বাবাহারা বাকিয়ার কান্না কেন রাষ্ট্র শুনতে পায় না?

জান্নাতুল ফেরদৌস বাকিয়ার বয়স ৯ বছর। তার বাবা পোশাকশ্রমিক জালাল উদ্দিন পুলিশের গুলিতে আহত হয়ে গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। বাবার মৃত্যুর পর মর্গের সামনে নির্বাক ছোট্ট জান্নাতুল
 ছবি: সাজিদ হোসেন

১৩ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রথম পাতায় তিন কলামজুড়ে ছাপা হয়েছে শিশু জান্নাতুল ফেরদৌস বাকিয়ার ছবি। সে চিকিৎসাধীন বাবাকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে এসেছিল মায়ের সঙ্গে। কিন্তু সেখানে এসে দেখতে পায়, বাবা আর বেঁচে নেই। এ অবস্থায় একটি শিশুর মনে কী ধরনের বিষণ্নতা ও বিহ্বলতা দেখা দিতে পারে, সেটিই উঠে এসেছে সহকর্মী সাজিদ হোসেনের ছবিতে। ছবিতে দেখা যায়, বাবাহারা মেয়েটি হাসপাতালের মর্গের সামনে তাকিয়ে আছে। তার নিষ্পলক চোখে ভয়াবহ শূন্যতা। সে দুই হাতের আঙুল দিয়ে কিছু একটা ধরে আছে।

এর আগে মায়ের বুক ফাটা কান্নার মাঝেই ৯ বছর বয়সী বাকিয়া বারবার প্রশ্ন করেছিল, ‘বাবা কোথায়? আমি বাবার কাছে যাব।’ কিন্তু তার আর বাবার কাছে ফিরে যাওয়া হয়নি। বাবার লাশ নিয়েই তাকে ঘরে ফিরতে হয়েছে।

প্রথম আলোর খবর থেকে জানা যায়, গত বুধবার গাজীপুরের কোনাবাড়ীর জরুল এলাকায় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে জান্নাতুল ফেরদৌসের বাবা জালাল উদ্দিনের শরীরে ‘ছররা গুলি’ লাগে। তিনি ছিলেন ইসলাম গ্রুপের একটি কারখানার সুপারভাইজার। সুপারভাইজার হয়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে তাঁর যাওয়ার কথা নয়। আর যদি গিয়েও থাকেন, তাহলে তাঁকে গুলি খেয়ে মরতে হবে কেন?

পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার পর ওই দিনই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য। গত শনিবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। প্রাণহানি এড়ানোর জন্যই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছররা গুলি ব্যবহার করে। কিন্তু এখানে সেই ছররা গুলিতেই জীবন দিতে হলো জালাল উদ্দিনকে।

গত ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপির অনেক বড় নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। অনেককে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক হত্যার ঘটনায় কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এমনটি জানা যায় না। নিহত পুলিশ সদস্যের বাবাহারা কন্যার আকুতিতে সরকার বিচলিত হলেও শ্রমিক আঞ্জুমান আরা ও সুপারভাইজার জালাল উদ্দিনের সন্তানদের আহাজারি তাদের কানে পৌঁছায় না।

জালাল উদ্দিনের স্ত্রী নার্গিস আক্তারের প্রশ্ন, ‘আমার স্বামী তো ছিলেন পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার। শ্রমিক আন্দোলনে যাননি, তিনি শ্রমিকনেতাও ছিলেন না। তাহলে কেন তাঁকে গুলিতে ঝাঁজরা করে মেরে ফেলল?’ কাঁদতে কাঁদতে নার্গিস বলেন, তাঁর মেয়েটি এত কম বয়সে বাবা-হারা হলো। তাঁর আহাজারি, ‘কেন আমার স্বামীকে এভাবে মেরে ফেলা হলো? ওরা আমার কলিজা ছিদ্র করেছে। আরেকটা বুলেট মেরে আমার বুকটাও ছিদ্র করে দাও। স্বামীকে ছাড়া সন্তান দিয়ে আমি কীভাবে বাঁচব?’

জালাল নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার বাঁশাটি ভুটিয়ার কান্দি গ্রামের চান মিয়ার ছেলে। তাঁরা সাত ভাইবোন। গুলিতে বড় ভাইয়ের আহত হওয়ার খবর শুনে দুবাই থেকে সকালে দেশে ফিরে এসেছেন জালালের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম। বিমানবন্দরে নেমেই বড় ভাইয়ের মৃত্যুর খবর শোনেন তিনি। হাসপাতালের মর্গের সামনে দাঁড়িয়ে ভাতিজিকে বুকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে সাইফুল বলেন, ‘ভাইকে আর জীবিত দেখতে পেলাম না।’

এই যে ৯ বছর বয়সে বাকিয়া বাবাকে হারাল, কী জবাব দেবে রাষ্ট্র।

তৈরি পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরা আন্দোলন করছেন মজুরি বাড়ানোর দাবিতে। পোশাক খাতের জন্য গঠিত মজুরি বোর্ড সাড়ে ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করলে শ্রমিকেরা তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁদের আন্দোলন দমন করতে সরকার পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি নামায়। বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভকারী শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। গত বুধবার আঞ্জুয়ারা খাতুন নামের এক পোশাকশ্রমিক নিহত হন। এরপরই জালাল উদ্দিনের মৃত্যুর খবর এল।

অনেকে এটিকে ‘সংঘর্ষ’ বললেও শ্রমিকেরা তা মানতে নারাজ। শ্রমিকেরা বলছেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছেন। আর পুলিশ তাঁদের ওপর গুলি করছে। শ্রমিক বিক্ষোভের সময় বেশ কিছু কারখানায় হামলা হয়েছে। এটা দুঃখজনক। কিন্তু একের পর এক শিল্প এলাকা কেন উত্তপ্ত হলো, শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। শ্রমিকেরা সকালে কর্মস্থলে গিয়ে যখন দেখতে পান কারখানা তালাবদ্ধ, তখন তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ জাগা অস্বাভাবিক নয়। প্রশ্ন হলো সেই সেই ক্ষোভ প্রশমনের উপায় কি দমন-পীড়ন বা বলপ্রয়োগ? শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। শক্তি প্রয়োগ করে বিরোধী দলকে কাবু করা গেলেও শ্রমিকদের আন্দোলন স্তব্ধ করা যায় না।

গত ২৮ অক্টোবরের সংঘর্ষে একজন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপির অনেক বড় নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। অনেককে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু শ্রমিক হত্যার ঘটনায় কোনো পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এমনটি জানা যায় না। নিহত পুলিশ সদস্যের বাবাহারা কন্যার আকুতিতে সরকার বিচলিত হলেও শ্রমিক আঞ্জুমান আরা ও সুপারভাইজার জালাল উদ্দিনের সন্তানদের আহাজারি তাদের কানে পৌঁছায় না।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি