আমাদের বাচ্চা খেতে চায় না আর ওরা খেতে পায় না

একটা জিজ্ঞাসা সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়: আমাদের শিশুরা কি স্কুলে যায় ভরা পেটে? নাকি পেটে খিদে নিয়ে?

বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হয়ে যাচ্ছে, আমরা মেট্রো চড়ে যাতায়াত করছি এবং ঝিনাইদহের গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে দেখে এসেছি, কৃষক-পরিবারগুলোরও উন্নতি; কৃষকবধূ, গ্রামের শ্রমিক আমাদের বলেছেন, আমরা ভালো আছি, আমাদের কোনো অভিযোগ নেই।

যেকোনো বিয়ের দাওয়াতে গেলে দেখতে পাই, খাওয়ার পদ বাড়ছে আর বাড়ছে। উন্নতি যে হচ্ছে, এটা তো খালি চোখেই দেখা যায়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে ঢাকার রাস্তাগুলো সব রেস্তোরাঁয় ছেয়ে যায়; একেকটা দশতলা ভবনে ২০টা করে আলোঝলমল রেস্তোরাঁ চলে আর তাতে খদ্দের গমগম করে!

এই অবস্থায় কুড়িগ্রামের দুর্গম চরে, পটুয়াখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী জনপদে, পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায়, শেরপুর ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোয় ছেলেমেয়েরা কি পেট ভরে খেতে পায়?

তারা স্কুলে যায় ভরা পেটে, নাকি খালি পেটে? ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদেরই বা কী অবস্থা?

শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য এই লেখা নয়। একেবারে মৌলিক প্রশ্ন, আমাদের শিশু-শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো খেতে পায় নাকি তারা আধাপেটা থাকে? পুষ্টিহীনতায় ভোগে?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাচ্ছে প্রথম আলোয় ১২ মার্চ ২০২৪ প্রকাশিত জহির রায়হানের ‘খালি পেট নিয়ে যে শিশুরা স্কুলে যায়’ শীর্ষক লেখায়। তিনি লিখেছেন: ‘৫ মার্চ বেলা একটা। রংপুর শহরতলির বড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাঈদ হোসেনের সঙ্গে কথা বলছি। এ সময় কয়েক ছাত্র প্রধান শিক্ষকের কক্ষের দিকে উঁকি দিল। একজন সহকারী শিক্ষক বললেন, “স্যার, বাচ্চারা খেয়ে আসেনি। বাড়ি যেতে চায়।”’

২০২৩ সালে নাজনীন আখতার গিয়েছিলেন ঢাকার অদূরের স্কুলে। ৮ জুন ২০২৩ প্রথম আলোয় তিনি লিখেছিলেন: ‘১৬, ১৭ ও ১৮ মে এ রকম পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক—তুরাগের বাউনিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাইলজুরী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, গুলশানের ছোলমাইদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কালাচাঁদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং শাহজাদপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কথা বলেছেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের সঙ্গে। তাতেই জানা গেল, শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ না খেয়ে ক্লাসে আসে।’

বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে বৈষম্য। শ্রেণিগত বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য। আমরা কোটিপতি উৎপাদনে রেকর্ড করেছি। বিদেশে অর্থ পাচারের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। যেকোনো দাওয়াতে দেখতে পাই, যত খাচ্ছি, তার চেয়েও বেশি নষ্ট করছি। অন্যদিকে আমাদের গ্রামগঞ্জে, বস্তিতে শিশুদের চোখে–মুখে পুষ্টিহীনতার ছাপ। আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্ষুধা পেটে নিয়ে স্কুলে আসছে। এটা হতে দেওয়া যায় না।

তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘পাঁচটি বিদ্যালয়ই আগে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর-বাস্তবায়িত “দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি” বা স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় ছিল। প্রকল্পটির আওতায় শিশুশিক্ষার্থীদের ৭৫ গ্রাম করে ফর্টিফায়েড বিস্কুট (১০টি) দেওয়া হতো। এ বিস্কুট একেকটি শিশুকে প্রতিদিন ৩৩৮ কিলোক্যালরি করে শক্তি জুগিয়েছে। ২১ বছর ধরে চলা সেই কার্যক্রম গত বছরের জুনে বন্ধ হয়ে যায়।’

সরকারের প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আছে জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯। সেখানে বলা আছে, ‘২০১১ সাল থেকে সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি দেশের ১০৪টি উপজেলায় ৩২ লাখ ৩১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য স্কুল ফিডিং কর্মসূচি চালু করে। পুষ্টিকর বিস্কুট দেওয়া হতো ছাত্রছাত্রীদের। পরীক্ষামূলক কর্মসূচি হিসেবে তিনটি উপজেলায় রান্না করা খাবারও দেওয়া হতো। স্কুল মিল নীতিতে বলা হয়েছে, স্কুল মিল কর্মসূচিকে সর্বজনীন করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনাধীন আছে।’

আমরা জানি, করোনা বিশ্বব্যাপী এক অপ্রত্যাশিত আঘাত হয়ে আসে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, তেলের সংকট, ডলারের সংকট ইত্যাদি আমাদের করোনার আগের দিনগুলোর উন্নতির ধারা এবং কর্মসূচিগুলোকে ব্যাহত করে। তারপরেও আমাদের অগ্রাধিকার তালিকায় এক নম্বরে থাকা উচিত প্রতিটি শিশুর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করা। আমাদের উচ্চবিত্ত–মধ্যবিত্ত শহুরে পরিবারগুলোতে একটা অভিযোগ শোনা যায়, বাচ্চারা খেতে চায় না। আর আমাদের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোর সমস্যা হলো, শিশুরা খেতে পায় না। এই বৈষম্য চলতে পারে না।

১৫ জুলাই ২০২২ দৈনিক সংবাদ–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে: ‘গত দুই দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার কমেছে অর্ধেকের বেশি। কিন্তু দূর করা যায়নি পুষ্টিহীনতা। জাতিসংঘের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে যে গবেষণা করে, সেই গবেষণা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ মানুষের পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। এই স্বাস্থ্যকর খাবারের জন্য একজন মানুষের দৈনিক খরচ পড়ে প্রায় ২৭৬ টাকা। এই গবেষণাতেই বলা হয়, বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।

‘জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও), আন্তর্জাতিক কৃষি উন্নয়ন সংস্থা (ইফাদ), ইউনিসেফ, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে “বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি পরিস্থিতি” শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘের সদস্য প্রায় সব দেশের তথ্যই প্রকাশিত হয়েছে এই প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মোট জনসংখ্যার হার স্বাস্থ্যকর খাবার কেনার সামর্থ্যরে দিক থেকে সবচেয়ে পিছিয়ে নেপাল, তারপরই পাকিস্তান। বাংলাদেশের চেয়ে ভারতের অবস্থান কিছুটা ভালো। আরও ভালো অবস্থানে আছে শ্রীলঙ্কা ও ভুটান।’

এ অবস্থায় আমরা চাই, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে মিডডে মিল চালু করা হোক। আমার নিজের পক্ষপাত রান্না করা গরম খাবারের প্রতি। খিচুড়ি আর ডিম। কিন্তু এ বিষয়ে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে, যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার ভিত্তিতে সরকার বাস্তবোচিত সিদ্ধান্ত নিক।

স্কুল ফিডিং কর্মসূচি যে সুফল দেয়, জহির রায়হানের লেখায় তা উঠে এসেছে। তিনি লিখেছেন: ‘সরকার অবশ্য দেশের ৬১টি জেলার ৩০০টি উপজেলায় একটি করে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে টানা দুই বছর নিরাপদ ও পুষ্টিকর দুধ পান করানোর পাইলট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

‘স্কুল মিল্ক ফিডিং প্রকল্পের বাস্তব চিত্র দেখতে গঙ্গাচড়ার ছালাপাক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যাই ৬ মার্চ। তিস্তাতীরবর্তী ওই গ্রামকে অজপাড়াগাঁও বললেও কম বলা হবে। এরপরও বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি ভালো দেখা গেল। পঞ্চম শ্রেণিতে ২১ শিক্ষার্থীর মধ্যে অনুপস্থিত মাত্র ২ জন।’

আগামী একনেক (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) বৈঠকে ‘স্কুল মিল প্রকল্প’ উঠবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রুমানা আলী। ঝরে পড়া রোধ, এনরোলমেন্ট ও শিশুর পুষ্টিচাহিদা পূরণে এ প্রকল্প অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করবে তিনি উল্লেখ করেন। (প্রথম আলো, ৪ মার্চ)

এখন পরীক্ষামূলকভাবে ৩৫ লাখ শিশুকে স্কুলে দুপুরের খাবার দেওয়ার কর্মসূচি একনেকে গৃহীত হোক, এটা আমাদের দাবি। পাশাপাশি, জাতীয় স্কুল মিল নীতি ২০১৯-এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে যে এই কর্মসূচি সর্বজনীন করা হবে, তা–ও হাতে নেওয়ার দাবি জানাই। আমাদের শিশুরা খালি পেটে স্কুলে যাবে, খিদেয় কাতরাবে, পুষ্টিহীনতায় ভুগবে—এটা হতে দেওয়া যায় না। স্কুল মিল কর্মসূচি স্কুলে শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করবে, স্কুল থেকে ঝরে পড়া রোধ করবে এবং আমাদের শিশুদের পুষ্টিহীনতা থেকে রক্ষা করবে।

বাংলাদেশের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে বৈষম্য। শ্রেণিগত বৈষম্য, আঞ্চলিক বৈষম্য, নারী-পুরুষ বৈষম্য। আমরা কোটিপতি উৎপাদনে রেকর্ড করেছি। বিদেশে অর্থ পাচারের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশের নাম আছে। যেকোনো দাওয়াতে দেখতে পাই, যত খাচ্ছি, তার চেয়েও বেশি নষ্ট করছি। অন্যদিকে আমাদের গ্রামগঞ্জে, বস্তিতে শিশুদের চোখে–মুখে পুষ্টিহীনতার ছাপ। আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্ষুধা পেটে নিয়ে স্কুলে আসছে। এটা হতে দেওয়া যায় না।

সর্বজনীন স্কুল মিল কর্মসূচি তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেওয়া উচিত। শিক্ষা, মানবসম্পদ ও পুষ্টিতে বিনিয়োগ বহুগুণে বেড়ে আমাদের কাছে ফিরে আসবে। এর সুফল আমরা পেতেই থাকব।
রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে শেষ করি:
শুধু দুটি অন্ন খুঁটি কোনোমতে কষ্টক্লিষ্ট প্রাণ
রেখে দেয় বাঁচাইয়া। সে অন্ন যখন কেহ কাড়ে,
সে প্রাণে আঘাত দেয় গর্বান্ধ নিষ্ঠুর অত্যাচারে,
নাহি জানে কার দ্বারে দাঁড়াইবে বিচারের আশে—
দরিদ্রের ভগবানে বারেক ডাকিয়া দীর্ঘশ্বাসে
মরে সে নীরবে। এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে
দিতে হবে ভাষা—এই-সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক