তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট কাইস সাইদ দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন।
একটি অখ্যাত জরিপ সংস্থা ৬ অক্টোবরের নির্বাচন নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছিল যে সাইদ ৮৯ শতাংশ ভোট পেতে যাচ্ছেন। এই সংখ্যা তিউনিসিয়ার সর্বশেষ স্বৈরশাসক বেন আলির কথা স্মরণ করিয়ে দিল। কেননা, তাঁর শেষ নির্বাচনে তিনি ঠিক ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।
যাহোক, সরকারিভাবে ঘোষিত নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় ৯১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন সাইদ। ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা দেখানোর একটা প্রাণান্ত প্রচেষ্টা। কিন্তু ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের একটা উক্তিকে ধার নিয়ে বলা যায়, আপনি জনপ্রিয় ও ক্ষমতাবান, সেটা জানানোর জন্য একটা নির্বাচন করার দরকার হয়, তাহলে সত্যি সত্যি আপনি তা নন।
৬৬ বছর বয়সী সাইদ একবার রঙ্গের ছলে বলেছিলেন, চার্লস দ্য গলের মতো তিনিও বুড়ো বয়সে স্বৈরশাসক হিসেবে নতুন ক্যারিয়ার শুরু করেছেন। এখন তিনি ট্র্যাজেডি ও কমেডি, দুই বিবেচনা থেকেই ক্লান্ত পায়ে বেন আলির পথেই হাঁটছেন।
তাঁর পূর্বসূরির মতো, এটাই সাইদের শেষ নির্বাচন হতে পারে। এখন মূল প্রশ্ন হলো, সাইদ কি বেন আলির ট্র্যাজেডিটা পুরো করবেন নাকি অন্য কোনো শক্তি প্রথমে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করবে।
অদ্ভুত বিষয় হলো, নির্বাচনের সংজ্ঞায় যা যা থাকে, ফলাফল ছাড়া তার সবকিছুই এই নির্বাচনে ছিল। নির্বাচন কমিশন ও আদালতের অধস্তনতা, প্রার্থী বাছাইয়ের জটিল প্রক্রিয়া, প্রতিযোগী প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, ভোটের দিন পর্যন্ত রাস্তায় বিক্ষোভ এবং কম ভোটার উপস্থিতি (যেটা তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসের সর্বনিম্ন)—এ সবকিছুই দেখতে পাওয়া গেছে।
সাইদকে এই মুহূর্তে একজন দুর্বল লৌহমানব বলাটাই শ্রেয়। পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণে এই সংজ্ঞাটাই তার জন্য উপযুক্ত।
সাইদ ভবিষ্যতে একজন ভয়ানক কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবেন। একটা ব্যর্থ অর্থনীতিকে টেকাতে তিনি ভর্তুকির ওপর নির্ভর করেছেন। তিনি এমন একটা রাজনৈতিক প্রকল্প শুরু করেছেন, যেটা লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফির জামাহিরিয়া প্রকল্পের চেয়েও অকার্যকর।
সাইদ প্রতিনিয়ত একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলার কথা বলে আসছেন। অথচ তিনি তিউনিসিয়ার প্রশাসন যন্ত্র থেকে লোক বাদ দিতে দিতে সবচেয়ে ছোট প্রশাসনে পরিণত করে ফেলেছেন। মন্ত্রিসভার মুখগুলোকে প্রতিনিয়ত বদলে ফেলছেন।
একজন দুর্বল সাইদ মানে আরও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত সাইদ। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যে সাইদ হবেন আরও বেশি কর্তৃত্বপরায়ণ। তিনি সব প্রাতিষ্ঠানের স্বাধীনতাকে হরণ করবেন। তিউনিসিয়া যে পদ্ধতিগত সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেটা মোকাবিলা করার জন্য তিনি একজন অদক্ষ ব্যক্তি।
অথচ এই সমস্যাগুলো অনেক গুরুতর।
তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সাইদের অভ্যুত্থানকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল। কারণ, বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে বিশৃঙ্খতা তৈরি করেছিল, সেখান থেকে আবারও সুপরিচিত এক ব্যক্তির শাসনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। তিউনিসিয়া একসময় আরব বসন্তের বাতিঘর ছিল। সেই তিউনিসিয়া এখন আবার নতুন একটি প্রবণতার বাতিঘর।
তিউনিসিয়ার ঘাড়ে এখন সবচেয়ে বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পুরোনো ঋণের বড় অঙ্কের আসল এবং সম্প্রতি নেওয়া উচ্চ সুদহারের ঋণের সুদ—সব মিলিয়ে বড় একটা চাপে দেশটির অর্থনীতি।
তিউনিসিয়ার অর্থনীতির মূল স্তম্ভ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এবং বাজার ও ভর্তুকি ব্যবস্থা—ওসব কিছুর ঋণের বাধ্যবাধকতার মধ্যে রয়েছে।
ঋণের জন্য সাইদকে তিউনিসিয়ার ব্যাংকগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ফলে এই খাতে প্রবৃদ্ধির আর আশা নেই এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন করতে হচ্ছে।
রাজনৈতিক শক্তি না থাকায় পরিস্থিতি যত খারাপ হবে, সাইদ ততই নিষ্ঠুর দমন–পীড়নের পথ বেছে নেবেন, একে–তাকে বলির পাঁঠা বানাবেন।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিক্ষোভকারীদের সতর্ক করে দিয়ে বলছেন যে তিউনিসের প্রধান সড়কে এটাই তাদের জন্য শেষ বিক্ষোভ। তার দাবি, বিক্ষোভ করার যথেষ্ট কারণ নেই। এ থেকেই বোঝা যায়, ভবিষ্যতে কী পরিণতি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আরেকটা অশুভ দিক হচ্ছে, সাইদ যখন তিউনিসিয়ার গর্ব করার মতো আমলাতন্ত্রকে ভেঙে ছোট করে ফেলছেন, তখন নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি বাড়ছে।
যাহোক, ২০২১ সালে সাইদ তিউনিসিয়ার কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার মুখ হয়ে উঠলেও অভ্যুত্থানটিতে সমর্থন দিয়েছিল ও টিকিয়ে রেখেছে তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনী।
২০১৭ সালের সন্ত্রাসবাদবিরোধী অভিযানের কারণে তিউনিসিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী গোয়েন্দা বাহিনী। সে কারণে সাইদের মন্ত্রিসভা যখন ক্রমাগত অকেজো হয়ে পড়ছে, তখন জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছে।
খোঁচা দেওয়া স্বভাবের কারণে প্রেসিডেন্টের সাইদের সঙ্গে যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক দুর্বল হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তিউসিয়ার সেনাবাহিনীর সম্পর্ক গভীর হচ্ছে।
সুতরাং তিউনিসিয়ার সরকারি ও বেসরকারি খাত যখন ক্রমেই গরিব হচ্ছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় দেশটির সেনাবাহিনীর স্ফীতি ঘটছে।
তিউনিসিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী সাইদের অভ্যুত্থানকে আলিঙ্গন করে নিয়েছিল। কারণ, বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে বিশৃঙ্খতা তৈরি করেছিল, সেখান থেকে আবারও সুপরিচিত এক ব্যক্তির শাসনে ফিরে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল।
তিউনিসিয়া একসময় আরব বসন্তের বাতিঘর ছিল। সেই তিউনিসিয়া এখন আবার নতুন একটি প্রবণতার বাতিঘর।
তিউনিসিয়া রাজনৈতিক উদারবাদ থেকে দূরে সরে গেছে। অর্থনৈতিক ভাঙন, সামরিকায়িত কর্তৃত্ববাদ ও আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে গেছে দেশটি।
এখন প্রশ্ন হলো, তিউনিসিয়া কোন দিকে যাবে? সেটা নির্ভর করছে সাইদ ক্ষমতা থেকে যাওয়ার আগে তিউনিসিয়ার অর্থনীতি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কতটা ক্ষতি করে, তার উপরে।
তারেক মেগেরিসি রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডল ইস্ট আই থেকে, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত