পাকিস্তানের প্রধান দল পিটিআইয়ের ওপর চাপ কখন কমবে, তা জানেন না নেতা–কর্মীরা
পাকিস্তানের প্রধান দল পিটিআইয়ের ওপর চাপ কখন কমবে, তা জানেন না নেতা–কর্মীরা

পাকিস্তানে ‘সফল’ নির্বাচন যেসব সংকট বাড়িয়ে দেবে

পাকিস্তানের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনের সম্ভাব্য ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল (মুসবাত বা ইতিবাচক ধরনের কিছু) মনে হচ্ছে জনপদের সব অক্সিজেন শুষে ফেলছে। এখন রাজধানীর যেকোনো আড্ডার শুরু এবং শেষ হচ্ছে নির্বাচন কেমন হবে বা এই নির্বাচনের ফল শেষ পর্যন্ত কোথায় দাঁড়াবে, সেই আলোচনা দিয়ে।

পাকিস্তান বর্তমানে আলাদা কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত তিনটি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সেগুলো হলো রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষামূলক।

রাজনৈতিক সংকট: এখানে রাজনৈতিক সংকটের প্রথম শিকার হয় নির্বাচনব্যবস্থা। অন্তহীন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এখানকার বেসামরিক সরকারগুলোকে জরুরি প্রশাসনসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে দেয় না। আসন্ন নির্বাচন এই সমস্যার সমাধান করবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, কমবেশি সবাই বুঝতে পারছে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, সেই সরকার জনগণের ইচ্ছার চেয়ে কূটকৌশলের ওপর বেশি নির্ভরশীল থাকবে।

গত পাঁচ বছর বা তার চেয়ে বেশি সময়ে যেসব সরকার দেশ চালিয়েছে, তারা সবাই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।

এই সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দলের নাম পিটিআই। আগামী নির্বাচনে কে জিতবে, সেটি এই দলের কাছে বড় ব্যাপার হবে না। কারণ, এই দলটির এবং দলটির নেতা-কর্মীদের ওপর বিদ্যমান রাজনৈতিক চাপ কখন কমবে এবং কখন তাঁরা মুক্তভাবে রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন, সেটিই তঁাদের কাছে মুখ্য বিষয় হয়ে আছে। নির্বাচনের পরও তা থাকবে। এ কারণেই নির্বাচনের আগে কিংবা পরে, কোন নীতি ধরে এগোতে হবে, তা এখনই ঠিক করা সোজা নয়।

ক্রমবর্ধমানভাবে পতনমুখী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক অংশীদারদের মধ্যকার ঐকমত্যের অভাব এবং পিটিআইয়ের প্রতি বাড়তে থাকা জনসমর্থন একটি অস্বস্তিকর কিংবা বিস্ফোরক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। ইমরান খান যদি ছাড়া পান, তাহলে আবার একটি বড় বিক্ষোভ হতে পারে; নওয়াজ শরিফ লন্ডনে থাকাকালে পিডিএম যেমনটা করেছিল।

এখন সবার মনে যে প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে, সেটি হলো আগামী জোট সরকার কি এতটা বড় হবে যে পিটিআই আন্দোলন করার মতো কোনো সহযাত্রী দলকে খুঁজেই পাবে না? অথবা পিটিআই নির্বাচনের পর কি এতটাই চাপে পড়বে যে তারা আন্দোলন করার ঝুঁকি নিতে চাইবে না?

তবে যা-ই হোক, নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে একটি রাজনৈতিক চাপে যে থাকতে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। সর্বোপরি কথা হলো বিগত জোট সরকারকে তাদের শরিকদের অনেক চড়া মূল্যের দাবি পূরণ করতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে।

এবারের পরিস্থিতি আগের চেয়ে আলাদা হওয়ার কোনো কারণ আছে? যদি কোনো রাজনৈতিক দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে ফেলে, তাহলে জোট থেকে ছিটকে পড়া শরিকদের পিটিআইয়ের সঙ্গে হাত মেলানো ঠেকানো কি সম্ভব হবে?

অর্থনৈতিক সংকট: তত্ত্বাবধায়ক সরকার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে যা দাবি করে আসছে, প্রকৃত অবস্থা তা থেকে অনেক দূরে। রাজনৈতিক অবস্থা মূলত অর্থনৈতিক সংকটের কারণে জটিল থেকে জটিলতর হয়ে উঠছে। যদিও প্রশাসনিক পদক্ষেপগুলো অর্থনীতিকে আপাতত স্থিতিশীল করেছে এবং চলমান আইএমএফ ঋণ অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আইএমএফের দীর্ঘমেয়াদি বর্ধিত তহবিল–সুবিধা নিশ্চিত করতে অর্থনীতিতে সংস্কার আনার দরকার হবে। তবে সে কাজটি করা খুবই কঠিন হবে।

কেউ কেউ বলে থাকেন, অর্থনৈতিক সংস্কার প্রকল্প সম্পূর্ণ করা প্রায় অসম্ভব হবে। পরবর্তী সরকারের পক্ষে (সেই সরকার কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে আসুক বা সুষ্ঠু ভোটে আসুক) সংস্কার বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। কারণ, এটি করতে গেলে ব্যয় কমাতে হবে।

এটি আর্থসামাজিক অস্থিরতার আশঙ্কা তৈরি করবে। যারাই ক্ষমতায় থাকবে, তাদের এর প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।

নিরাপত্তা: শেষ সংকটটি হলো নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি। বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও খাইবার পাখতুনখাওয়া এলাকার পরিস্থিতি এখন খুবই নাজুক। এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে, আমাদের এই দুটি প্রদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার বিষয়ে কোনো বিশদ কোনো পরিকল্পনা নেই।

বেলুচিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং সংলাপ জরুরি। কিন্তু এ বিষয়ে আমরা আলোচনার টেবিলে বসতেই পারছি না। বেলুচিস্তান ইস্যুতে আমরা যে নীতি অনুসরণ করছি, তা গোটা বেলুচিস্তানকে দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

আর খাইবার পাখতুনখাওয়া এলাকাটি কার্যত সন্ত্রাসবাদের দ্বিতীয় আঁতুড়ঘর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেখানে স্বতন্ত্র ধরনের সন্ত্রাসের জন্ম হলেও সে বিষয়ে সরকারের নজর সামান্য।

সর্বোপরি কথা হলো পাকিস্তানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হলে নির্বাচিত বেসামরিক সরকার এবং অদৃশ্য ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে যে বোঝাপড়া থাকা দরকার, সেটি দেখা যাচ্ছে না। এ কারণে এককথায় বলা যায়, পাকিস্তানের ‘সফল’ নির্বাচন একটি নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা করতে পারে বটে কিন্তু সমাপ্তিটা ভালো হবে বলে মনে হয় না।

● আরিফা নূর পাকিস্তানের লেখক ও সাংবাদিক

ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত