একটি সভ্য সমাজে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে তার প্রতিকার পাওয়া যায়। আমাদের এখানে এমন অনেক ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটে, যার কোনো প্রতিকার সহজে পাওয়া যায় না। প্রতিকারের অভাবে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রীয়, প্রতিটি পর্যায়ে অস্বাভাবিকতাকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। জাতি হিসেবে আমাদের অর্জন ও সাফল্য কম নয়। কিন্তু ভয় হয়, উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে তাড়া করতে গিয়ে আমাদের মানবিক দিকগুলো ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে কি না? নাকি মানুষ প্রতিকার না পেয়ে বিচারহীনতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বসবাস করার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে।
১৫ আগস্ট উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি লেন-৩) প্রকল্পের একটি ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে পাঁচজন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। কম সক্ষমতার ক্রেন গার্ডারের ভর সামলাতে পারেনি। গার্ডারটি পড়ে গেল একটি প্রাইভেট কারের ওপর। সে সময় আশপাশে কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনীই ছিল না। সংগত কারণে অনেক প্রশ্ন সামনে চলে আসে। নির্মাণকাজে নিরাপত্তাব্যবস্থা কেমন ছিল, যানবাহন চলাচলের বিকল্প ব্যবস্থা ছিল কি না, ঠিকাদারের ব্যবহৃত ক্রেনসহ যন্ত্রপাতির মান কাজের উপযুক্ত ছিল কি না, বাস্তবায়নকারী সংস্থার তদারকি ব্যবস্থা বা কী ছিল ইত্যাদি। মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি কতখানি মূল্য পাচ্ছে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে?
৪ বছরের প্রকল্প ১০ বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সময় ও বাজেট—দুটিই দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, যানজট, দূষণ ও জনদুর্ভোগ আমাদের বাড়তি পাওনা। গত ১০ বছরে যাঁরা এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুরের রাস্তা ব্যবহার করেছেন, তাঁরাই জানেন, একটা প্রকল্প কতটা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলতে পারে। আমি উত্তরায় থাকি, এ প্রকল্পের যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়েছে।
বিআরটি লাইনের নির্মাণ চলাকালে গার্ডারধসে এটিই প্রথম দুর্ঘটনা নয়; এর আগেও ঘটেছে। নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত বিআরটির উড়ালপথ তৈরিতে গার্ডারধসের এটি চতুর্থ দুর্ঘটনা। কিন্তু ভুল সংশোধনের উদ্যোগ কোথায়?
পরিবহন পরিকল্পনায়, বিআরটিকে এমন একটি গণপরিবহন ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা অপেক্ষাকৃত কম সময়ে, কম বাজেটে বেশি মানুষকে সেবা দিতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিআরটি নির্মাণে এমন নজির আছে। কিন্তু আমাদের বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের শুরু থেকেই নানা ঝামেলা ও সমালোচনা লেগেই আছে।
৪ বছরের প্রকল্প ১০ বছর ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সময় ও বাজেট—দুটিই দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা, যানজট, দূষণ ও জনদুর্ভোগ আমাদের বাড়তি পাওনা। গত ১০ বছরে যাঁরা এয়ারপোর্ট থেকে গাজীপুরের রাস্তা ব্যবহার করেছেন, তাঁরাই জানেন, একটা প্রকল্প কতটা অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে চলতে পারে। আমি উত্তরায় থাকি, এ প্রকল্পের যন্ত্রণা প্রতিনিয়ত ভোগ করতে হয়েছে।
দেশে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রকল্প হচ্ছে। এটা আশা করা যায়, সেখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে কাজ করা হবে। চুক্তিবদ্ধ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে কাজ করছে। বিভিন্ন দেশে যখন তারা কাজ করে, তখন শতভাগ সেফটি প্রটোকল মেনে কাজ করে। অথচ বাংলাদেশে এলেই কেন তারা নানা ধরনের অজুহাত আর নজিরবিহীন অবহেলা দেখায়?
এলোমেলোভাবে ফেলে রাখা, নিরাপত্তারবেষ্টনীসহ কমপ্লায়েন্স না মেনে কাজ করা, ফুটপাতগুলো ভেঙে ফেলা, রাস্তায় পথচারীদের জন্য বিকল্প কোনো ধরনের ব্যবস্থা না রাখা, নির্মাণ জোন ও যানবাহন চলাচলের রাস্তাকে নিরাপদভাবে আলাদা করতে না পারা, অব্যাহতভাবে ধুলা দূষণ ইত্যাদি এ প্রকল্পের অনুষঙ্গ হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত তদারকির অভাব ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে শর্ত না মানাতে পারাই প্রধান সমস্যা।
যেকোনো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই সম্ভাব্যতা যাচাই সমীক্ষা করা হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা থাকে। বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো সে অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাজকে পরিচালনা করা, তদারকি করা এবং শর্ত অনুযায়ী কাজ করতে বাধ্য করা। সর্বশেষ ঘটনা প্রমাণ করে, বাস্তবায়নকারী সংস্থা পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তার প্রমাণ মেলে প্রকল্প পরিচালকের বক্তব্য থেকে। তিনি তাঁর অসহায়ত্বের কথা বলেছেন এবং মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে বলেছেন, ‘আসলে ঠিকাদারদের কাছ থেকে আমরা এই খামখেয়ালিপনা পাচ্ছি। কোনোভাবেই আমরা তাদের কমপ্লায়েন্সে আনতে পারছি না।’
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের একটি চুক্তিপত্র থাকে, সেখানে নিরাপত্তা ও সড়কব্যবস্থার শর্ত কী ছিল, শর্ত না পালন করলে কী ধরনের শাস্তির বিধান আছে—এ বিষয়গুলো জানা দরকার।
বলা হচ্ছে, ১৫ আগস্ট বন্ধের দিন ছিল, ঠিকাদার অনুমতি না নিয়ে কাজ করছিল। প্রশ্ন হলো, এ ধরনের যন্ত্রপাতি নিয়ে একই ব্যবস্থাপনায় অন্যদিন কাজ করলেও কি একই ফলাফল হতো না? ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তো মানসম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে না, নিরাপত্তা প্রটোকল মেনে কাজ করে না।
উত্তরায় বসবাস করার কারণে আরেকটি বিষয় খেয়াল করা সুযোগ ছিল; সেটি হলো মেট্রোরেলের কাজে নিরাপত্তার প্রটোকল অনুসরণ করা। শ্রমিকদের নিরাপত্তা গিয়ার ব্যবহার, নিরাপত্তাবেষ্টনী তৈরি করা, মানুষের যাতায়াতের বিকল্প ব্যবস্থা করা, সময় ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি। সব মিলে ভালো উদাহরণ এই শহরের অন্য প্রকল্পেই দেখা গেছে।
ঘটনার পরপরই বাস্তবায়নকারী নিজেরাই যদি তদন্ত করে, সেখানে এটা অবশ্যম্ভাবী যে তাদের নিজেদের দায়কে এড়িয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। বিভাগীয় প্রাথমিক প্রতিবেদনে দায় হিসেবে শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের গাফিলতি, অবহেলা, সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত হওয়া প্রয়োজন। বিআরটি ছাড়াও অনেক প্রকল্পে অযৌক্তিকভাবে সময় ও অর্থের ব্যয় বৃদ্ধি, অব্যবস্থাপনা লক্ষ করা যাচ্ছে। এসবের একটা স্থায়ী টেকসই সমাধান হওয়া প্রয়োজন।
নির্মাণকাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে দেশে আইন আছে। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, এমনকি বিআরটি আইন-২০১৬ আছে। প্রতিটি আইনে একটা নির্মাণ সাইটে কীভাবে নির্মাণসামগ্রী ব্যবস্থাপনা করা হবে, নির্মাণসামগ্রী স্থানান্তর করা যাবে, জননিরাপত্তার দিকগুলো কীভাবে রক্ষা করতে হবে, তার পরিষ্কার নির্দেশনা থাকে। অথচ একটা বিল্ডিং তৈরির সাইট থেকে শুরু করে বিআরটির মতো মেগা প্রকল্পে নিরাপত্তার বিষয়টি দারুণভাবে উপেক্ষিত হয়। নির্মাণসামগ্রী পড়ে পথচারীর মৃত্যু এখন আর গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়। প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় জনদুর্ভোগ আর নিরাপত্তা ইস্যু আমাদের গা সয়ে গেছে।
এখানে শঙ্কাহীন কোনো উৎসব নেই। নিরাপদে কোনো উৎসব শেষ করতে পারা যাবে কি না অনিশ্চিত। মুহূর্তেই উৎসব শোকে পরিণত হতে পারে। বিআরটি ট্র্যাজেডি নববিবাহিত দম্পতিকে এ কথা বারবার মনে করিয়ে দেবে। উৎসব উদ্যাপনের অবস্থা সমাজে নেই, এমন কোনো রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেই আমরা নেই। সদা শঙ্কা, সদা ভয়। তাই তো প্রিয়জনের জন্য আমাদের এত ‘শুভকামনা’, এত ‘প্রার্থনা’। এখানে শোকের আয়ুষ্কাল মাত্র ২৪ ঘণ্টা। কবরে সবুজ ঘাস গজানোর আগেই ঘটনাকে স্বাভাবিক করার অপতৎপরতা।
আকতার মাহমুদ নগর–পরিকল্পনাবিদ; শিক্ষক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)