দেশ এখন যে সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, সেখানেও শিশুরা চরম অসহায় বন্দিজীবনের ফাঁদে পড়ে হাঁসফাঁস করছে। অবরুদ্ধ জীবন কাটাচ্ছে। যে শিশু উড়োজাহাজ–হেলিকপ্টারের আওয়াজ শুনলে ছুটে ছাদে উঠে যেত বা খোলা জায়গায় গিয়ে আকাশের দিকে তাকত, সে এখন ঘরের কোনায় সিটিয়ে থাকছে ভয়ে। তার আকাশ ছোট হতে হতে নাই হয়ে যাচ্ছে। সে এখন বন্ধুদের থেকেও বিচ্ছিন্ন, স্কুল নেই। সেই কোভিডের সময় থেকে ইন্টারনেটে অভ্যস্ত শিশুরা এখন আরও অনেক বিচ্ছিন্ন।
প্রমাণ মিলছে, অপ্রাপ্তবয়স্ক অনেককেই প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে জেলহাজতের নামে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষার্থীও আছে। ঘরে বসে শিশুরা সেসব দৃশ্য আর বাহাস দেখছে নানা চ্যানেলে। টিভিতে এ রকম এক বাহাস দেখতে দেখতে মাত্র ৯ বছরের শিশু কাজল আত্মা শুকিয়ে যাওয়া প্রশ্ন করল, ‘এই বুড়া দাদুটা (জেড আই খান পান্না) এদের না হয় ছাড়িয়ে নেবে, কিন্তু যারা স্কুলে পড়ে না, জন্মসনদ নেই, অভিভাবক নেই, রাস্তায় থাকে, তাদের ছাড়াবে কে?’ উত্তর আমার কাছে নেই। পাঠকদের কারও জানা থাকলে জানাতে পারেন। সুবিধাপ্রাপ্ত শিশু কাজল সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে যেভাবে উদ্বিগ্ন, তাতে অনেক আশার আলো থাকলেও বড়দের ব্যর্থতার ছাপ খুব স্পষ্ট।
শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য শিশুদের কারাগারে না রাখাটা এক অবশ্যপালনীয় শর্ত। সালটা ২০০২ হবে, উগান্ডায় বসেছিল শিশু সুরক্ষার এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আইনের মুখোমুখি হওয়া শিশুদের সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে উগান্ডার অনেক নামডাক তখন। উন্নয়নশীল দেশগুলোর কারাগারে কারাগারে যখন শিশু বন্দীতে পিল পিল করছে, তখন একমাত্র শিশুশূন্য কারাগার ছিল উগান্ডায়। শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করা অনেক দেশের কাছে সেটা তখন বেশ আশ্চর্যের। কারাগারগুলো শিশুশূন্য করার জন্য জাতিসংঘের চাপ ক্রমে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। প্রথম দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন উগান্ডার তখনকার প্রধান বিচারপতি। তাঁর আনুষ্ঠানিক বক্তৃতার মধ্যে তিনি বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করলেন বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে। আমাদের প্রথম পার্লামেন্টে পাস হওয়া শিশু অধিকার আইনের প্রশংসা করলেন। বঙ্গবন্ধুকেও মনে করলেন। বললেন, ‘আমরা তাঁর করা আইনটাই হুবহু নকল করছি।’ জাতিসংঘের শিশু অধিকার আইন বলবৎ হওয়ার ১৮ বছর আগে বাংলাদেশ শিশু সুরক্ষা আইন তৈরি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
নানা কসরত করে প্রতিষ্ঠান বানিয়ে বাংলাদেশে শিশুদের বড়দের জন্য নির্ধারিত জেলখানা থেকে আলাদা করা সম্ভব হলেও শিশুদের মুক্তি আসেনি। নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র বললেও সেগুলো ক্রমে ভয়ানক কারাগারেই পরিণত হয়েছে। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেপ্তার কিশোরদের যাদের অভিভাবকেরা জন্মসনদ নিয়ে উকিল–মোক্তার–প্রেস ধরে আদালতে কান্নাকাটি করতে পেরেছেন, তাঁদের হয়তো বড়দের জেলে আর ফিরতে হবে না। কিন্তু যে ৩৪ লাখ পথশিশু স্কুলে যায় না, রাস্তায় থাকে, সেখানেই যাদের রুটিরুজি, তাদের কী হবে?
অপ্রাপ্তবয়স্কদের শুধু জেলে পাঠানো হচ্ছে, তা–ই নয়, বিধান লঙ্ঘন করে তাদের মাজায় দড়ি ও হাতে হাতকড়া পরানো হচ্ছে। এটাও আমাদের ১৯৭৪ সালের শিশু আইন (সংশোধিত ২০১৩) অনুমোদন করে না। বড়দের জেল থেকে শিশুদের জন্য নির্ধারিত বন্দিখানায় পাঠানোই কি একমাত্র বিকল্প? আমাদের আইনগুলোয় সন্দেহভাজন বা অভিযুক্ত শিশুকে থানা থেকেই সমাজসেবা দপ্তরে কর্মরত প্রবেশন কর্মকর্তার হাওলায় দেওয়ার প্রবিধান আছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৭০ জন প্রবেশন কর্মকর্তা (৬৪টি জেলা ও ৬টি সিএমএম কোর্ট) আছেন। আর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাদের (৪৯২ জন) প্রবেশন কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনের অধিকার দেওয়া আছে। শিশু আইনের ৪৮ ধারায় শিশুদের ‘অপরাধের’ জন্য তাদের কারাগারে না পাঠিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুযোগ আছে। এ আইনের ৩৭ ধারায় অভিযুক্ত শিশু ও অভিযোগকারী পক্ষের সঙ্গে আলোচনার সুযোগ রয়েছে প্রবেশন কর্মকর্তার।
আইনের প্রবিধান ছাড়াও গত ২৩ জানুয়ারি বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রবেশনের প্রবিধান ব্যবহারের জন্য নিম্ন আদালতকে নতুন করে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। অপ্রাপ্তবয়স্কদের বিষয়গুলো আলোচিত হওয়ার পর আটক শিশু–কিশোরদের শিশুদের জন্য নির্ধারিত আটককেন্দ্রগুলোয় পাঠানোর হিড়িক পড়ে যেতে পারে। তাদের সবার ক্ষেত্রেই খুব সহজেই প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সুনামগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জাকির হোসেন ২০২০ সালের ১৪ অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৯৬টি মামলায় ২৬৮ শিশু-কিশোরকে বাড়িতে থেকে সংশোধনের সুযোগ দিয়েছিলেন। রাজশাহীর নিম্ন আদালতেও একই রকম নজির আছে।
দেশের চলমান পরিস্থিতিতে হঠাৎই শিশুরা এক দুঃসহ সময়ের মুখোমুখি হয়েছে। নানাভাবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুদের স্কুল বন্ধ, বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না, বাড়িতে, টিভিতে চলমান সহিংসতা বিষয়ে আলোচনা ইত্যাদি শিশুদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে, হারাচ্ছে শৈশব। শিশুদের শৈশব হারানোর ঝুঁকি ঠিকানা হারানোর ঝুঁকির চেয়েও ভয়াবহ। শিশুদের আকাশটা খোলা রাখুন।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
nayeem 5508 @gmail.com