একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক সম্পর্কে একটা গল্প চালু আছে। পোশাকে, চেহারায় সুশীল ব্যক্তিত্বের চাদর জড়িয়ে তিনি জীবনের ৫০ বছর পার করার পর খেয়াল করে দেখলেন, সাংবাদিকতা করতে গিয়ে নিজের বিয়ের কথা ভুলে গেছেন। অবশেষে তিনি বিয়ে করলেন। সহকর্মীরা খুব করে সম্ভাষণ জানালেন। বাসররাত পার করে ভদ্রলোক পরদিন অফিসে এলেন। সহকর্মীরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী দাদা, বাসরঘরের ব্যাপারটা কেমন, বলেন দেখি?’
ভদ্রলোক মুখে বিরাট গাম্ভীর্য টেনে বললেন, ‘সবই ঠিক আছে বুঝলে..., কিন্তু সমস্যাটা হলো...প্রাইভেসি বলে তো আমার আর কিছু থাকল না!’
এই গল্প বলতে বলতে এক বন্ধু হাসতে হাসতে বলল, ‘আচ্ছা বল, “প্রাইভেসি”–এর বাংলা অর্থ কী?’
পাশে থাকা আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। একজন বলল, ‘প্রাইভেসি মানে হলো নিজের মতো করে একটু আড়াল–আবডালে থাকার মতো অবস্থা।’ একজন বলল, ‘একটু একান্ত যাপন’; একজন বলল, ‘ইয়ে, মানে...একটা গোপনীয়তার অবস্থা।’
বন্ধুটি বলল, ‘না, আমি সোজাসাপটা বাংলা প্রতিশব্দ জানতে চাচ্ছি। “আই” মানে “আমি” “ইট” মানে “খাই” “রাইস” মানে “ভাত” টাইপের প্রতিশব্দ।’
একজন বলল, ‘নির্জনতা’; একজন বলল, ‘নিভৃতি’।
প্রশ্নকারী সবাইকে বলল, ‘এবার তোরা ভেবে বল দেখি, “প্রাইভেসি” কথাটা বললে অর্থ হিসেবে আমরা চট করে যা বুঝতে পারি, তা কি এসব বাংলা শব্দ দিয়ে বুঝতে পারি?’
সবাই না–সূচক ঘাড় নাড়লাম।
বন্ধুটি বলল, ‘এর কারণ কী, জানিস? কারণ, প্রাইভেসির চর্চা বলতে যা বোঝায়, সেই জিনিস এ দেশে নেই। সেই কারণে প্রাইভেসির কোনো মোক্ষম বাংলা হয় না। যদি প্রাইভেসির চর্চা থাকত, তাহলে তার একটা জুতসই বাংলাও থাকত।’
কথাটা শতভাগ না হলেও ৯৯ ভাগ সঠিক। কারণ, এই দেশে যে বাড়ির দেয়াল-পাঁচিল নেই, যে বাড়িতে চাইলেই ঢোকা যায়, সে বাড়িতে ‘ও ভাই! বাড়ি আছেন নাকি!’...বলতে বলতে কারও কোনো অনুমতি-টনুমতির তোয়াক্কা না করে বাড়িমালিকের একেবারে শোবার ঘরে পরিচিত বা প্রতিবেশীরা ঢুকে পড়তে পারেন। এর মধ্যে তাঁরা খুব একটা অভব্যতা-অস্বাভাবিকতা দেখেন না। যা দেখেন, তার একটি গালভরা নাম আছে, সেটি হলো ‘সম্পর্কের দাবি’।
সম্পর্ক জিনিসটা দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু ধরা–ছোঁয়া যায়, এমন অস্তিত্বনির্ভর চলমান জিনিসের মতোই সম্পর্ক নিয়তপরিবর্তনশীল এবং চলমান। সম্পর্কের গতি আছে। সম্পর্ক চলতে থাকে। চলতে চলতে তা সুসম্পর্কে রূপ নিতে পারে। সুসম্পর্ক চলতে চলতে আবার খারাপ সম্পর্কেও মোড় নিতে পারে। সম্পর্কের স্বাদও আছে। সেই স্বাদও পরিবর্তনশীল। আজকে যে সম্পর্ক চিনির মতো মিষ্টি, কালকে তা তুঁতের মতো তিতা। এই সুসম্পর্ক অনেক সময় ‘অন্তরঙ্গ সম্পর্কে’ মোড় নিতে পারে। বিশেষ করে মানব-মানবীর মধ্যে যখন সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি হয়, তখনই প্রাইভেসি প্রসঙ্গ জোরালো হয়ে ওঠে।
অন্তরঙ্গ সম্পর্ক প্রকাশিত হয় কোনো নিভৃত পরিসরে, যেখানে কেউ ‘ও ভাই, আছেন নাকি!’ বলে হুট করে ঢুকে পড়তে পারেন না। দশজনের দৃষ্টির আড়ালে যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হয়, সেই সম্পর্ক আড়ালেই থাকবে—এমন একটা অলিখিত, অঘোষিত অঙ্গীকারনামায় উভয় পক্ষের অদৃশ্যমান সই থাকে। সম্পর্ক ভেস্তে যেতে পারে, কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের বিচারে কোনোভাবে সেই অঙ্গীকার ভাঙার নৈতিক বৈধতা নেই।
আমার প্রাইভেসি বা নিভৃতিকে আমি যদি পাবলিক প্রোপার্টি হিসেবে উন্মুক্ত করি, তো তাতে কার কী? এমন কথা আমি বলতেই পারি। কিন্তু সেই গোপনীয়তা উন্মোচনে যদি আরেকজনের গোপনীয়তা উন্মোচিত হয়, আর তাতে যদি সে বিপন্ন বোধ করে, তাহলেই যৌথ নিভৃতির ধারণা বিপন্ন হয়।
প্রায় দুই দশক আগে পড়া সুইস অভিনেত্রী উরসুলা আন্দ্রেজের একটি সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ছে। সেখানে তিনি বলেছিলেন, হলিউড অভিনেতা মার্লেন ব্র্যান্ডো একবার তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, তিনি (ব্র্যান্ডো) আত্মজীবনী লিখছেন। সেখানে তিনি যেসব নারীর সঙ্গে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটিয়েছিলেন, সেসব প্রসঙ্গ বিশদভাবে রাখতে চান। উরসুলার সঙ্গে তাঁর সে ধরনের সম্পর্ক হয়েছিল। ব্র্যান্ডো জানতে চেয়েছিলেন, উরসুলার কথা আত্মজীবনীতে তিনি রাখতে চান এবং তাতে তিনি (উরসুলা) সম্মতি দেবেন কি না। উরসুলা তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বলে দেন। পারস্পরিক সম্মতির জোরে ব্র্যান্ডো ও উরসুলার সেই অন্তরঙ্গ সম্পর্ক বইয়ের পাতায় চিত্রায়িত হয়।
প্রশ্ন হতে পারে, যাঁদের নিয়ে লেখা হলো, তাঁরাই যখন চুপ, তখন এটি নিয়ে এত কথার কী আছে? জবাবটি হতে পারে—এই বইটি যেহেতু একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেহেতু এ ধরনের বই আরও আসতে পারে। যদি আসে এবং একের পর এক এ ধরনের বই আসতেই থাকে, তাহলে প্রাইভেসি বা ব্যক্তির নিভৃতির প্রতিষ্ঠিত ধারণাটি ধসে যাবে।
বইমেলায় জন্ম ও যোনির ইতিহাস নামের একটি বই বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর দ্বিপক্ষীয় অন্তরঙ্গ সম্পর্কের আড়ালকে একপক্ষীয়ভাবে উন্মোচন করা কতটা উচিত, কতটা নয়—তা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তর্ক চলছে। বইটি একজন নারী লিখেছেন। তিনি বিদেশে থাকেন। বাংলাদেশে থাকাকালে এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সম্পর্কের কথা বইটিতে আছে। একাধিক ব্যক্তি তাঁকে যৌন হয়রানি করেছিলেন বলেও তিনি দাবি করেছেন। তিনি যাঁর সঙ্গে ‘শয্যা ভাগ’ করেছেন বলে দাবি করেছেন, তিনি একজন পাবলিক ফিগার। লেখকের দাবি, অন্তরঙ্গ মুহূর্তেই সেই পুরুষ সঙ্গীটি তাঁকে জানিয়েছিলেন, ৫০ জনের বেশি নারীর সঙ্গে তাঁর এ ধরনের সম্পর্ক হয়েছে। লেখকের দাবি অনুযায়ী, সেই অনেক নারীর মধ্যে এমন একাধিক নারীর নাম পুরুষ সঙ্গীটি তাঁকে বলেছিলেন, যাঁদের সবাই একনামে চেনেন।
বইয়ের বর্ণনা অনুযায়ী, ঘটনাটির সাক্ষী চার দেয়ালের নিভৃতি ছাড়া আর কেউ নেই। যাঁদের নাম বলা হয়েছে, তাঁরাও এখনো এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেননি। এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়া–না দেওয়ার পূর্ণ অধিকারও তাঁদের আছে।
প্রশ্ন হতে পারে, যাঁদের নিয়ে লেখা হলো, তাঁরাই যখন চুপ, তখন এটি নিয়ে এত কথার কী আছে? জবাবটি হতে পারে—এই বইটি যেহেতু একটি দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেহেতু এ ধরনের বই আরও আসতে পারে। যদি আসে এবং একের পর এক এ ধরনের বই আসতেই থাকে, তাহলে প্রাইভেসি বা ব্যক্তির নিভৃতির প্রতিষ্ঠিত ধারণাটি ধসে যাবে। অনেকে তখন সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে ‘আত্মজীবনী’ লিখতে শুরু করবেন। তখন যদি গণহারে যে কোনো নারী যে কোনো পুরুষকে নিয়ে, যে কোনো পুরুষ যে কোনো নারীকে নিয়ে উভয়ের আপসভিত্তিক অন্তরঙ্গ মুহূর্তের বিশদ বর্ণনা দিয়ে রগরগে নন-ফিকশন লিখতে শুরু করেন, তখন তার বিরোধিতা করার নৈতিক জোর থাকবে না।
পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর ভর করে অন্তরঙ্গ সম্পর্কের যে মুহূর্তটি দাঁড়িয়ে থাকে, প্রাইভেসি লঙ্ঘনের কুড়ালে সেই বিশ্বাস-ভিত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া স্বাভাবিক সামাজিক আচরণের স্বীকৃতি পেলে বুঝতে হবে, বাঙালি আসলেই প্রাইভেসির মানে বোঝে না।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: sarfuddin2003@gmail.com