মতামত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কি এভাবেই চলবে

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সভায় একজন শিক্ষক তাঁর এক সহকর্মীকে গলা টিপে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। শুধু হুমকি দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি। কথা ও কাজে সামঞ্জস্য রাখার জন্য তেড়েও গিয়েছিলেন। কাউন্সিলের কয়েকজন সদস্য এ যাত্রায় নিবৃত্ত করেছেন তাঁকে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে উপদলীয় কোন্দল, হল দখল, চাঁদাবাজি ইত্যাদি কারণে সংবাদপত্রের পাতায় স্থান পেয়ে আসছে ছাত্রলীগ। এবার সরকারপন্থী শিক্ষকেরাও তাঁদের শিক্ষার্থীদের দেখানো পথ অনুসরণ করতে শুরু করেছেন। রাজনৈতিক আদর্শের কারণে এত দিন হলুদ ও সাদা দলে বিভক্ত ছিলেন শিক্ষকেরা। কিন্তু গত ৫-৭ বছরে যেমন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব প্রায় বিস্মৃতির পর্যায়ে চলে গেছে, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা অনেকটা সে রকম। বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত সাদা দল বা সাদা থেকে বেরিয়ে আসা বিএনপিপন্থী ‘বর্ণহীন’ জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের তেমন উচ্চবাচ্য নেই।

যে কোনো খেলায় মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বি দল না থাকলে নিজেদেরই দুই দলে ভাগ হয়ে খেলতে হয়। সেই নিয়ম অনুসরণ করে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা। এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের।

কথায় কথায় মূল ফটকে তালা দেওয়া,শাটল ট্রেন অচল করে দেওয়ার মতো ঘটনা নিয়মিত ঘটছেই। শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক গ্রুপগুলাকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেও তাদের কার্যক্রম থামানো যাচ্ছে না।  ভিএক্স, একাকার, কনকর্ড প্রভৃতি নামের ব্যানারে ছাত্রলীগের বিভিন্ন উপদল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেনস্টেশন, ক্যাম্পাস বা আবাসিক হলগুলোতে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ বা তাদের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদেরও কোনো নিয়ন্ত্রণ এসব উপদলগুলোর ওপর আছে বলে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না। অবশ্য এমনও হতে পারে এই নেতারা জনসমক্ষে তাদের কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করলেও গোপনে ইন্ধন দেন। না হলে এমন দাপটের প্রেরণা বা প্ররোচনা আসে কোত্থেকে?

এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসেন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের সন্তানেরা। কিন্তু নানা অনিয়মের কারণে এখানে তাদের শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত হতেই থাকে। সেশনজটের কবলে পড়ে ক্ষয়ে যেতে থাকে জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলো। এই হতাশার দিনে তারা চোখের সামনে দেখে কিছু বীরপুঙ্গব বড় ভাইকে, যারা শুধু সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীর পরিচয়ে বেশ ভালো কামাই করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবন থেকে শুরু করে রাস্তাঘাট নির্মাণ, সংস্কার বা মেরামতের কাজ তো সারা বছরই লেগে থাকে। আছে নানা ধরনের মুদ্রণ বা পরিবহনের কাজ। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যত টাকা ব্যয় হয়, ততই আয় বাড়ে ছাত্রনেতাদের। কারণ ঠিকাদার তাঁর লাভের অংশের সঙ্গে এই নেতা-কর্মীদের ‘প্রাপ্য’ যোগ করেই ব্যবসা করতে আসেন এখানে। এই নিয়মের ব্যত্যয় হলে কী হয় তার অসংখ্য উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। সর্বশেষ উদাহরণ হিসেবে সোহরাওয়ার্দী হল থেকে মূল ফটক পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই নম্বর রোডের নির্মাণকাজের কথা উল্লেখ করা যায়। দীর্ঘদিন এই কাজে হাত দিতে পারেননি ঠিকাদার। কেন পারেননি সেটা লিখিত চিঠি দিয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন তিনি। এখন কাজটি আবার শুরু হয়েছে। কী উপায়ে সমস্যার সমাধান হলো, তা নিশ্চয় আর উল্লেখ করতে চাইবেন না ভূক্তভোগী ঠিকাদার।

গত পাঁচ বছরে আবাসিক হলে ছাত্র-ছাত্রীদের আসন বরাদ্দ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে অবশ্য হল খালি থাকেনি। ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আর ছাত্ররা ছাত্রলীগ নেতাদের দয়া ও দোয়া নিয়ে হলে থেকেছে। কোন হলে কে থাকতে পারবে তার সিদ্ধান্তও দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।

সব ধরনের সুবন্দোবস্ত আছে বলেই ছাত্রনেতারা সহজে ক্যাম্পাস বা ছাত্রাবাস ত্যাগ করতে চান না। যেমন ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি রেজাউল হক স্নাতকোত্তর পাস করেছেন ২০১৩ সালে। কিন্তু আমানত হলের ৩১১ নম্বর কক্ষটি এ বছরের এপ্রিল মাস ছিল তাঁর দখলে। তাঁর প্রতিপত্তির কিছুটা আঁচ পাওয়া গিয়েছিল সামাজিক যাগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবিতে, যেখানে দুই সহকর্মী তাঁর পা টিপছিলেন। সেই রেজাউল করিমকে অবশেষে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে তাঁরই অনুসারীরা। ক্যাম্পাসে কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে তাঁর। অবস্থা বেগতিক দেখে ক্যাম্পাস ছেড়েছিলেন তিনি। গত ২০ জুলাই আবার ‘বিএনপির নৈরাজ্যে’র প্রতিবাদে ক্যাম্পাসে কর্মসূচি দিয়ে ফিরে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের দলের কর্মীরাই ধাওয়া দিয়েছে তাঁকে।

চবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ২০১৬ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এরপর স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় অংশ নেননি তিনি। ফলে ক্যাম্পাস বা ছাত্রাবাস ছেড়ে যাওয়ারও প্রয়োজন হয়নি। একদিন তিনিও সভাপতির ভাগ্য বরণ করলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

গত পাঁচ বছরে আবাসিক হলে ছাত্র-ছাত্রীদের আসন বরাদ্দ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে অবশ্য হল খালি থাকেনি। ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আর ছাত্ররা ছাত্রলীগ নেতাদের দয়া ও দোয়া নিয়ে হলে থেকেছে। কোন হলে কে থাকতে পারবে তার সিদ্ধান্তও দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ।

এইসব অরাজকতার মধ্যেই ক্যাম্পাসে নতুন করে যুক্ত হলো শিক্ষকদের বিবাদ-বিসম্বাদ। সম্প্রতি শিক্ষক সমিতির সভাপতির নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন শিক্ষকদের একটি অংশ। একই সমিতির সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে পাল্টা মিছিল ও মানববন্ধন করেছে শিক্ষকদের অপর অংশটি। পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার চলছে।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এখন জমজমাট। শুধু মূল কাজটিই, অর্থাৎ শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বা গবেষণার কাজে তেমন উৎসাহ নেই কারও। যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন গত জুন মাসে এশিয়ার সেরা ২০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করেছে, তাতে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম শেষের দিকে থাকলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধও নেই। তাতে অবশ্য সংশ্লিষ্টদের বিন্দুমাত্র গ্লাণি আছে বলে মনে হয় না। থাকলে চলতি অর্থবছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বিরাট বাজেটে গবেষণার জন্য মাত্র সাড়ে ৮ কোটি টাকা বরাদ্দ হতো না!

  • বিশ্বজিৎ চৌধুরী প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও সাহিত্যিক