স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীই কথাটা পেড়েছেন। রেড়ির তেল বা ভেন্নার তেল ব্যবহার করতে হবে। তাতে প্রদীপ জ্বলবে। ৬ অক্টোবর গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলন প্রধানমন্ত্রী এই প্রসঙ্গে কথা বলেন। সংবাদমাধ্যম থেকে উদ্ধৃতি দিই: ‘বিশ্বের জ্বালানিসংকটের কথা চিন্তা করে সবাইকে সেভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বব্যাপী জ্বালানিসংকটের কারণে সবাইকে আদি যুগে ফিরতে হবে। শেষে ভেন্নার তেল আর রেড়ির তেল দিয়ে কুপিবাতি জ্বালাতে হবে। এখন তো কেউ ভেন্নার তেল চিনবে না। রেড়ির তেলও চিনবে না। রেড়ির তেল খুব ঘন একটা তেল। অনেকক্ষণ জ্বলে। ভেন্না গাছ তো সবুজ। সবুজ কাঁটা কাঁটা ফল হয়। সেটা থেকে তেল তৈরি করে সেই তেল দিয়ে বাতি জ্বালানো হতো। কুপিবাতিও তো বোধ হয় চিনবেন না। পিদিম জ্বালায়, চেরাগ জ্বালায়। এটা দিয়ে হারিকেন জ্বালাতে হবে। সেটাতে ফিরতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বে তেলের দাম বেড়ে যাচ্ছে, গ্যাসের অভাব আমাদের যতটুকু আছে, তা ব্যবহার করছি। নতুন করে সন্ধানের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যেটুকু পারি আমরা চালাচ্ছি। উন্নত দেশগুলোর মানুষের যে দুরবস্থা, সেখানকার মানুষ সব থেকে কষ্ট পাচ্ছে। আমাদের দেশেও সেভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। এখন থেকে সবাই প্রস্তুত হন চেরাগ জ্বালিয়ে চলতে হবে। হাঁড়িতে কাঠখড়ি পুড়িয়ে রান্না করতে হবে।’
(বাংলা ট্রিবিউন, ৬ অক্টোবর ২০২২)
মাত্র কিছুদিন আগে আমরা শতভাগ বিদ্যুতের দেশ হওয়ার সাফল্য উদ্যাপন করেছি। জেলায় জেলায় কনসার্ট হয়েছে। জেমসের কনসার্টে দারুণ ভিড়ও হয়। তিনি যখন গান ধরেন, ‘পাগলা হাওয়ার তোড়ে মাটির পিদিম নিভু নিভু করে’, তখন এক লাখ দর্শক চিৎকার করে ওঠে, ‘ওরে ওরে হাওয়া থাম না রে, বন্ধু আসছে বহুদিন পরে...’
রেড়ির প্রদীপের কথা এই প্রজন্মের কেউ তো কিছু জানবেই না, আমরাও কখনো রেড়ির প্রদীপ দেখিনি। তবে শরৎচন্দ্রের লেখায় পড়েছি: ‘সে দিনটা আমার খুব মনে পড়ে। সারা দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত হইয়াও শেষ হয় নাই। শ্রাবণের সমস্ত আকাশটা ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হইয়া আছে এবং সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইতে না হইতেই চারিদিক গাঢ় অন্ধকারে ছাইয়া গিয়াছে। সকাল সকাল খাইয়া লইয়া আমরা কয় ভাই নিত্য প্রথামতো বাইরে বৈঠকখানার ঢালা-বিছানার উপর রেড়ির তেলের সেজ জ্বালাইয়া বই খুলিয়া বসিয়া গিয়াছি।’ এটা ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের অংশ, কিন্তু আমাদের বাংলা বইয়ে এই অংশ একটা গল্প হিসেবে পাঠ্য করে দেওয়া হয়েছিল।
এখন, যখন, ঢাকায় দিনে পাঁচ ঘণ্টা লোডশেডিং, গ্রামে কখন ‘কারেন্ট’ আসবে, তার ঠিকঠিকানা নেই অবস্থা, তখন রেড়ি বিষয়ে জ্ঞানার্জন কেবল আবশ্যক নয়, বাধ্যতামূলক। দেখা যাচ্ছে, রেড়ি, ভেন্না এবং ভেরেণ্ডা একই জিনিস।
উইকিপিডিয়া বলছে: ভেন্না বা রেড়ি, রেড়ী (বৈজ্ঞানিক নাম: Ricinus communis) বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। অন্য নাম ভেরেণ্ডা। সংস্কৃতে নাম বলা হয় এরণ্ড। ইংরেজিতে এই গাছকে castor bean অথবা castor oil plant বলে।
ভেন্নাগাছ ১০ থেকে ১৫ ফুট উঁচু হতে পারে। এরা প্রায় ডালপালাহীন গাছ, ওপরের দিকে অল্প কয়েকটি ডাল হতে দেখা যায়। গাছের কাণ্ডের ভেতরটা ফাঁপা থাকে। এদের কাণ্ডের বেড় পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি হয়ে থাকে। কাণ্ডে পাঁচ থেকে ছয় ইঞ্চি দূরে দূরে একটি গিঁট থাকে। প্রতিটা গিট থেকে একটা পাতা বের হয়।
সাধারণত বর্ষাকালে ভেন্নার চারা গজায়। প্রতিবছর হেমন্ত ও শীতকালে ভেন্নার ফুল-ফল হয়। সবুজ ফলের গায়ে নরম নরম কাঁটা থাকে। কাঁটা এতই নরম হয়ে থাকে যে গায়ে ফোটে না।
ও! এটাই ক্যাস্টর ওয়েল। এটা তো চুলে দিলে চুল পড়া কমে বলে শুনেছি। এ ছাড়া এর অনেক উপকারিতাও আছে। সেসব বলে এটার সংকট বাড়াতে চাই না। আমাদের ভেরেণ্ডাগুলো রেখে দিতে হবে, ভেরেণ্ডা ভাজা চলবে না। এটা দিয়ে আমরা তেল বানাব। তারপর প্রদীপ জ্বালাব।
আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কী দিয়ে হবে জানি না, তবে বলতে পারি, চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হবে বাঁশের লাঠি আর পাথর দিয়ে।’
আমাদের শতভাগ বিদ্যুতের দেশে নিকট ভবিষ্যতে কী হবে, আমরা জানি না; তবে প্রধানমন্ত্রীর সাবধানবাণী হলো, ভবিষ্যতে আমাদের রেড়ির তেলের সেজ জ্বালাতে হবে। কাঠের লাকড়ি ব্যবহার করতে হতে পারে চুলা জ্বালানোর জন্য।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকই ভেবেছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি থামবে না। কারণ, অস্ত্রবিক্রেতা দেশগুলো এই যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে চাইবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আশা নেই। আশা হলো, সামনের বছর নির্বাচন। নির্বাচনের আগে খাদ্য, বিদ্যুৎ, সার, নিত্যপণ্যের দামের ব্যাপারে জনচিত্ত তুষ্ট সরকারকে করতেই হবে। এখানেই আসবে অমর্ত্য সেনের সেই কথা—যে দেশে গণতন্ত্র আছে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।
১২ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী আরেকটা বিষয়ে আমাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশে যেন কোনো দিনও দুর্ভিক্ষ না হয়। তিনি যথার্থই বলেছেন, ‘আমাদের মাটি ও মানুষ আছে। এখন থেকেই আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশ যাতে কখনো দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসংকটে না পড়ে, সে জন্য আমরা খাদ্যের উৎপাদন বাড়াব।’ প্রধানমন্ত্রী সজাগ আছেন, তিনি সবাইকে সক্রিয় হতে আহ্বান জানিয়েছেন। বলেছেন, ‘পণ্যের দাম যেমন বেড়েছে, পরিবহন খরচও অতিরিক্ত বেড়েছে। তারপরও কৃষকদের ভর্তুকি দেওয়া আমরা অব্যাহত রেখেছি। কারণ, দেশের মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ করতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’ (বাসস সূত্র প্রথম আলো, ১৩ অক্টোবর, ২০২২)।
আমাদের দেশে আর কোনো দিনও দুর্ভিক্ষ হবে না। এটা হতে দেবে না আমাদের পরিশ্রমী কৃষক, শ্রমিক, বেসরকারি উদ্যোক্তা এবং অবশ্যই সরকারের নীতি ও পদক্ষেপ। বিদেশ থেকে আগত একজন ইউটিউবার বাংলাদেশের মাছের রেসিপি দেখাতে চলে গিয়েছিলেন ময়মনসিংহে। সেখানে একজন পোনা উৎপাদনকারীর সঙ্গে তিনি উঠেছিলেন ট্রেনের ছাদে। ওই পোনা উৎপাদনকারী একটা হাঁড়িতে মাছের পোনা নিয়ে সারাক্ষণ হাত দিয়ে পানি নাড়ছিলেন। ট্রেনের ছাদ থেকে নেমে তিনি চললেন গ্রামের হাটে, যেখানে পোনা বিক্রি হয়। তিনি চলছেন আর পানি নাড়ছেন। এত পরিশ্রম যে দেশের মানুষ করতে পারে, সেই দেশে দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যসংকট হতে পারে না।
তবে বাস্তব সমস্যা তো আছেই। জ্বালানি তেলের সংকট। বিদ্যুতের সংকট। দেশে অনাবৃষ্টি চলছে। খেতে সেচ দিতে হবে। পাম্প চলবে কী দিয়ে? দেশে গ্যাস–সংকট। তা থেকে আসছে সারসংকট। ডলার সংকটের কারণে সার আমদানিও কঠিন। এর মধ্যে আছেন মুনাফালোভী সরবরাহকারী এবং কার্যাদেশদাতাদের মধ্যের দুর্নীতিবাজেরা। মুনাফার লোভ এবং উৎকোচ সারের দাম বাড়াবে।
প্রধানমন্ত্রী ঠিকই ভেবেছেন যে ইউক্রেন যুদ্ধ তাড়াতাড়ি থামবে না। কারণ, অস্ত্রবিক্রেতা দেশগুলো এই যুদ্ধ টিকিয়ে রাখতে চাইবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আশা নেই। আশা হলো, সামনের বছর নির্বাচন। নির্বাচনের আগে খাদ্য, বিদ্যুৎ, সার, নিত্যপণ্যের দামের ব্যাপারে জনচিত্ত তুষ্ট সরকারকে করতেই হবে। এখানেই আসবে অমর্ত্য সেনের সেই কথা—যে দেশে গণতন্ত্র আছে এবং সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা আছে, সে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে না।
অবশ্য ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে অমর্ত্য সেনের নোবেলজয়ী তত্ত্ব নানা সমালোচনা এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। প্রচলিত তত্ত্ব হলো, এফএডি, ফুড অ্যাভেইলেবিলিটি ডিক্লাইন বা খাদ্যের অপর্যাপ্ততাই দুর্ভিক্ষের কারণ। অমর্ত্য সেন বলেছেন, ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন কমেনি। তাহলে দুর্ভিক্ষ হলো কেন? পরবর্তীকালে অনেক গবেষক এই মতবাদকে চ্যালেঞ্জ করেছেন, বলেছেন, অমর্ত্য সেন নির্ভরযোগ্য উপাত্ত ব্যবহার করতে পারেননি। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে খাদ্যের অপর্যাপ্ততা ছিল।
দেশে খাদ্যের সংকট যাতে না হয়, সে জন্য সবাইকে উৎপাদন বাড়াতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। কৃষক–শ্রমিক উদ্যোক্তারা তো শেষ রক্তবিন্দু ঢেলে দিয়েই উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। সরকারের নীতি নিশ্চয়ই কৃষিবান্ধবই হবে। কিন্তু তেলও নেই, বিদ্যুৎও নেই, এই অবস্থা যদি সত্যি সত্যি আসে, তাহলে সেচ দেওয়া হবে কী করে? সার আসবে কোত্থেকে? কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যাবে কী করে? দুই নম্বর হলো, লাভের গুড় পিঁপড়ায় যেন না খায়। সাধারণ মানুষ কষ্ট করে উৎপাদন করবে আর রাঘববোয়ালেরা সব ডলার পাচার করে দেবে দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, পানামা, ক্যারিবিয়ান দেশগুলোয়! এই পাচার রোধ করতে দরকার স্বাধীন সংবাদমাধ্যম, স্বাধীন বিচার বিভাগ এবং সুশাসন। আইনের শাসন। অর্থাৎ গণতন্ত্র।
সামনের বছরের নির্বাচনটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় ভরসা। দেখা যাচ্ছে, ভাঙাচোরা হলেও গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের বিকল্প হলো আরও গণতন্ত্র, যথাসম্ভব প্রকৃত গণতন্ত্র।
আনিসুল হক সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক