মতামত

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব সংস্কার প্রয়োজন

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিটি ধাপই সঠিক হওয়া আবশ্যক, তা না হলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না। আর প্রতিটি নির্বাচনী ধাপের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে কতগুলো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ডের ওপর।

সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ডগুলো হলো: ১. সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমসুযোগ সৃষ্টি করতে পারে, এমন একটি আইনি কাঠামো থাকা, ২. ভোটার তালিকা প্রস্তুতকরণ প্রক্রিয়ায় যাঁরা ভোটার হওয়ার যোগ্য, তাঁদের ভোটার হতে পারা; ৩. যাঁরা প্রার্থী হতে আগ্রহী, তাঁদের প্রার্থী হতে পারা; ৪. ভোটারদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প প্রার্থী থাকা; ৫. নির্বাচনী এলাকার সীমানা কতগুলো মানদণ্ডের ভিত্তিতে সঠিকভাবে নির্ধারিত হওয়া; ৬. জেনে-শুনে-বুঝে সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য প্রার্থীদের সম্পর্কে ভোটারদের সামনে যথাযথ তথ্য থাকা; ৭. ভোটারদের ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারা; ৮. অর্থ কিংবা সহিংসতার মাধ্যমে ভোটারদের প্রভাবিত করার অপচেষ্টা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা; ৯. ভোট গণনা সঠিকভাবে হওয়া; ১০. নির্বাচনী বিরোধ দ্রুততার সঙ্গে নিরপেক্ষভাবে মীমাংসিত হওয়া; সর্বোপরি ১১. ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হওয়া।

এসব মানদণ্ড পূরণের জন্য গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-তে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত নির্বাচন কমিশন একগুচ্ছ সংস্কার প্রস্তাব রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের মতামত নিয়ে আইনে পরিণত করে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনের অধীনে রাজনৈতিক দলের বাধ্যতামূলক নিবন্ধন, সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের যোগ্যতার মাপকাঠিকে কঠোরতা আরোপ, প্রার্থীদের হলফনামার মাধ্যমে তথ্য প্রদানের বিধান, রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি ছিল উল্লেখযোগ্য সংস্কার।

গত এক দশকে নির্বাচনী আইনে আর কোনো উল্লেখযোগ্য সংস্কার হয়নি। তবে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে নির্বাচন কমিশন আরপিওর ১৭টি ধারা সংশোধনের একটি প্রস্তাবনা আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বিধানের নবায়ন; প্রার্থীর এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখালে বা কেন্দ্রে যেতে বাধা দিলে শাস্তির বিধান রাখা; ভোট বন্ধে প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ক্ষমতা বাড়ানো; ভোট বাতিলে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি; প্রার্থীদের টিন সার্টিফিকেট ও আয়কর প্রদানের প্রত্যয়নপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক করা; ভোট গণনার বিবরণ প্রার্থী ও প্রার্থীর এজেন্টদের দেওয়া বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি।

এসব প্রস্তাবের মধ্যে মাত্র একটি, রাজনৈতিক দলের সব কমিটিতে ২০৩০ সালের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। বাকিগুলোর বিধান আইনে বা আদালতের রায়ে রয়েছে এবং কমিশন এগুলো ব্যবহারও করে আসছে। তাই এগুলো আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা আনুষ্ঠানিকতামাত্র।

স্বাধীনতার পর থেকেই নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে আমাদের অপারগতা দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে যে ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা উচ্চ আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। এর পরিণতিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আমাদের দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল চরমভাবে বিতর্কিত।

উদাহরণস্বরূপ, বর্তমানে আরপিওর ৪৪ক(২) ধারায় আয়কর রিটার্ন প্রদানের বিধান রয়েছে। কোনো ব্যক্তি বলপূর্বক নির্বাচনী কর্মকর্তাদের স্বাভাবিক নির্বাচনী কর্মকাল পরিচালনার ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করলে তাৎক্ষণিকভাবে নির্দিষ্ট কেন্দ্র, এমনকি পুরো নির্বাচনী এলাকার ভোট গ্রহণ বন্ধ করার ক্ষমতা নির্বাচনী কর্মকর্তাদের রয়েছে এবং তাঁরা তা প্রয়োগও করে আসছেন।

অনিয়মের কারণে ভোট চলাকালে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব নয় বলে প্রতীয়মান হলে তদন্ত সাপেক্ষে পুরো নির্বাচনী এলাকার নির্বাচনী ফলাফলের গেজেট প্রকাশ স্থগিত, নির্বাচনী ফলাফল বাতিল ও পুনর্নির্বাচনের নির্দেশ প্রদানের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে। নূর হোসেন বনাম মো. নজরুল ইসলাম মামলার [৫ বিএলসি (এডি) (২০০০)] রায়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে কমিশনকে এ ক্ষমতা দিয়েছেন। এই রায়ে গেজেট প্রকাশের পরও নির্বাচন বাতিলের ক্ষমতা কমিশনকে দেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়।

গত বছরের অক্টোবরে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে কমিশন এ ক্ষমতা ব্যবহার করে প্রশংসিতও হয়েছে, যদিও কমিশন সুস্পষ্টভাবে বলেনি উপনির্বাচনটি বাতিল না স্থগিত ছিল। বাতিল হলে নতুন করে তফসিল ঘোষণা করা আবশ্যক ছিল আর স্থগিত হলে আগের নির্বাচনে বাতিল করা না হয়ে থাকলে কেন্দ্রগুলোতে পুনর্নির্বাচনের আয়োজন সমীচীন ছিল না।

নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অর্থবহ করার লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংস্কারের পাশাপাশি নিম্নের বিষয়গুলো আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি: ১. ‘না-ভোটে’র পুনঃপ্রবর্তন করা; ২. হলফনামার ছকে পরিবর্তন এনে এটিকে যুগোপযোগী করা; ৩. হলফনামায় মিথ্যা তথ্য প্রদান বা তথ্য গোপনকারীদের মনোনয়নপত্র বাতিলের সুস্পষ্ট বিধান করা; ৪. হলফনামার তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের বিধান করা; ৫. প্রত্যেক প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; ৬. নির্বাচনী ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রার্থী ও ভোটারদের নিয়ে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ‘জনগণের মুখোমুখি অনুষ্ঠান’ আয়োজন এবং হলফনামার তথ্য ছাপিয়ে তা ভোটারদের মধ্যে বিলির বিধান করা; ৭. সংরক্ষিত নারী আসনের ক্ষেত্রে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে হলফনামা ও আয়কর বিবরণী দাখিলের বিধান করা; ৮. রাজনৈতিক দলের প্রাথমিক সদস্যদের নাম ওয়েবসাইটে প্রকাশ ও নিয়মিত আপডেটের বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করা; ৯. নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া রাজনৈতিক দলের অডিট করা হিসাব যাচাই-বাছাইয়ের বিধান করা; ১০. বিদেশে বা নির্বাচনী এলাকার বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পোস্টাল ব্যালটের ব্যবস্থা করা; ১১. সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে, উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ সাপেক্ষে, জেলা জজদের নিয়ে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল গঠন করা; ১২. রিটার্নিং কর্মকর্তার মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে দায়েরকৃত আপিল নিষ্পত্তি করার সময়সীমা তিন দিনের পরিবর্তে এক সপ্তাহ করা।

আমরা মনে করি, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বর্তমানে সবচেয়ে বড় বাধা বিদ্যমান বিধিবিধানের পরিপূর্ণ প্রয়োগ না হওয়া। উদাহরণস্বরূপ: ১. আরপিওর ৯০খ (১) (খ) (ই) ধারা অনুযায়ী নিবন্ধিত দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলের বিদেশি শাখা থাকা বেআইনি, কিন্তু বড় রাজনৈতিক দলগুলো এই বিধান অমান্য করে আসছে।

এই বিধানের কঠোর প্রয়োগ জরুরি। ২. মনোনয়নপত্র অনলাইনে জমাদানের যে পরিপত্র রয়েছে, তা পরিপূর্ণভাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। ৩. তৃণমূল পর্যায়ের দলীয় সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে প্রার্থী মনোনয়নের বিধান প্রয়োগে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি আবশ্যক। ৪. ‘বিরুদ্ধ হলফনামা’ বা কাউন্টার অ্যাফিডেভিট প্রদানের বিদ্যমান পরিপত্র কার্যকর করা আবশ্যক।

স্বাধীনতার পর থেকেই নির্বাচন সুষ্ঠু করার ব্যাপারে আমাদের অপারগতা দূর করার লক্ষ্যে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে যে ‘রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তা উচ্চ আদালতের রায়ের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল করা হয়। এর পরিণতিতে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত আমাদের দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচন ছিল চরমভাবে বিতর্কিত।

এ ধরনের নির্বাচন এড়াতে হলে নির্বাচনী সংস্কারের পাশাপাশি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ আরেকটি রাজনৈতিক বন্দোবস্তে পৌঁছাতে হবে। কারণ, নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে একটি সমঝোতা ছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রায় অসম্ভব।

প্রসঙ্গত, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে আমাদের নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা প্রায় নিরঙ্কুশ এবং আইন যেখানে অসম্পূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কমিশন নির্দেশনা জারির মাধ্যমে সেই অসম্পূর্ণতাও দূর করতে পারে [আলতাফ হোসেন বনাম আবুল কাসেম মামলায় ৪৫ ডিএলআর (এডি) (১৯৯৩)]।

  • ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)