মতামত

এবার ফিলিস্তিনি প্রেমের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ!

ইসরায়েল ফিলিস্তিনেদের বিয়ে এমনকি প্রেমেও হস্তক্ষেপ করছে। এক ঘোষণায় ইসরায়েল বলেছে, বিদেশিদের কেউ ফিলিস্তিনি নাগরিকের প্রেমে পড়লে অবশ্যই তা ইসরায়েলকে জানাতে হবে।
ছবি: এএফপি

ইসরায়েল যুদ্ধ করতে ভালোবাসে। এমনকি প্রেমের মতো মানবিক অনুভূতির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করতে তাদের অনীহা নেই। ইসরায়েল শান্তিও ভালোবাসে; তবে কিনা সেটি শুধু ফিলিস্তিনিদের মৌলিক অধিকারের বিকানোর মাধ্যমে।
ফিলিস্তিনিদের রোমান্সের ওপর ইসরায়েলের সর্বশেষ উদ্ভট আক্রমণ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসুন সংক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধের সঙ্গে এই দেশের মর্মান্তিক সম্পর্কের কথা বলি, কারণ এত অল্প সময়ের মধ্যে এতসংখ্যক যুদ্ধ দুনিয়ার আর কোনো দেশ করেনি। অবশ্য আর একটি মাত্র দেশ হয়তো করে থাকতে পারে; সেটি যুক্তরাষ্ট্র।

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল নামক রাষ্ট্র গঠনের পর থেকে ইসরায়েল প্রথাগত যুদ্ধ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ যুদ্ধ, বিদ্রোহবিরোধী যুদ্ধ, হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা যুদ্ধ—এই সব ধরনের যুদ্ধ মিলিয়ে এক ডজনের বেশি যুদ্ধ করেছে। তারা আরব শহরগুলোতে বোমা হামলা চালিয়েছে ও আরব ভূখণ্ডকে অবরুদ্ধ করেছে। যে দেশগুলো ইসরায়েলকে নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেছে বলে ইসরায়েলের মনে হয়েছে, তাদের নিশ্চিহ্ন করতে তারা এমনকি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিয়েছে।

এগুলোর বেশির ভাগই ছিল ইসরায়েলের পছন্দের যুদ্ধ, যা ইসরায়েল তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার চিরস্থায়ী সংঘাতের অংশ হিসেবে দেখতে শুরু করেছিল। নিজের কৌশলগত নীতি অনুসারে ইসরায়েলকে তার নিজের মানদণ্ডে নির্ধারণ করা শান্তি অর্জনের জন্য লাগাতার যুদ্ধ করতে হবে।

ইসরায়েল দর্শনগত জায়গা থেকে মনে করে, শান্তি নয় বরং যুদ্ধই ভূখণ্ডটির দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। এই যুদ্ধপ্রেমী যুক্তিকে সমর্থন করে ইসরায়েলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গুরিয়ন একবার অকপটে বলেছিলেন, সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিকদের (ইসরায়েলিদের) সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার জন্য যদি একজন আরব নেতাকে ১০ লাখ পাউন্ডও দেওয়া হয়, তাহলে সেটিও সার্থক হবে। তাঁর শীর্ষ জেনারেল মোশে দায়ানও মার্কিন সমর্থন ছাড়াই ইসরায়েলের বিজয় সম্পূর্ণ করার জন্য যুদ্ধের ব্যাপারে ভয়ানক উত্সাহী ছিলেন। তখন থেকেই ইসরায়েল দিন দিন যত শক্তিশালী হয়েছে, যুদ্ধ তার কাছে ততই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

যুদ্ধের প্রতি ইসরায়েলের ঝোঁক থাকা কৌশলগত দিক বিবেচনায় হয়তো তার দিক থেকে যুক্তিসংগত। ঔপনিবেশিক সত্তা হিসেবে ইসরায়েল যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীন হতে পারত না। যুদ্ধ তার শত্রুদের দুর্বল করতে এবং তার সব প্রতিবেশীর ওপর তার সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যবহৃত হয়েছে। এর বাইরে ইসরায়েলের যুদ্ধগুলো তার সীমানা প্রসারিত করতে এবং নতুন অঞ্চলগুলোতে দখলদারি প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেছিল।

ইসরায়েলের কাছে যুদ্ধের বিশেষ অর্থও রয়েছে। ইসরায়েলিরা তাদের সামরিক বাহিনীকে ভালোবাসে, কারণ এই বাহিনী তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, নতুন একটি জাতি গঠন করেছে। কয়েক দশক ধরে সামরিক বাহিনী বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতি থেকে আগত ইহুদি অভিবাসীদের মধ্যে একটি নতুন লড়াইয়ের চেতনা এবং জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তুলে তাদের যথার্থ ‘ইসরায়েলি’ হিসেবে গড়ে তুলেছে। সামরিক বাহিনী প্রত্যেক ইসরায়েলি যুবককে ঔপনিবেশিক প্রকল্পে অংশীজন হিসেবে গড়ে তুলেছে।

ইসরায়েল নিশ্চিত করছে, ফিলিস্তিনে একজন ফিলিস্তিনির প্রেমে পড়াটা যেকোনো বিদেশির জন্য জাহান্নামে পড়ার নামান্তর হবে। প্রকৃতপক্ষে এই নির্দেশের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের জীবনকে বিচ্ছিন্ন করা, জটিল করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। এটি ঘৃণ্য এবং এটি ধ্বংসাত্মক

তবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ শুধু সামরিক ফ্রন্টেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ইসরায়েল তার সহিংস দখলদারির অংশ হিসেবে ফিলিস্তিনি সংস্কৃতি, ভূমি নকশা, পরিবেশ, জনসংখ্যা, সুশীল সমাজ এবং ধর্মের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালিয়েছে।
সম্প্রতি ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখল করা এলাকায় ‘বেন অ্যান্ড জেরি’ নামক একটি মার্কিন আইসক্রিম কোম্পানি তাদের আইসক্রিম বিক্রি করবে না বলে ঘোষণা দেওয়ার পর ইসরায়েল ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে উদ্ভট এক যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। এ নিয়ে আমি লিখেছিলাম। আজ ফিলিস্তিনি জীবনের আরেকটি দিক: মানব-মানবীর প্রেমের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের দুঃখজনক আক্রমণের কথা বলব।

৪ সেপ্টেম্বর দখল করা ফিলিস্তিনি অঞ্চলে বিদেশিদের প্রবেশের বিষয়ে ইসরায়েলের সর্বশেষ নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই নির্দেশিকার শিরোনাম ছিল, ‘জুদাইয়া ও সামারিয়া এলাকায় বিদেশিদের প্রবেশ এবং বসবাসের পদ্ধতি’। শুধু জুদাইয়া ও সামারিয়া? এমনকি ‘শাসিত ফিলিস্তিনি অঞ্চল’ বা ‘স্বায়ত্তশাসিত ফিলিস্তিনি এলাকা’ বা ‘অধিকৃত প্যালেস্টাইন’—কিছুই ওই এলাকা দুটির নামের আগে বসানো হয়নি। ওই নির্দেশিকায় নানা ধরনের নির্দেশনা রাখা হয়েছে।

তবে সবচেয়ে আপত্তিকর অংশটি একজন বিদেশি এবং একজন ফিলিস্তিনির মধ্যকার প্রেমের সম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কিত। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বিদেশিরা যদি অধিকৃত পশ্চিম তীরের কোনো ফিলিস্তিনির প্রেমে পড়ে, তাহলে অবশ্যই সে কথা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে।’ নির্দেশের একটি পূর্ববর্তী খসড়ায় রোমান্স শুরু হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা ছিল, তবে সম্ভবত আন্তর্জাতিক মিডিয়া এ নিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের পরে তা বাদ দেওয়া হয়েছিল।

তবু আমি ভাবছি, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ঠিক কাকে অবহিত করতে হবে এবং কীভাবে তা ই–মেইল করে একটি গোলাপি চিঠিতে বলতে হবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। শুধু তা–ই নয়, বিদেশিদের যদি ভিসার আগে এমন কোনো আবেগপূর্ণ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তাদের ভিসার আবেদনে তা বলতে হবে। উদ্দেশ্য হিসেবে পয়েন্ট উল্লেখ করা থাকবে: পর্যটন? না। ব্যবসা? না। পড়াশোনা? না। রোমান্স? হ্যাঁ!

ইসরায়েল নিশ্চিত করছে, ফিলিস্তিনে একজন ফিলিস্তিনির প্রেমে পড়াটা যেকোনো বিদেশির জন্য জাহান্নামে পড়ার নামান্তর হবে। প্রকৃতপক্ষে এই নির্দেশের একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিনিদের জীবনকে বিচ্ছিন্ন করা, জটিল করা এবং নিয়ন্ত্রণ করা। এটি ঘৃণ্য এবং এটি ধ্বংসাত্মক।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারওয়ান বিশারা মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশ্লেষক ও লেখক