচল। এক কিলোমিটারব্যাপী ট্রাকের সারি। একটি ফেরিতে ১০টি ট্রাক পার হতে পারে। ট্রাকগুলো চট্টগ্রাম পর্যন্ত যাচ্ছে। এই পথে ঢাকার দূরত্ব ১১৫ কিলোমিটার কমায় কয়েক দিনেই ট্রাকের জন্য জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দৈনিক রাজস্ব আসছে গড়ে দুই লাখ টাকা।
১৯৮৬ সালে চিলমারী টু বাহাদুরাবাদ রুটে ‘গড়াই’ ও ‘মধুমতী’ নামে দুটি ফেরি চলত। ফেরির সঙ্গে ট্রেন যুক্ত ছিল। ফেরি পৌঁছার পর ট্রেন ছাড়ত। টিকিটের মূল্য সেভাবেই নির্ধারণ করা হতো। ব্রিটিশ আমল থেকে এই নিয়ম চালু ছিল। চারণ সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন যখন এসেছিলেন, তখন ফেরি বন্ধ ছিল।
রৌমারীতে রেলপথ নেই, সড়কপথ আছে। রৌমারী থেকে ঢাকার পথে যে নদ-নদীগুলো ছিল, সেগুলোয় এখন সেতু। যাত্রীদের চাহিদা, তেল-মবিল ও দূরত্ব বাঁচাতে মোটর মালিক সমিতিও এ রুট চালু করতে আগ্রহী। ফেরি সময়সূচিতে বাসের কথা বিবেচনাতেই নেওয়া হলো না। রাতে বাস চলার সুযোগ রাখা হলো না। অথচ দৈনিক শ খানেক দূরপাল্লার বাস চলাচল করে কুড়িগ্রাম থেকে।
২.
‘চিলমারী-রৌমারী’ নৌরুটে ফেরি সার্ভিস নতুন সময়সূচি—চিলমারীর থেকে ছাড়বে সকাল ৭টা, বেলা ১টা ও বিকেল ৪টায়। রৌমারী থেকে ছাড়বে সকাল ৭টা, বেলা ১টা ও বিকেল ৪টায়। তবে গাড়ির সংখ্যা কম হলে সময় পরিবর্তন অথবা ট্রিপ বাতিল হতে পারে।
কেউ যদি সকাল সাতটার ফেরি ফেল করে, তাহলে সেই বেলা একটার জন্য বসে থাকতে হবে। ট্রিপ বাতিল হলে তো আরেক বিপদ। তখন ডাবল ভাড়া দিয়ে নৌকায় যেতে হবে।
গাজীপুর চৌরাস্তা-ময়মনসিংহ (৪ লেন রাস্তা)। ময়মনসিংহ-শেরপুর (২ লেন নতুন রাস্তা, যানবাহনের চাপ কম)। শেরপুর-রৌমারী (২ লেন নতুন রাস্তা)। রৌমারী-চিলমারী ফেরি কুঞ্জলতা ও বেগম সুফিয়া কামাল। চিলমারী-কুড়িগ্রাম (২ লেন নতুন রাস্তা)। ফেরি চালুর আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক শাহ মোমেন (৫০) জানান, যাঁরা প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাস নিয়ে আসবেন, এই রুট তাঁদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা দেবে। কিন্তু এর জন্য চাই নিয়মিত তদারকি।
কিন্তু বলদমারা থেকে রৌমারী ঘাটে পানির সংকট। নয়টি ট্রাক নিয়ে ফেরি যায়। সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাত পানি হলেই অনায়াসে চলা সম্ভব। একটি ড্রেজার দিয়ে নাব্যতা বজায় রাখার কাজ চলছে।
ফেরিতে প্রায় দিনই দু-একটি ট্রিপ বন্ধ থাকবে। আর ফেরি না চললেই ইজারাদারের বাড়তি লাভ। চলবে নৌকা। তখন নৌকায় নেওয়া হবে মোটরসাইকেল ১০০, যাত্রী ১০০ আর ওঠার জন্য ১০০ আর নামানোর জন্য ১০০। অর্থাৎ একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে নৌকায় পার হলেই নেবে মোট ৪০০ টাকা। ইজারাদারের কথাই যে আইন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
নজরুল ইসলাম (৪৫)। মেরিন অফিসার। তিনি বলেন, ‘বাস চালাতে গেলে রমনা ঘাট থেকে সোজা রৌমারী ঘাট পর্যন্ত ড্রেজিং করতে হবে, তখন দেড় ঘণ্টায় পারাপার সম্ভব। তখনই বাসগুলো আসবে। তখন সন্ধ্যায়ও চালানো যাবে। এ ঘাট বেশ লাভজনক হবে বলে মনে হচ্ছে।’
কিন্তু কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে মাত্র ২৫ দিনের মাথায় ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। রোববার, ১৫ অক্টোবর ২০২৩ তারিখে দুপুরে ব্রহ্মপুত্র নদের রমনা ঘাট এলাকায় পণ্যবাহী ৪০টি ট্রাকের সারি দেখা যায়। ভূরুঙ্গামারী সানোহাট স্থলবন্দর থেকে পাথর নিয়ে আসা চালক জাহিদ হাসান (৪০), লালমনিরহাট জেলা থেকে আসা মমিনুল ইসলামসহ (৫০) অনেকে জানান, এর আগেও দুর্ভোগে পড়েছিলেন। এ রকম হলে পরবর্তী সময় আর এ পথ আসবেন না। যাওয়া-আসার জন্য বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছিল। দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কিন্তু কর্তৃপক্ষের কিছু অবহেলার কারণে আজকে এই দুর্ভোগের স্বীকার হতে হলো।
বিআইডব্লিউটিসি ম্যানেজার প্রফুল্ল চৌহান বলেন, রৌমারী ঘাটের মাটি ভেঙে যাওয়ায় আপাতত ফেরি চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঘাট মেরামতের কাজ চলছে। কাজ শেষ হলে ফেরি চলাচল স্বাভাবিক হবে।
৩.
স্থানীয় সমাজকর্মী লাল মিয়া ফেসবুকে লিখেছেন, ভাড়ার কথা বাদ দেন, ফেরির প্রতি নজর দেন। কখন আসে কখন যায়, কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
রমনা ঘাটেও সব অবিশ্বাস্য ঘটনা। আগে জেলা পরিষদের অধীন ঘাট যখন ছিল, তখন ডাক বা নিলাম ছিল কোটির ঘরে, পরে বিআইডব্লিউটিএর অধীন দশ ভাগের এক ভাগে নামে। তবু ভাড়া কমে না। ফেরি চালুর পর বাস ও মাইক্রোবাসের যাত্রীদের আলাদা ভাড়া না থাকলেও মোটরসাইকেল–বাইসাইকেলের যাত্রীদের আলাদা ভাড়া দিতে হয়।
গাড়ি ও মোটরসাইকেল-বাইসাইকেল থাকে রাস্তায়, তবু পার্কিংয়ের জন্য গাড়িকে দিতে হয় ৪০ টাকা, মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেল বাবদ ১০ টাকা আর ঘাটের টোল ১০ টাকা দিতে হয়। সঙ্গে মোটরসাইকেল ও বাইসাইকেলের যাত্রীকে জনপ্রতি ৫০ টাকা।
ফেরিতে প্রায় দিনই দু-একটি ট্রিপ বন্ধ থাকবে। আর ফেরি না চললেই ইজারাদারের বাড়তি লাভ। চলবে নৌকা। তখন নৌকায় নেওয়া হবে মোটরসাইকেল ১০০, যাত্রী ১০০ আর ওঠার জন্য ১০০ আর নামানোর জন্য ১০০। অর্থাৎ একজন মোটরসাইকেল আরোহীকে নৌকায় পার হলেই নেবে মোট ৪০০ টাকা। ইজারাদারের কথাই যে আইন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
চিলমারী একসময় ছিল বাহারবন্দ পরগনাভুক্ত। এখানেই লেখা হয়েছে বিখ্যাত সেই ছড়া, ‘লাঙল বেচায়, জোয়াল বেচায়/ আরও বেচায় ফাল,/ খাজনার তাপোতে বেচায়/ দুধেরও ছাওয়াল।’—সেই বাহিরবন্দ চিলমারীতে অতিরিক্ত খাজনা নেয়, কেউ কিছু কয় না।
নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক
nahidknowledge1@gmail.com