মতামত

আওয়ামী লীগের স্মার্ট বাংলাদেশ ও বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত নিয়ে কিছু প্রশ্ন

বছর শেষ হতে আর মাত্র দুই দিন। কাগজগুলোয় সালতামামি বেরোলে বাংলাদেশের জন্য করোনা–উত্তর বছরটা কেমন গেল, তার একটা মোটামুটি স্মৃতিচারণা পাওয়া যাবে। তবে আমার যতটা মনে পড়ছে, তাতে পুরো বছরের মধ্যে রাজনীতির জন্য সবচেয়ে আলোচিত মাস নিশ্চিতভাবেই ডিসেম্বর।

এ মাসেই দুটো বড় দলের কাছ থেকে আগামীর বাংলাদেশ নিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানা গেল। একই সঙ্গে কার কী সাংগঠনিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ কেমন হতে যাচ্ছে, তারও একটা চেহারা পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমে আমরা পেলাম বিরোধী দল বিএনপির রাষ্ট্র মেরামত কর্মসূচি এবং যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা।

আর ২৪ ডিসেম্বর পেলাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার প্রত্যয়। দুটো বিষয় নিয়ে বিশদ বিশ্লেষণ প্রয়োজন, কিন্তু সংবাদপত্রের সীমিত পরিসরে তা সম্ভব নয়। তবে প্রধান প্রধান উপাদানের ওপর সংক্ষেপে হলেও কিছুটা আলোকপাত করা যায়।

২.

যাঁরা টিভিতে সরাসরি সম্প্রচার দেখেননি, তাঁদের পক্ষে আওয়ামী লীগের সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে কী ছিল, তা নজরে না–ও পড়তে পারে। কেননা সংবাদমাধ্যম কয়েক দিন ধরে রাজনীতির চেয়ে নেতৃত্ব নিয়ে জল্পনাতেই মেতে ছিল। গত ১৪ বছরে সরকারের এবং দলের এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে আমরা মন্ত্রী ও দলীয় নেতাদের মুখে শুনিনি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা সভানেত্রী সিদ্ধান্ত দেবেন।

সুতরাং, সম্মেলনে দলের নেতৃত্ব নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এত মাতামাতি কেন, তা বোঝা মুশকিল। আওয়ামী লীগের ওয়েবসাইটে এ রাজনৈতিক ঘোষণার একটা বিবরণ আছে ‘লক্ষ্য এখন ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ’ শিরোনামের রাজনৈতিক নিবন্ধে।

নিবন্ধটিতে হীরেন পণ্ডিত লিখেছেন, ২২তম জাতীয় সম্মেলনে দেওয়া বক্তব্যে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে চারটি ভিত্তির কথা উল্লেখ করেন। এগুলো হলো স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্মার্ট সোসাইটি। সরকার আগামীর বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, যেখানে প্রতিটি জনশক্তি স্মার্ট হবে।

সবাই প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি, যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মযোগ্যতা’ সবকিছুই ই-গভর্ন্যান্সের মাধ্যমে হবে। ই-এডুকেশন, ই-হেলথসহ সবকিছুতেই ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা হবে। ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা তা করতে সক্ষম হব এবং সেটা মাথায় রেখেই কাজ চলছে।

সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে তখন সংবিধান কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ২০০৬ সালে এক–এগারোর সরকারেও সংবিধানের বিধান আক্ষরিকভাবে অনুসৃত হয়নি; কিন্তু তাদের কার্যক্রম বৈধতা পেয়েছে। নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্য যেকোনো নামের সরকারই হোক, তার জন্য প্রয়োজন জাতীয় সমঝোতা। সেটা কখনোই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে বাদ দিয়ে হয় না। রাজনীতিতে সেই সমঝোতার লক্ষ্যে কখন, কে, কীভাবে উদ্যোগী হয়, সেটারই এখন অপেক্ষা।

২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ভিশন ২০২১’–এর মূল ভিত্তি হিসেবে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেন, স্মরণ করিয়ে দিয়ে এতে দাবি করা হয়েছে, আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বাংলাদেশ বিপ্লব সাধন করেছে। দলের এই রাজনৈতিক কর্মসূচির ঘোষণাকে যে সরকারের প্রচারকাজেরও মূল বাণী বা মন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, তা সরকারের বিভিন্ন আয়োজনেই দৃশ্যমান হচ্ছে।

তবে নির্বাচনমুখী এ ঘোষণাপত্রে নির্বাচন নিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে যে একটা সংকট আছে, তার কোনো স্বীকৃতি নেই এবং সমাধানের আগ্রহ অথবা উদ্যোগের কোনো আভাসও নেই।

আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র জোটসঙ্গী দলগুলো এবং অনুগত বিরোধী দল ছাড়া দেশের অন্য সব রাজনৈতিক দল যে বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে, সেই পটভূমিতে আগামী নির্বাচন কীভাবে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব দলটির সম্মেলনে মেলেনি। আনস্মার্ট জনগোষ্ঠীকে স্মার্ট বানাতে জনগণের মতামত আবশ্যক বিবেচিত না হওয়াই কি এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা?

ভোটের অধিকার অবাধে প্রয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা ছাড়া যে রাজনীতির মূল সংকট দূর হবে না, সেটা স্বীকার করতে সময়ক্ষেপণের ফলে অযথা বিরোধকে বৈরিতা এবং সংঘাতের দিকে ঠেলে দেওয়া কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। বিএনপির সঙ্গে কোনো আলোচনা নয় বলার পরও ২০১৮ সালে তাদের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। তখন নির্বাচনের ১০ মাস আগে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব দিয়েছিলেন, ‘বিরোধী দলের কাছে আমার প্রস্তাব, নির্বাচনকালীন আমরা সব দলের সমন্বয়ে সরকার গঠন করতে পারি। আমাদের লক্ষ্য অবাধ, নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।’ (‘সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর’, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, প্রথম আলো)। চার বছর পর অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সরকারের কোনো উদ্যোগ ও প্রস্তাব কেন নেই, সে প্রশ্ন তাই মোটেও উপেক্ষণীয় নয়।

৩.

আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও ঘোষণাপত্র প্রকাশের পাঁচ দিন আগে ১৯ ডিসেম্বর ঢাকায় বিএনপির পক্ষ থেকে ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’র ২৭ দফা ঘোষণা করা হয়। বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হতে থাকার পটভূমিতে বিএনপি সরকারবিরোধী বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে তার সাংগঠনিক পুনরুজ্জীবনের কাজে গতির সঞ্চার করে।

গত ২২ অক্টোবর থেকে বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি দিয়ে ক্ষমতাসীন দল, প্রশাসন ও পুলিশের বিভিন্ন বাধার মুখেও বড় বড় সমাবেশ ঘটিয়ে তারা প্রমাণ দেয় যে দলটি নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এরপর ঘোষিত হলো রাষ্ট্র মেরামতের কর্মসূচি। ‘রাষ্ট্র মেরামত’ কথাটি আমরা প্রথমবার বেশ জোরালো উচ্চারণে শুনি স্কুল–কলেজের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে।

এ ছাড়া ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনও সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবের আলোচনায় শব্দগুচ্ছটি প্রয়োগ করতে থাকে। দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির মুখে এটি উচ্চারিত হওয়ায় তাদের কর্মসূচিতে কী আছে, সেদিকে এখন অনেকের নজর পড়েছে।

কর্মসূচির পটভূমিতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান কর্তৃত্ববাদী সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্রকাঠামোকে ভাঙিয়া চুরমার করিয়া ফেলিয়াছে। এই রাষ্ট্রকে মেরামত ও পুনর্গঠন করিতে হইবে। দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরাইয়া দেওয়ার লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জয়লাভের পর বর্তমান ফ্যাসিস্ট সরকার হটানোর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহের সমন্বয়ে একটি “জনকল্যাণমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার” প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’

রাষ্ট্র মেরামতের সংস্কারগুলো করবে সেই জাতীয় ঐকমত্যের সরকার। দলটির ২৭ দফায় সংবিধান সংশোধন, বিচার বিভাগের সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কার, অর্থনৈতিক সংস্কার, গণমাধ্যমের সংস্কারসহ কতগুলো যে কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে, তার খেই রাখা মুশকিল।

সংস্কারের অগ্রাধিকারের ক্রমবিন্যাস না থাকায় সবকিছু করার তাড়ায় কোনো কিছুই না হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এটিকে তাই সবাইকে তুষ্ট করার অতি উচ্চাকাঙ্ক্ষী চেষ্টার প্রতিফলন বললে খুব একটা ভুল হবে না।

বিএনপির ২৭ দফার মূল সমস্যা হচ্ছে জাতীয় সরকার গঠনের আগে যে ‘অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’–এর  কথা তারা বলছে, সেই নির্বাচন কীভাবে সম্ভব হবে, তার সমাধান এতে নেই।

বর্তমানে জেলে থাকা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল অবশ্য এর আগে বলেছিলেন, ‘আমি খুব পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমাদের এই আন্দোলন বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন নয়, আমাদের এই আন্দোলন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য নয়, আমাদের এই আন্দোলন তারেক রহমান সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য নয়।

আমাদের এই আন্দোলন মানুষের অধিকারকে ফিরে পাওয়ার আন্দোলন, আমাদের মানুষের ভোটের অধিকার পাওয়ার আন্দোলন, আমাদের এই আন্দোলন দেশে একটা সুষ্ঠু, সুন্দর, শান্তিময় পরিবেশ তৈরি করার আন্দোলন...।’(‘১০ ডিসেম্বর নিয়ে ভয় পেয়েছে সরকার: ফখরুল’, ৩ ডিসেম্বর ২০২২, বিডিনিউজ২৪)। সেই ভোটের অধিকার ফেরানোর বাস্তবসম্মত পথ দেখানো ছাড়া এসব কর্মসূচি নিয়ে অর্থবহ কিছু অর্জন কি সম্ভব? আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কি সরকারের সম্মতি ও সহায়তা ছাড়া সম্ভব?

৪.

আওয়ামী লীগের ভিশন (রূপকল্প) ২০২১–এর কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। সেই ভিশনের আগে কিন্তু নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে সারা দেশে নাগরিক সংলাপের মধ্য দিয়ে তৈরি হয়েছিল রূপকল্প ২০২১। আওয়ামী লীগের ভিশন ২০২১–এ নাগরিক সমাজের আশা–আকাঙ্ক্ষার অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখন ভোটাধিকার ফিরে পাওয়াই সবচেয়ে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, তার ভিত্তি ছিল রাজনৈতিক সমঝোতা। রাজনৈতিক সমঝোতার কারণে তখন সংবিধান কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ২০০৬ সালে এক–এগারোর সরকারেও সংবিধানের বিধান আক্ষরিকভাবে অনুসৃত হয়নি; কিন্তু তাদের কার্যক্রম বৈধতা পেয়েছে। নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক অথবা অন্য যেকোনো নামের সরকারই হোক, তার জন্য প্রয়োজন জাতীয় সমঝোতা। সেটা কখনোই কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে বাদ দিয়ে হয় না। রাজনীতিতে সেই সমঝোতার লক্ষ্যে কখন, কে, কীভাবে উদ্যোগী হয়, সেটারই এখন অপেক্ষা।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক