বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতেও ছাত্রলীগের ছাড়পত্র লাগবে?

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সুপারিশপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে জামায়াত শিবিরের অভিযোগ এনে নতুন প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছে শাখা ছাত্রলীগ। ১৫ মার্চ দুপুরে নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় ছাত্রলীগের নগ্ন হস্তক্ষেপ এখন প্রকাশ্য। ক্যাম্পাসগুলোতে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ফাউ খাওয়ার পর নিয়োগ-বাণিজ্যের পুরো নিয়ন্ত্রণ হাতে নিতে শিক্ষকদের চাপ দিচ্ছে ছাত্রলীগ।

শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রলীগের সমন্বয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘবদ্ধ নিয়োগ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী থেকে শুরু করে শিক্ষক পদে এখন অর্থ ছাড়া নিয়োগ পাওয়া কার্যত অসম্ভব।

শিক্ষক পদে মেধার পরিবর্তে এই সংঘবদ্ধ চক্রকে উৎকোচ প্রদান ও তদবিরই এখন মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চক্রের পুরোভাগে আসার চেষ্টা করছে ছাত্রলীগ। নিয়োগের ক্ষেত্রে পছন্দের কোনো ইতরবিশেষ হলেই প্রশাসনের ওপর ছাত্রলীগ চড়াও হচ্ছে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য যোগ্য প্রার্থীকে ক্যাম্পাসে আটকে রাখার ঘটনা শোনা যায়। সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের পছন্দের প্রার্থী মনোনীত না হওয়ায় উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুর করেছিল।

আটকে রেখেছিল শাটল ট্রেন। এবার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য চাপ দিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ও নতুন  প্রশাসনিক ভবনে তালা দিয়েছে ছাত্রলীগ।

এমনিতেই ছাত্রলীগ প্রতিনিয়ত নেতিবাচক সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কে হবেন এবং কোনো একটি বিভাগের শিক্ষক পদে কাকে নিয়োগ করা হবে, এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার চরম অধঃপতনের বহিঃপ্রকাশ।

ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে মেধার পরিবর্তে তদবির, অর্থ প্রদান ও দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য পাচ্ছে। দলীয় আনুগত্য সবার আগে। এরপর তদবির ও আর্থিক লেনদেন করতে হয়। অনেক সময় নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে যৌনতারও অভিযোগ উঠে আসে শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। এই হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান হালচাল। এ ধরনের শিক্ষকদের কাছে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা আশা করা আদৌ কি সম্ভব?

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে শিক্ষক হতে এখন ছাত্রলীগের ছাড়পত্র লাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ছাত্রলীগ নিজস্ব বোর্ড গঠন করেছে রীতিমতো। ছাত্রলীগের মনোনয়ন বোর্ডই ঠিক করে দেয় শিক্ষক পদের জন্য কে যোগ্য আর কে অযোগ্য। আর এদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক। এই শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ রয়েছে।

শিক্ষক নিয়োগে নিজেদের প্রার্থী মনোনীত না হলে প্রথমেই যে কাজটি করে ছাত্রলীগ, তা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতের ট্যাগ লাগিয়ে দেওয়া। জাহাঙ্গীরনগরেও এর ব্যত্যয় হয়নি। প্রশাসনিক ভবন ও পরীক্ষা অফিসে তালা ঝোলানো প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল সংবাদমাধ্যমকর্মীদের বলেছেন, ‘ক্যাম্পাসের কোনো পদে জামায়াত-শিবির বা স্বাধীনতাবিরোধী কেউ নিয়োগ পাক, তা আমরা চাই না। আমরা চাই মেধাবীরা নিয়োগ পাক। আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রশাসনকে বলেছি। তারা আমাদের কথা গ্রাহ্য করেনি। তাই বাধ্য হয়ে তালা দিয়েছি।’

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নিজেদের পছন্দের প্রার্থী মনোনীত না হওয়ায় উপাচার্যের কার্যালয় ভাঙচুর করেছিল।

কী বিস্ময়কর। পছন্দ না হলেই তালা মেরে দিচ্ছে এবং এটা প্রকাশ্যে বলছেও। এ ধরনের অপকর্মকে আড়াল করার জন্য যথারীতি বিএনপি-জামায়াতের ট্যাগ লাগানো হচ্ছে। এমনকি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জামায়াত-শিবির বানাতে পিছু হটছে না ছাত্রলীগ।

বর্তমান সরকারের আমলে বিরোধী মত অনেক দূরের কথা, ক্ষমতাসীনদের পছন্দের না হলে আওয়ামীপন্থী অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে কেউ নিয়োগ পান না। ‘বিএনপিপন্থী’ বা ‘জামায়াত-শিবির’ পরিচয়ের কেউ যেন শিক্ষক পদে নিয়োগ না পান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হতে না পারেন, সে কারণেই সম্ভবত বিদগ্ধ ও দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদদের বদলে দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে একান্ত অনুগতদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য পদে নিয়োগ দেওয়া হয়ে থাকে।

এসব কারণে উপাচার্য পদটি এখন শিক্ষাবিদদের কোনো পদ নয়। বরং দলীয় কর্মীর পদে পরিণত হয়েছে। দলীয় শিক্ষকেরাই এখন উপাচার্য হতে অতি উৎসাহী। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় ও কর্মকাণ্ড এখানে মুখ্য। শিক্ষা ও গবেষণা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। ফলে ছাত্রলীগ না উপাচার্য কে কার চেয়ে বেশি দলীয় স্বার্থরক্ষা করছেন, তা প্রমাণে উভয় পক্ষই মরিয়া থাকে।

অধিকাংশ উপাচার্যের কথাবার্তায় শিক্ষা গবেষণার কোনো উল্লেখ থাকে না। বরং এখনকার উপাচার্যরা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন তিন শ্রেণির ছাত্রলীগ কর্মী দিয়ে। এরা হচ্ছে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা; সাবেক ছাত্রলীগ করা শিক্ষক এবং বর্তমান ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের এত এত সাবেক-বর্তমানদের সামলাতে উপাচার্য আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থে কিছু করতে পারেন না।

যখনই এদের স্বার্থ রক্ষা করতে পারেন না, মানে উল্লিখিত তিন অংশের মধ্যে ভারসাম্য আনতে ব্যর্থ হলেই কোনো না কোনো পক্ষ খেপে যায়। তখনই জাহাঙ্গীরনগর বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো হেনস্তার শিকার হন উপাচার্যরা। 

এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিএনপি-জামায়াতপন্থী কাউকে নিয়োগ দেওয়া বা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া অসম্ভব এক ব্যাপার। কিন্তু দেশে ‘বিএনপিপন্থী’ বা ‘জামায়াত শিবির’ ট্যাগ লাগানোর একটি রাজনীতি চলমান আছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের ক্ষেত্রে। এটা কেন হয়?

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, প্রক্টর, শিক্ষকনেতা, কর্মকর্তা এবং ছাত্রলীগের নেতাদের এ-সংক্রান্ত ফোনালাপ বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

এ থেকে অনুমান করা যায়, একটি নিয়োগে যখন নিজেদের পছন্দের কেউ বাদ পড়েন, তখন তা এ ধরনের নীতিহীন নেতাদের ক্ষোভের কারণ হয়। তবে দেশে প্রচারিত বিভিন্ন অডিও থেকে ধারণা করা যায়, পছন্দ তৈরি হয় আদর্শের কারণে নয় বরং আর্থিক কারণে।

নিয়োগের আগে নেতারা উপাচার্যকে তাঁদের পছন্দের তালিকা দিয়ে আসেন। এ তালিকা তৈরি হয় আনুগত্য বা টাকার বিবেচনায়। তালিকার কারও চাকরি না হলে টাকা হাতছাড়া হয়ে যায়। তখনই শুরু হয় ‘বিএনপিপন্থী’ বা ‘জামায়াত-শিবির’ ট্যাগ লাগানোর রাজনীতি। 

ফলে বোঝাই যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে মেধার পরিবর্তে তদবির, অর্থ প্রদান ও দলীয় আনুগত্য প্রাধান্য পাচ্ছে। দলীয় আনুগত্য সবার আগে। এরপর তদবির ও আর্থিক লেনদেন করতে হয়।

অনেক সময় নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে যৌনতারও অভিযোগ উঠে আসে শিক্ষক ও ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। এই হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের বর্তমান হালচাল। এ ধরনের শিক্ষকদের কাছে মানসম্পন্ন শিক্ষা ও গবেষণা আশা করা আদৌ কি সম্ভব?

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক