এই তফসিল যেভাবে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলল

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নিরাপত্তায় বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়

বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে এবার যতটা আলোচনা–সমালোচনা প্রত্যক্ষ করছি, উপমহাদেশের কোনো দেশের নির্বাচন নিয়ে এর আগে এমনটা ঘটেছে বলে আমার মনে হয় না। বিশেষ করে বিশ্বের বড় বড় শক্তির মধ্যে টানাপোড়েন আমরা দেখছি। পর্দার আড়াল থেকে নয়, দূর থেকেও নয়, সরাসরি দেশের ভেতরে তাঁরা কথাবার্তা বলছেন, নানা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

রাজনৈতিক মাঠে কিছুদিন আগেও আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দেখতে পেয়েছিলাম। তখন আমাদের কাছে মনে হয়েছিল, এবার হয়তো একটু ভিন্ন চিত্র দেখা যাবে। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের ঘটনার পর আর সেই পরিবেশ দেখা গেল না।

সরকারের বাইরে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে একটা নির্বাচন হোক। এর কারণ হলো, ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যে ধরনের নির্বাচন হয়েছে, তার অভিজ্ঞতা সুখকর ছিল না। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও নির্বাচন দুটি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।

সাম্প্রতিক কালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক, উপনির্বাচন হোক—কোনো নির্বাচনই আমরা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্রহণযোগ্য হতে দেখিনি। কিন্তু অনিয়ম, কারচুপি বন্ধে নির্বাচন কমিশনের বলিষ্ঠ ভূমিকা আমরা দেখতে পাইনি। নির্বাচন কমিশন হয়তো যুক্তি দিতে পারে, আইনের অপ্রতুলতার কারণে তারা পদক্ষেপ নিতে পারেনি। কিন্তু সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনের হাতে যে অন্তনির্হিত ক্ষমতা দেওয়া আছে, তারও প্রয়োগ করতে দেখিনি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দু–তিন বছর ধরে বিভিন্ন মহল থেকে বিস্তর কথাবার্তা চলছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে, সংবিধানের বাইরে তারা যাবে না। কিন্তু নির্বাচনের আগে আমরা দেখছি যে নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচিত হতে পারে যে দলটি, তার কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রায় সবাই এখন কারাগারে। কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করার মতো নেতা না থাকায় বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে একটা বিশৃঙ্খলা চলছে। হরতাল, অবরোধের মতো কর্মসূচি তারা দিচ্ছে।

তফসিল ঘোষণার পর সেটি প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিএনপি শুধু একা নয়, নির্বাচনে বামপন্থী দলগুলোও তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। এলডিপি, কল্যাণ পার্টি, গণতন্ত্র মঞ্চসহ অনেক দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপির সঙ্গে আন্দোলন করে আসছে। তারাও তফসিলকে স্বাগত জানায়নি। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও তারা মাঠে আছে। জাতীয় পার্টিও কোথায় যাবে, কী করবে তা নিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আছে। দীর্ঘদিন ধরেই নেতৃত্ব নিয়ে দলটিতে একটা ফেঁকড়া লেগে আছে। ফলে দলটির অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে।

আগের দুটি নির্বাচনে আমাদের দেশের ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে তারা সন্দিহান। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা হওয়ায় পুরো বিষয়টিই আরও জটিল করে দিয়েছে।তফসিলের পর নির্বাচন কমিশনের যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, সেটা তারা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, সেটা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। মূল বিষয় হলো একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি হয়নি। সে ক্ষেত্রে যে নির্বাচনটি হবে সেটা শুধু দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সরকারি দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ ১৪ দল আছে। আওয়ামী লীগ বাদে অন্য দলগুলোর কতটা জনসমর্থন আছে, সেটা বলা মুশকিল। কেননা, এই দলগুলো আলাদাভাবে নির্বাচন করে না। বড় দলের ছত্রচ্ছায়ায় নির্বাচন করলে জনসমর্থন বোঝা যায় না। সবকিছু মিলিয়ে একটা গভীর রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে বাংলাদেশে। 

এর সঙ্গে এবার পশ্চিমা বিশ্বেরও বড় একটা চাপ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। প্রথম দিকে তারা অবাধ, সুষ্ঠু ভোটের কথা বলেছে। কিন্তু এখন তারা নতুন করে বলছে অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন হতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের অর্থ হলো, যতগুলো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল আছে, সবাইকে নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করার সুযোগ দেওয়া। প্রকৃতপক্ষে এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদেশগুলোর দিক থেকে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ যে সমস্যায় পড়তে পারে, সে রকম একটা আভাস দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের ভিসা নীতিতে যদি টার্গেটেড নিষেধাজ্ঞা দেয়, সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে আসবে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা সমষ্টিগত পর্যায়ে আসার শঙ্কাও আছে। কেননা, বিশ্বের অনেক জায়গায় দেখা গেছে, সংস্থার ওপরও তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দেওয়া মানে ইউরোপ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া এমনকি জাপানের দিক থেকেও সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি রয়েছে। 

নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র ব্যতিক্রম। কিছুদিন আগে মালদ্বীপে নির্বাচন হয়ে গেল। মালদ্বীপের জনসংখ্যা কম হলেও সেখানে নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। সেখানে তো নির্বাচনের আগে এত হইচই, সহিংসতা, ধরপাকড় আমরা দেখিনি।

গত বছর নেপালেও একটা সর্বজনগ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমস্যা যা–ই থাকুক, নির্বাচন নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে না। ভারতে আগামী বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাদের নির্বাচন নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই।

এসব দেশে প্রশ্নহীন নির্বাচন হওয়ার কারণ হলো তাদের নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কার্যকর রয়েছে। আমাদের মূল সমস্যাটা এখানেই। আমরা যখন গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা বলছি, তখন সব পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনটা করা উচিত। 

আগের দুটি নির্বাচনে আমাদের দেশের ভোটারদের একটা বড় অংশ ভোট দিতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে তারা ভোট দিতে পারবে কি না, সে বিষয়ে তারা সন্দিহান। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণা হওয়ায় পুরো বিষয়টিই আরও জটিল করে দিয়েছে।

তফসিলের পর নির্বাচন কমিশনের যে নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা, সেটা তারা কীভাবে প্রতিষ্ঠা করবে, সেটা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। মূল বিষয় হলো একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করার পরিবেশ তৈরি হয়নি। সে ক্ষেত্রে যে নির্বাচনটি হবে সেটা শুধু দেশেই নয়, সমগ্র বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হবে। যদি দেখা যায় নির্বাচনে ৬০–৭০ শতাংশ ভোট গ্রহণ হয়েছে, তারপরও সেই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। কেননা, কত শতাংশ ভোট পড়ল ব্যাপারটি সেটা নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারল কি পারল না, সেটাই মূল প্রশ্ন।

অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের পরিবেশ যে তৈরি হয়নি, সেটা সবার আগে নির্বাচন কমিশনেরই ভালো করে বোঝার কথা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া পাহারার মধ্যে নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণা করেছেন। তফসিলটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণযোগ্য হয়নি। তফসিলে মনোনয়ন জমা দেওয়া থেকে শুরু করে ভোট গ্রহণ পর্যন্ত লম্বা সময় নেওয়া হয়েছে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আলোচনার পরিবেশ তৈরি করতে না পারে, তাহলে তফসিল চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার আগুনে ঘি ঢালবে।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার তফসিল ঘোষণার সময় বলেছেন, সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। তাঁর এই বক্তব্য ইতিবাচক আশাবাদ তৈরি করে। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্য রাজনৈতিক দলগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নেবে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ, সমঝোতার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা খুবই সীমিত। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করার মূল দায়িত্ব সরকারের। নির্বাচন কমিশনকে চেষ্টা করতে হবে মাঠপর্যায়ে তারা যেন নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে পারে। কিন্তু এখন সেটা করা খুবই কঠিন।

সবকিছুর পরও আমরা এখনো আশাবাদী থাকতে চাই। আমরা আশা করি, আমাদের রাজনীতিবিদেরা আগাম ঝড়ের আভাস বুঝতে পারবেন। দেশকে এই ঝড় থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন। কারণ, সব সিদ্ধান্ত তাঁদের হাতেই।

ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)