মতামত

যদি ’১৪ ও ’১৮ সালের মতো নির্বাচন না হয়?

কিছুদিন আগেও বিএনপির আন্দোলন করার মুরোদ নেই বলে আওয়ামী লীগের নেতারা যে বুলন্দ আওয়াজ তুলতেন, এখন আর তা শোনা যাচ্ছে না। বরং বিএনপি সরকারি দলের উসকানির মুখেও অহিংস কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে, সেটি জনগণের সমর্থন পাচ্ছে। বিএনপিকে ধন্যবাদ জানাতে হয়, তারা হরতাল–অবরোধ, জ্বালাও–পোড়াওয়ের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। 

অতিসম্প্রতি বিএনপির দুটো কর্মসূচি জনগণের কৌতূহল বাড়িয়েছে—তারুণ্যের সমাবেশ ও নারী সমাবেশ। এসব সমাবেশে বিএনপি কত বেশি লোককে টানতে পারবে, তার চেয়েও দেখার বিষয় হলো ক্ষমতাসীনদের প্রতিক্রিয়া। বিএনপি তারুণ্যের সমাবেশ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগও একই দিনে একই ধরনের কর্মসূচি ঘোষণা করে। এতে বিএনপি তাদের কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করল। ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ও মাঠে শক্তি প্রদর্শনের মহড়া সাধারণ মানুষ কিন্তু ভালোভাবে নিচ্ছে না। এর মাধ্যমে কি তারা এটাই প্রমাণ করতে চায় যে বিএনপিকে মোকাবিলা করতে সরকার অপারগ, দলের সহায়তা প্রয়োজন? অতীতে বিএনপি সরকারবিরোধী দলকে শায়েস্তা করতে কী কী অস্ত্র ব্যবহার করেছে, আওয়ামী লীগ নেতারা প্রতিদিন বক্তৃতার মঞ্চে তার বয়ান দেন। কিন্তু জনগণ তো প্রত্যক্ষ করছে আওয়ামী লীগ আমলে বিরোধী দল নির্বিঘ্নে সভা–সমাবেশ করতে পারছে না।

নতুন মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে এমন অস্থিরতা কাজ করছে যে তাঁরা দলের ভেতরে যে ঘুণ ধরেছে, সেটি টের পাচ্ছেন না। গাজীপুর সিটির নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের নেতারা বেশ আত্মপ্রসাদ লাভ করছেন। কিন্তু নির্বাচনের ফল ঘোষণার আগে কি তাঁরা ভাবতে পেরেছিলেন একজন অখ্যাত প্রার্থীর কাছে দলের প্রার্থী ধরাশায়ী হবেন? গাজীপুর নির্বাচন যঁারা পর্যবেক্ষণ করেছেন, তঁাদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, সেখানেও প্রশাসন পুরোপুরি নিরপেক্ষ ছিল না। আজমত উল্লার প্রতি তাদের পক্ষপাত ছিল। যেমন ২০১৮ সালে তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলমের প্রতি দেখিয়েছিল। ভোটের আগের দিন মার্কিন ভিসা নীতির খবরটি না এলে ফলাফল হয়তো ভিন্ন হতো। ২০১৮ সালে সিলেট সিটি নির্বাচনের পর সেখানে দায়িত্ব পালনকারী একজন সরকারি কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সারা দেশে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার, সিলেটে ভিন্ন ফল হলো কেন? তিনি বলেছিলেন, ক্ষমতাসীনেরা বুঝতে পারেননি এমনটি হবে। গাজীপুরের নির্বাচনেও একই ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের জাঁদরেল নেতারা কল্পনাও করতে পারেননি জায়েদা খাতুনের কাছে আজমত উল্লা হেরে যাবেন। আজমত উল্লা হেরেছেন সত্যি। তবে বড় হারটা হয়েছে আওয়ামী লীগেরই। 

আওয়ামী লীগের নেতারা কি মনে করছেন আগামী নির্বাচনটিও তাঁরা আগের মতো করতে পারবেন? ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে এলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নূরুল হুদা কমিশন এমনভাবে নির্বাচনটি সাজিয়েছিল, কষ্ট করে ভোটারদের (বেশির ভাগ) ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরও ভোট চাইতে হয়নি। 

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনও গাজীপুরের মতো সুষ্ঠু হবে। তবে তঁারা এ কথা বলছেন না যে গাজীপুরের মতো সুষ্ঠু নির্বাচন হলে জায়েদা খাতুনের মতো প্রার্থীদের কাছে নৌকার প্রার্থীরাও হেরে যেতে পারেন। গাজীপুর সিটির নির্বাচনের পরও সেখানকার আওয়ামী লীগের ভেতরকার বিরোধ যে কাটেনি, তার প্রমাণ মূল্যায়ন সভায়ও চেয়ার ছোড়াছুড়ির ঘটনা। 

গাজীপুরের পর বরিশাল সিটি নির্বাচনেও দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের অবসান ঘটাতে পারেননি দলের ডজনখানেক কেন্দ্রীয় নেতা সেখানে অস্থায়ী বাসস্থান করেও। বরিশালে এবার দলের মনোনয়ন পেয়েছেন আবুল খায়ের আবদুল্লাহ, বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর চাচা। চাচার নির্বাচন ‘বর্জন’ করে ভাতিজা ঢাকায়। বড় ভাই ও ছোট ভাইয়ের (হাসানাত আবদুল্লাহ ও খায়ের আবদুল্লাহ) কোলাকুলির ছবি ছাপা হওয়ার পরও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিভক্তি দূর হয়নি।

আওয়ামী লীগের বিরোধ কেবল গাজীপুর ও বরিশালে নয়। কুমিল্লা, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, টাঙ্গাইল, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, পাবনা, ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ থেকে যেসব খবর আসছে গণমাধ্যমে, তা–ও দলের জন্য সুখকর নয়। প্রায় সব জেলায় মন্ত্রী বনাম সংসদ সদস্য, সংসদ সদস্য বনাম উপজেলা চেয়ারম্যান, নির্বাচিত প্রতিনিধি বনাম স্থানীয় নেতাদের বিরোধ এখন ওপেন সিক্রেট। কোথাও কোথাও প্রাণঘাতী সংঘাতও ঘটছে। ৭ জুন ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশেও নেতাদের সামনে চেয়ার ছোড়াছুড়ি হয়েছে। 

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল জয়ের পেছনে ছিল তরুণদের ব্যাপক সমর্থন। সেদিন তরুণেরা সত্যিকার অর্থেই তঁাদের দিনবদলের সনদে বিশ্বাস রেখেছিলেন। কিন্তু সরকার ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটির ব্যানারে যেসব তরুণকে লালন করে চলেছে, তাঁদের কর্মকাণ্ড মোটেই জনসমর্থন বাড়াচ্ছে না। এই সরকারের আমলেই ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতা চাঁদাবাজির অপবাদ নিয়ে মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁদের আগে ও পরে যাঁরা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে এসেছেন, তাঁরাও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেননি। 

সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের আবাসিক শিক্ষার্থী সামিউল ইসলাম তিন দফা দাবিতে অনশন কর্মসূচি পালন করছিলেন হলের মাঠে। তাঁর তিন দফা দাবি হলো হল থেকে অছাত্রদের বের করে দিতে হবে, গেস্টরুম বন্ধ করতে হবে এবং মিনি গেস্টরুমে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীকে হলে আসন বরাদ্দ দিতে হবে। 

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশ্বাসে সামিউল আট দিনের মাথায় অনশন ভেঙেছেন। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর ওপর হামলা চালান। তাঁরা সামিউলের বিছানা, কাঁথা, বালিশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেন। এ সময় স্যালাইন রাখার স্ট্যান্ড ভাঙচুর করা হয়। পরে সামিউলকে জোর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান ছাত্রলীগের একজন নেতা। আইন এখানে অন্ধ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অসহায়। 

একজন অনশনরত সহপাঠীর প্রতি ছাত্রলীগের এই আচরণ নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছু নয়। একজন শিক্ষার্থী ন্যায্য দাবিতে অনশন করছেন, তঁার ওপর হামলা চালানোর মতো ঔদ্ধত্য কীভাবে দেখান ছাত্রলীগের গুণধর কর্মীরা? এই শিক্ষাই কি দেওয়া হয়েছে তাঁদের? 

আওয়ামী লীগের নেতারা কি মনে করছেন আগামী নির্বাচনটিও তাঁরা আগের মতো করতে পারবেন? ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছিল। আওয়ামী লীগ ফাঁকা মাঠে গোল দিয়েছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে এলেও প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় নূরুল হুদা কমিশন এমনভাবে নির্বাচনটি সাজিয়েছিল, কষ্ট করে ভোটারদের (বেশির ভাগ) ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়নি, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদেরও ভোট চাইতে হয়নি। 

এবার যদি সত্যি সত্যি বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেয় এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন পক্ষপাত না দেখায়, তাহলে নির্দলীয় কিংবা নির্বাচনকালীন যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, পুলিশ পাহারায় থেকে যাঁরা এখন বড় বড় কথা বলছেন, তাঁদের সত্যিই কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়তে হবে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com