অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার ইত্যাদি প্রশ্নে পশ্চিমা বিশ্ব নির্বাচনের আগে বেশ সরব ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের একধরনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছিল। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে জয়ের পর বর্তমান সরকারের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক যৌক্তিক পর্যায়ে আনতে হবে। ভারত–চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
নতুন সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাছান মাহমুদ। সরকারের কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার দায়িত্ব এখন অনেকটাই তাঁর ওপর। পরিবর্তিত বিশ্বে এই চ্যালেঞ্জ আগের চেয়ে অনেক বেশি জটিল ও বহুমাত্রিক।
টানা চারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী একসময় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন পরিবেশমন্ত্রীও। মন্ত্রিসভা গঠনের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নতুন সরকারের অন্যান্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে থাকা চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে একবার চোখ বোলানো যাক—
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক মেরামত
আমার বিবেচনায় বৈদেশিক ক্ষেত্রে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে যৌক্তিক পর্যায়ে আনা। নির্বাচনের বেশ আগে থেকেই সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন সরকার র্যাব ও এর কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে—প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, রাজনীতিবিদ, এমনকি বিচার বিভাগের এমন কর্মকর্তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ২০২৩ সালের মে মাসে ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেয়। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর এই নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা শুরু হয়েছে বলেও তারা জানায়।
হোয়াইট হাউসের উদ্যোগে ২০২১ ও ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। গত ১৬ নভেম্বর শ্রম অধিকারবিষয়ক নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই ঘোষণা দিতে গিয়ে উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশ্রমিক নেত্রী কল্পনা আক্তারের নামোল্লেখ করেন।
আশঙ্কা ছিল, ২০২৪ সালে একতরফা নির্বাচন হলে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে; কিন্তু তফসিল ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কণ্ঠস্বর নির্বাচন–পূর্ববর্তী অবস্থার তুলনায় অনেকটাই স্তিমিত হয়ে যায়।
‘নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি’ বললেও নতুন সরকার গঠনের পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী বক্তব্যের মতো ছিল। ফলে অনেকের ধারণা, সরকার সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটা সমঝোতায় এসেছে।
১৭ জানুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরে রাষ্ট্রদূত হাস সাংবাদিকদের বলেন, আগামী দিনগুলোতে দুই পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে তিনি উন্মুখ হয়ে আছেন। (প্রথম আলো, ১৮ জানুয়ারি ২০২৪)। তাঁর বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে নিলে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মেঘ কেটে যাচ্ছে—এমনটি মনে হয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট ব্যতিক্রম দেখা যায়। ১৪ জানুয়ারি টুঙ্গিপাড়ায় এক সভায় তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে তাদের ‘নির্লজ্জ’ বলে উল্লেখ করেন। তাঁর ক্ষোভের কারণে আশঙ্কা থেকে যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন অবসানের স্পষ্ট সম্ভাবনা এখনো হয়তো সৃষ্টি হয়নি।
উল্লেখ্য, নির্বাচন-পূর্ববর্তী সপ্তাহগুলোয় মার্কিন ভাষ্যের তীব্রতা কমে এলেও হোয়াইট হাউস বা পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বরাবরই বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে মার্কিন নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
এ ছাড়া মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের মতো বিষয় ডেমোক্লিসের তরবারির মতো ঝুলে থাকছে বাংলাদেশের ওপর। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র কী পদক্ষেপ নেবে বা আদৌ কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না, তার ওপর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক যতই মধুর হোক না কেন, বাংলাদেশের রপ্তানির মূল বাজার পশ্চিমে। প্রবাসী আয়ের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ২০২২–২৩ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩৫২ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। প্রবাসী আয়ে সৌদি আরবের পরেই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। সুতরাং পশ্চিম থেকে যেকোনো নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের বর্তমান বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে আরও সংকটে ফেলতে ফেলতে পারে।
ইউরোপের সঙ্গে সমঝোতা
নির্বাচন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) উচ্চপদস্থ প্রতিনিধি ৯ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মতো মূল্যবোধের ওপর জোর দেওয়া হয়। সব বড় দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় ইইউ দুঃখ প্রকাশ করে।
ঢাকায় ইইউর রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি ১৭ জানুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। পরদিন দেখা করেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে রাষ্ট্রদূত টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে ইইউর পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রদূত ইবিএর (অস্ত্র ছাড়া সবকিছু) আওতায় বাংলাদেশকে দেওয়া সুযোগ-সুবিধা অব্যাহত রাখার এবং জিএসপি প্লাস সুবিধা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
নির্বাচন নিয়ে ইইউর আগের অবস্থান বা উচ্চপদস্থ প্রতিনিধির বিবৃতির তুলনায় রাষ্ট্রদূতের কথোপকথন অনেকটাই নমনীয় এবং সরকারের জন্য ইতিবাচক বলে মনে হয়। তবে যে দুটি সুবিধার কথা তিনি বলেছেন, তার মধ্যে ইবিএ–সুবিধা শুধু স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য। গ্র্যাজুয়েশনের পর আর এ সুবিধা পাওয়া যাবে না। জিএসপি প্লাস পাওয়ার শর্তের মধ্যে রয়েছে মানবাধিকার, শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং সুশাসন।
এ-সংক্রান্ত ২৭টি সনদ কি বাংলাদেশ মেনে চলবে? চললে তো ভালো। নইলে একক ইউনিট হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানির সবচেয়ে বড় এই বাজারকে ধরে রাখতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কষ্টকর প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক
নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের মতো। নির্বাচনের পরদিন যুক্তরাজ্যের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়, এই নির্বাচনে মানবাধিকার, আইনের শাসন এবং যথাযথ প্রক্রিয়া সব ক্ষেত্রে পালিত হয়নি। নির্বাচন-পূর্ববর্তী সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনেরও নিন্দা জানায় যুক্তরাজ্য।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাজ্য এখন আর হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের মতো অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের তৃতীয় বৃহত্তম গন্তব্য এই দেশ। বিশাল বাংলাদেশি কমিউনিটিরও বাস সেখানে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে তাই দেশটির সঙ্গে কার্যকর সুসম্পর্ক বাজায় রাখতে সচেষ্ট থাকতে হবে।
ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক
যেকোনো বিচারেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশেরই সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বারবার বলেছেন, এই সম্পর্ক এখন সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থান করছে এবং তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের রোল মডেল। পশ্চিমের দেশগুলো যখন ২০২৪ সালের নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্য-বিবৃতি দিচ্ছিল, ভারত তখন ছিল অনেকটাই নীরব।
গত ১০ নভেম্বর দিল্লিতে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত টু প্লাস টু সংলাপে বাংলাদেশের নির্বাচন প্রসঙ্গে আলোচনা হয়েছিল। সেখানে সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের বিষয়ে দুপক্ষ একমত হতে পারেনি। এরপর বাংলাদেশ সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছে, তাতে ভারত স্পষ্ট সমর্থন ব্যক্ত করে।
বন্ধুত্ব যতই ঘনিষ্ঠ হোক, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে তারপরও কিছু চ্যালেঞ্জ থেকেই যায়, বিশেষত দেশ দুটি যখন পরস্পরের প্রতিবেশী। বাংলাদেশের কাছে ভারতের যা চাওয়া ছিল, এর প্রায় সবটাই বাংলাদেশ দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। বিপরীতে বাংলাদেশের কিছু চাওয়া পূরণে ভারতের অনীহা বা দীর্ঘসূত্রতা পীড়াদায়ক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এখনো সীমান্তে বিএসএফের হাতে মানুষ হত্যার ঘটনা ঘটছে। আবার এর পক্ষে ভারতীয় নেতৃত্বের সাফাই গাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির দোহাই দিয়ে ভারত তিস্তার পানির হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত করছে।
বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে ট্রানজিট দেওয়া হয়েছে; কিন্তু শিলিগুড়ি করিডর পেরিয়ে নেপালে যাওয়ার অনুমতি এখনো জোটেনি। বাণিজ্যে অশুল্ক বাধা তো আছেই। এসব বিরক্তিকর বিষয় নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার করেই যেতে হবে।
ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্য
নির্বাচনের আগে–পরে চীনের বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া সরকারের জন্য স্বস্তিদায়ক ছিল। নির্বাচনের পরদিনই ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে তাঁকে অভিনন্দন জানান। বিগত বছরগুলোতে বর্তমান সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও ছিল মোটামুটি মসৃণ।
দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে চীনের পক্ষে বিশাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। মূলধনি যন্ত্রপাতি ও ভোগ্যপণ্য—উভয় সামগ্রীর প্রধান উৎস চীন। বাংলাদেশের কিছু বড় প্রকল্পে বাণিজ্যিক সুদে ঋণ দিয়েছে চীন। চীনা অনেক কোম্পানি বড় প্রকল্পে ঠিকাদারিও পেয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভেও (বিআরআই) বাংলাদেশ যোগ দিয়েছে।
চীনের জন্য সুবিধাজনক এ ধরনের সম্পর্ক বজায় রাখতে সরকারের সমস্যা হবে না। বিশেষ করে যেখানে বাংলাদেশে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী রয়েছে, চীনের সঙ্গে যাদের আর্থিক স্বার্থ জড়িত। বাংলাদেশের একমাত্র মর্মবেদনার কারণ ছিল রোহিঙ্গা সংকটে চীনের দুঃখজনক অবস্থান। জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে চীন বরাবর রোহিঙ্গাদের তথা বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে এ জন্য বাংলাদেশ সরকার কখনোই চীনের সমালোচনা করেনি; বরং প্রায়ই চীনের পরামর্শ মেনে চলেছে।
প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্প নিয়ে একটা সমস্যা হতে পারে। ১০০ কোটি ডলার ব্যয়ে তিস্তা নদীর সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করার কথা চীনের। গত ২১ ডিসেম্বর চীনের রাষ্ট্রদূত আশা প্রকাশ করেছেন, নির্বাচনের পর এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য চীনের নাগরিকেরা এতে কাজ করবেন।
প্রকল্পের স্থান ভারতের শিলিগুড়ি করিডর বা ‘চিকেন নেক’-এর কাছে, যা ভারতের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নাজুক হিসেবে বিবেচিত। ভারত এই প্রকল্পের বিষয়ে কী অবস্থান নেবে বা প্রকল্প বাতিল করতে কতটা চাপ দেবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
আবার প্রকল্প বাতিল করলে চীন সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হবে। উল্লেখ্য, চীনা অর্থায়নে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের চুক্তি প্রায় চূড়ান্ত হওয়ার পর ভারতের চাপে বাংলাদেশ পিছিয়ে যায়। চীন স্পষ্টতই এতে অসন্তুষ্ট হয়।
অনেকে মনে করেন, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে চীনের অসংগত অবস্থানের পেছনে সোনাদিয়া প্রকল্পের অঘটনের ভূমিকা থাকতে পারে। একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন অনুষ্ঠানে ভারত ও চীনের যৌথ সমর্থন লাভের পর এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাজ হবে শ্যাম ও কুল—উভয়ই রক্ষা করা।
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা
এই বহুল আলোচিত বিষয়টি নিয়ে কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নেই। হাছান মাহমুদের পূর্বসূরির পাঁচ বছরের মেয়াদে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এর মধ্যে রোহিঙ্গা শিবির সশস্ত্র সংঘাত, মাদক ও মানবপাচারের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মিয়ানমারে চলমান গৃহযুদ্ধের কারণে বাড়তি জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে আগামী পাঁচ বছরে এই বোঝা কাঁধ থেকে নামানো হবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদের অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
মানবাধিকার
যখনই কোনো মানবাধিকার সংগঠন যেমন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্বিচার গ্রেপ্তার, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ বা বিচারহীনতার অভিযোগ আনলে সরকার সাধারণভাবে এসব অভিযোগ নাকচ করে বা এতে ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকেও পক্ষপাতদুষ্ট বলে প্রচার করে।
এতে যে খুব লাভ হয়, তা নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সরকারের ভাষ্যের চেয়ে এসব সংগঠনের বক্তব্য বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচনা করে। সরকারকে এই অস্বীকারের সংস্কৃতি থেকে বের করে আনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া ও বহির্বিশ্বে একটি বিশ্বাসযোগ্য ভাবমূর্তি সৃষ্টি করা।
এই সাত চ্যালেঞ্জের বাইরে না চাইলেও আরও দুটি বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সংশ্লিষ্ট হতে হয়। তার মধে৵ একটি হচ্ছে বৈদেশিক শ্রমবাজার, যার জন্য সরকারের আলাদা মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যত অনিয়ম ও সমস্যার সৃষ্টি হয়, তা সামাল দেওয়ার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপরই বর্তায়। অন্যটি হচ্ছে মানব পাচার, যা কিনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিষয়। এ নিয়েও বিভিন্ন সময় চাপের মুখে পড়তে হবে নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে।
গুড লাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব