সিরিয়ায় গণ–অভ্যুত্থান শুরুর ১৪ বছর পর এবং ১৩ বছরের ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের পর, আসাদ সরকারের পতন সময়ের ব্যাপার ছিল।
শিশুসহ বন্দীদের যেসব ছবি ও ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে, সেটাকে মধ্যযুগীয় বন্দিশালার সঙ্গে তুলনা করা চলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভেসে যাচ্ছে সিরিয়ানদের নতুন স্বাধীনতা উদ্যাপনের ছবি ও ভিডিওতে। আসাদ পরিবারের নিষ্ঠুর শাসন থেকে মুক্তির আনন্দ তাঁরা উদ্যাপন করছেন।
যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম শাসকের পতন থেকে অন্যদেরও কিছু শিক্ষা নেওয়ার আছে। কেননা, যেকোনো মূল্যে আসাদের ক্ষমতায় থাকার আকাঙ্ক্ষা শুধু সিরিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেনি, নিজের পতনের বীজও বপন করে দিয়েছিল।
আসাদের পতনের সবচেয়ে সুস্পষ্ট শিক্ষা হচ্ছে, বিদেশি পৃষ্ঠপোষকদের ওপর নির্ভর করা এবং সেই সমর্থন কখনো শেষ হবে না, এটা বিশ্বাস করা বড় ভুল। বাশার আল–আসাদের ক্ষেত্রে এটা ছিল অনিবার্য এক পরিণতি। আসাদ ইরানের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিলেন। তাঁর মধ্যে এই আত্মবিশ্বাস জন্মে ছিল যে প্রতিরোধের অক্ষের তিনি একটা অপরিহার্য অংশ।
উদাহরণ হিসেবে গত ১৩ বছরে সিরিয়াতে ইরান ৩০–৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে। এটা ২০২৩ সালে ইরানের মোট জিডিপির সাড়ে ৭ থেকে সাড়ে ১২ শতাংশ। নিষেধাজ্ঞায় থাকা একটা দেশের জন্য এটা নিশ্চিত করেই বিশাল অঙ্ক।
সিরিয়াতে শীর্ষ কয়েকজন ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের কর্মকর্তাকে নিহত হতে দেখেছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইসরায়েলিরা টার্গেট করে হত্যা করে। ২০১৬ সালে ইরানের ১০০০ সেনা নিহত হয়েছিলেন। ২০১৯ সালে নিহত হয়েছিলেন ২৩০০ জন।
এই বিশাল বিনিয়োগ আসাদের মধ্যে তাঁর অপরিহার্যতা নিয়ে একটা বিভ্রম তৈরি করেছিল। আসাদ ভেবে নিয়েছিলেন, তাঁর অবস্থান সুরক্ষিত। সে কারণে তিনি ইরানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরির এবং আরব বিশ্বে নিজেকে পুনরায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা শুরু করেন। আসাদ চিন্তা করেছিলেন, উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে সিরিয়ায় বিনিয়োগের বন্যা বয়ে যাবে।
প্রকৃতপক্ষে, ইরান ও ইসরায়েলের সংঘাতে আসাদ সক্রিয় অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন। এমনকি সিরিয়ার মাটিতে যখন ইরানের উচ্চপদস্থ কমান্ডারদের হত্যা করা হচ্ছিল, তখন ইরানের দিক থেকে এই উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল যে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর দিক থেকে গোয়েন্দা তথ্য ফাঁস হচ্ছে কি না।
আসাদের সেনাবাহিনী ছিল তাঁর ক্ষমতার গ্যারান্টার। কিন্তু আসাদ তাঁর সেনাদের খুব অল্পই বেতন দিতেন। ফলে তাঁরা তাঁদের টিকে থাকার জন্য ব্যাপক দুর্নীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। এটা সেনাবাহিনীকে কার্যকর একটি লড়াকু বাহিনীতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁর পতনের জন্য পথ তৈরি করে দেয়।
আসাদের জন্য এটা ছিল বিশাল ভুল হিসাব। সিরিয়াকে ইরান বাড়তি সামরিক সমর্থন না দেওয়ায় বিদ্রোহীদের আক্রমণে সিরিয়ার সেনাবাহিনী দ্রুত ভেঙে পড়ে।
বাইরের সমর্থন কখনো সীমাহীন অথবা শর্তহীন হতে পারে না। বিশেষ করে যখন পৃষ্ঠপোষক দেশকে নিজস্ব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়।
উদাহরণ হিসেবে, রাশিয়া ইউক্রেনে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আলেপ্পোর পতন ঠেকাতে রাশিয়ার ব্যর্থতায় সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রাশিয়া তাদের বেশির ভাগ যুদ্ধবিমান ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য সংরক্ষণ করে রেখেছিল।
দ্বিতীয় শিক্ষা হচ্ছে, ঠিকমতো সংস্কার না করতে পারলে সেটা আপনার বিলোপ ডেকে আনবে। এটা তর্কাতীত যে ২০১৬ সালে আসাদ সরকার ও তার মিত্রদের হাতে আলেপ্পোর পতন হলে, সেটা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের হাওয়া আসাদের পক্ষে পুরোপুরি ঘুরিয়ে দিয়েছিল।
এরপর ২০১৮ সালে দারা ও পূর্ব গৌতাতে আসাদ ও তাঁর মিত্রদের ব্যাপক গোলাবর্ষণে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আত্মসমর্পণ করে।
এর ফলে ক্ষমতার মুঠো আসাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। অথচ সেটাকে একটা রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হয়েছিল। যা–ই হোক, আসাদ কোনো ধরনের আপসের দিকে হাঁটেননি। এমন কোনো রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তিনি শুরু করেননি, যেখানে বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
ব্যাপক মাত্রার দমন–পীড়ন রীতিতে পরিণত হয়েছিল। এর মধ্যে সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, বাড়িঘর গুঁড়িয়ে দেওয়া, নির্যাতন, হাজার হাজার মানুষকে নির্বিচার আটক।
ইদলিবে উত্তেজনা প্রশমনে যে চুক্তি করা হয়েছিল, তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করা হয়েছিল।
রাশিয়ার মধ্যস্থতায় তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারেও আসাদ ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করে গিয়েছিলেন আসাদ।
দেশের মধ্যে বিরোধীদের সঙ্গে এবং বাইরে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের সঙ্গে সমঝোতা করতে না পারার ব্যর্থতা আসাদের পতনের পথ তৈরি করে। প্রকৃতপক্ষে, আঙ্কারার সঙ্গে আসাদ যদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে পারতেন, তাহলে তুরস্কের কৌশলগত সমর্থন ও অনুমোদন ছাড়া বিরোধীদের পক্ষে আক্রমণ করা অনেক কঠিন হতো।
অন্যদিকে বিরোধীদের যদি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে পারতেন, তাহলে যে আক্রমণে তাঁর পতন হলো, সেটা ঘটার সম্ভাবনা ছিল অনেক কম।
আসাদ সরকার পতনের পেছনে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি কাজ করেছে, সেটা হলো তাঁর একেবারে খাঁটি সমর্থকগোষ্ঠীরও সমর্থন তিনি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
আসাদের যখন পতন হলো, তখন সিরিয়ার ৯০ শতাংশ মানুষের জীবনমান দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১২০ শতাংশ। মুদ্রার মানের বড় পতন হয়েছিল। ২০১১ সালের ৬৭ বিলিয়ন ডলারের জিডিপি থেকে ২০২১ সালে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।
এসব সংকটের সমাধান হিসেবে আসাদ সিরিয়াকে নারকো রাষ্ট্রে (মাদক অর্থনীতির দেশ) পরিণত করেছিলেন। ক্যাপ্টাগন–জাতীয় মাদক উৎপাদন ও রপ্তানির কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল সিরিয়া। ২০২১ সালে সিরিয়ার কেপ্টাগন মাদক অর্থনীতির আকার ছিল প্রায় ৫ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের।
অন্যভাবে বলা যায়, আসাদ তাঁর ক্ষমতায় থাকার জন্য দেশের অর্থনৈতিক জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন। ফলে আসাদ সরকার দেশকে অন্তহীন গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যে সীমাহীন মৃত্যু উপহার দিয়েছিল।
আসাদের সেনাবাহিনী ছিল তাঁর ক্ষমতার গ্যারান্টার। কিন্তু আসাদ তাঁর সেনাদের খুব অল্পই বেতন দিতেন। ফলে তাঁরা তাঁদের টিকে থাকার জন্য ব্যাপক দুর্নীতির ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিলেন। এটা সেনাবাহিনীকে কার্যকর একটি লড়াকু বাহিনীতে পরিণত করতে ব্যর্থ হয় এবং তাঁর পতনের জন্য পথ তৈরি করে দেয়।
এই অঞ্চলের অন্যান্য স্বৈরশাসক ও তাঁদের পৃষ্ঠপোষকেরা এই শিক্ষাগুলো উপেক্ষা করবেন সেটাই ধরে নেওয়া যায়।
সবচেয়ে স্পষ্ট উদাহরণ হলেন মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি। তিনি এমন একটা দেশের প্রেসিডেন্ট, যেটি কিনা চরমভাবে আর্থিকভাবে অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল। তিনি প্রবলভাবে সংস্কারবিরোধী ও জনগণকে দমনের ওপর নির্ভরশীল। সাধারণ মানুষের (এমনকি যাঁরা তাঁর সরকারকে সমর্থন করে) আর্থিক দুরবস্থা লাঘবে তিনি খুব কমই মনোযোগী।
মাজেদ মানদুর, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত