১৯৭৩ সালের ২১ অক্টোবর। ইয়োম কিপ্পুর যুদ্ধ চলছে। হেনরি কিসিঞ্জার মস্কো গেলেন। তাঁর সেই সফরের কথা আমার খুব ভালো করে মনে আছে। তার কারণ হলো, সে সময়ে মস্কোয় যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স অডলফ ডাবসের সঙ্গে আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মস্কো নেমেই কিসিঞ্জার সরাসরি ক্রেমলিন চলে যান।
ক্রেমলিনে সেই বৈঠকে ডাবসকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বৈঠক সম্পর্কে তাঁকে জানানোও হয়নি। ডাবস পরে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে তাঁকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছিল। কিসিঞ্জারের সেই মিশন ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসরকে সামরিক সমর্থন যাতে না দেয়, সে জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কথা বলা। ওয়াশিংটনের শঙ্কা শঙ্কিত ছিল যে সিনাই উপত্যকায় রাশিয়া ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে।
কয়েক দিন পর সোভিয়েতের একটি বাণিজ্যিক বিমানে করে আমি কিয়েভে যায়। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমি বিমান থেকে নামার পর রাশানরা আমাদের জন্য একটা সামরিক মহড়ার আয়োজন করে। বিমানটি টার্মিনাল থেকে কিছুটা দূরে অবতরণ করেছিল। সামরিক মহড়া দেখিয়ে রাশানরা আমাদের দেখাতে চেয়েছিল, সোভিয়েত ইউনিয়ন সামরিক হস্তক্ষেপ করতে প্রস্তুত। আমি খুব দ্রুত এ বিষয়টি কিয়েভে আমেরিকান কনস্যুলেটকে জানিয়েছিলাম।
২৪ অক্টোবর সুয়েজ খালের পশ্চিম দিকে মিসরের সেনাবাহিনীকে ইসরায়েল চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। কায়রো থেকে মাত্র ১০০ কিলোমিটার দূরে ছিল এই রণক্ষেত্র। খবরটি আমি শুনেছিলাম আমার কাছে থাকা পকেট সাইজের একটি রেডিওর শর্টওয়েভে শোনা ভয়েস অব আমেরিকার খবরে।
গাজার ওপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ হটিয়ে দিতে ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলে এই অভিযানকে কত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হলো, হামাসের কাছে জিম্মি তাদের দেশের অন্তত ৪০ জন নাগরিককে মুক্ত করা। ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করে তাহলে জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। কিন্তু ইরানের এই দাবিতে হামাসের সায় আছে, তেমন নজির দেখা যাচ্ছে না।
২৫ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় মিত্ররা ওই অঞ্চলে বিমানবাহিনী এবং ষষ্ঠ নৌবহর মোতায়েন করে। ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত কিসিঞ্জার শাটল কূটনীতি বা ঝটিকা কূটনৈতিক তৎপরতা চালান। এর ফলে সংঘাতের অবসান হলো।
৫০ বছর আগের সেই যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন আসতেই পারে, চলমান গাজা যুদ্ধে পরাশক্তিগুলো সত্যি সত্যি সম্পৃক্ত হবে কি না? যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন দুজনেই এরই মধ্যে ইসরায়েল গেছেন। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ সপ্তাহে ইসরায়েলে যাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে অঞ্চলটির কোনো যুদ্ধ ও সংঘাতে আমেরিকার কোনো প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল সফরে যাননি।
রাশিয়া এরই মধ্যে অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানিয়েছে। চীনও একই আহ্বান জানিয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের বিমানবাহী রণতরি (ইউএসএস ফোর্ড) মোতায়েন করেছে। আরেকটি রণতরি (ইউএসএস আইজেনহাওয়ার) পথে রয়েছে। ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিমানবাহিনীর শক্তিও বাড়াচ্ছে।
জর্ডান, সিরিয়া ও ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে সক্ষমতা রয়েছে তাদের। বিশ্বস্ত সূত্রের খবরে জানা যাচ্ছে, হিজবুল্লাহর দিক থেকে কিছু রকেট হামলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বুঝিয়ে–শুনিয়ে হিজবুল্লাহর ওপর আক্রমণ করা থেকে বিরত রেখেছে। হিজবুল্লাহর আক্রমণ থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এখানে একটা গুরুতর সমস্যা হচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বিবাদ চলছে। ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না। পারমাণবিক শক্তিধর দুই বড় শক্তির মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ থাকায় বড় পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আগে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি শান্ত করতে একসঙ্গে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিশেষ করে এটা রাশিয়ার জন্য দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। কেননা, সিরিয়াতে রাশিয়ার নৌ ও বিমানঘাঁটি রয়েছে। যুদ্ধ যদি ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সিরিয়া কি একটা যুদ্ধক্ষেত্র হবে না? এরই মধ্যে ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পোর বিমানবন্দরের রানওয়েতে বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল মনে করে, তাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এবং সরকারি স্থাপনাকে লক্ষ্য করে হামলা চালানোর জন্য ইরান হিজবুল্লাহর মাধ্যমে সিরিয়ায় তাদের অনুগতদের কাছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার চেষ্টা করছে।
ইসরায়েল চায় হামাসকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে। তারা এ জন্য স্থল অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এর আগে হামাসের কাছে থাকা জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা করছে তারা।
গাজার ওপর হামাসের নিয়ন্ত্রণ হটিয়ে দিতে ইসরায়েলকে পৃষ্ঠপোষকতা করছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলে এই অভিযানকে কত দিন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাবে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার হলো, হামাসের কাছে জিম্মি তাদের দেশের অন্তত ৪০ জন নাগরিককে মুক্ত করা। ইরান বলেছে, ইসরায়েল যদি গাজায় বোমা হামলা বন্ধ করে তাহলে জিম্মিদের মুক্তি দেবে হামাস। কিন্তু ইরানের এই দাবিতে হামাসের সায় আছে, তেমন নজির দেখা যাচ্ছে না।
ইসরায়েল যদি গাজায় একটা স্থল অভিযান শুরু করে, তাহলে তারা কীভাবে জিম্মি–সংকট সমাধান করবে, সেটা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব। কিন্তু ১৯৭৩ সালের মতো এবার বড় কোনো শক্তি হামাসের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার সম্ভাবনা দেখছি না। মিসর সাধারণ গাজাবাসীর জন্য মানবিক সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার জন্য করিডর যাতে খুলে দেওয়া হয়, সেই চেষ্টা করছে।
ইরান যদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে আঘাত করার অজুহাত পাবে ইসরায়েল। লেবাননে হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবেই চাপ আছে। একটা যুদ্ধে জড়ালে নড়বড়ে রাষ্ট্র লেবাননের চূড়ান্ত পতনের শঙ্কা আছে।
বড় পরিসরে যুদ্ধ হবে কি হবে না, সেটা অনুমান করা এখন কঠিন। রাশিয়া এখন ইরানিদের শান্ত থাকার কথা বলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বলতে পারে তোমরা শুধু গাজার সমস্যার দিকেই মনোযোগ দাও। কিন্তু দেখা আর অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্ক টাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত