একটি ব্যাধি যে কীভাবে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ভাষাকে প্রভাবিত করতে পারে, তার প্রমাণ আমরা বিশ্বসাহিত্য ও সংস্কৃতির দিকে চোখ ফেরালেই দেখতে পাই। আলবেয়ার কামুর বিখ্যাত উপন্যাস প্লেগ-এ এমনই বিষয় নিয়ে রচিত হয়েছে এক ভিন্ন উপাখ্যান। রোগ কীভাবে আমাদের জীবনের মধ্যে ঢুকে পড়ছে, রোগ-ব্যাধির আতঙ্ক কীভাবে আমাদের ভাষায়, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে এবং অস্তিত্বেও ঢুকে পড়ছে—সাহিত্য আমাদের দেখিয়ে দেয়। মহামারি এবং যুদ্ধ না এলে, অস্তিত্ববাদী দর্শনের জন্মই হতো না হয়তো। আদতে সব সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেপথ্যে থাকে বাস্তবের ভাঙাচোরার পৃথিবী। যেমনটি ঘটেছিল বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে, ঠিক তেমনটাই ঘটছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেও। যেভাবে গত শতাব্দীর এই ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ করেছিল অস্তিত্বের অনেকখানি, তেমনই কি হয়েছে এবারের করোনার প্রভাব? একটি ব্যাধিতে সারা বিশ্বের সব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে গেল আতঙ্ক। মারা গেলেন অর্ধ মিলিয়নের বেশি মানুষ, মারা যাচ্ছেন এখনো। চাকরি চলে গেছে অসংখ্য মানুষের। গোটা বিশ্বেরই অর্থনৈতিক অবস্থা চলে গিয়েছিল পতনের দিকে। মানুষের মনোজগতেও পড়ছে নানা রকম প্রভাব।
অন্য সব মহামারির মতোই কোভিড-১৯-এর অভিঘাতও বহুমাত্রিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মন্দা হলো কোভিড-১৯-এর মন্দা। কোভিড-১৯ অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মনোজাগতিক যে পরিবর্তন ঘটাল, তার ব্যাপ্তি ও গভীরতা আগের মহামারিগুলোর চেয়ে বেশি না কম, তা বলা মুশকিল। তুলনা করা কঠিন, কারণ নিয়ত পরিবর্তনশীল এই জীবনে ও জগতে পরিমাপের মাপকাঠিতেও ঘটে গেছে বিশাল পরিবর্তন। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনগুলো কিছুটা পরিমাপ করা গেলেও মনোজগতের পরিবর্তনগুলো পরিমাপ করা প্রায় অসম্ভব।
কোভিড-১৯ মনোজগতে ও সংস্কৃতিতে যে পরিবর্তন এনেছে, তার সবটাই নেতিবাচক নয়। উদাহরণস্বরূপ, জাপানের নাগরিকদের অনেকেরই স্বাভাবিক সময়েও মাস্ক পরার অভ্যাস, কিন্তু ভারত-বাংলাদেশে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময়েও মুখ ঢাকার অভ্যাস অনেক শিক্ষিত লোকেরই নেই। কোভিড-১৯ একজন গরিব কৃষককেও শিখিয়েছে হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় মুখ ঢাকতে। কিছুক্ষণ পর পর স্যানিটাইজেশন করাও আমরা এখন শিখে গেছি এই করোনার বদৌলতেই। বিশ্বজুড়ে চলা এই অতিমারি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড়সড় প্রভাব ফেলে দিয়েছে। সামাজিক দূরত্বের শর্ত মানতে গিয়ে কাছের জনদের সঙ্গ বঞ্চিত হয়ে দীর্ঘদিন কাটানো, জীবিকা নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা ও একাকিত্ব। এমনকি শিশুরাও যার শিকার। বছর দুয়েকের স্বাভাবিক সামাজিক জীবন থেকে বিচ্যুতি মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন আপাতদৃষ্টে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক মনে হলেও সেই আগের সুর যেন ঠিক বাজছে না। আমরা কি তবে একাকিত্বকে, নির্জনতাকে সর্বোপরি স্বেচ্ছানির্বাসনকে মেনে নিতে শিখে যাচ্ছি! তাহলে কি আমাদের অভ্যাস বদলে গেল? আরও যে বিষয়টি সম্ভবত করোনা না এলে আমাদের চিন্তায় আসত না, তা হলো নিজের সঙ্গে সময় কাটানো। সবচেয়ে যে বড় শিক্ষা কোভিড-১৯ আমাদের দিয়ে গেল, তা হলো সমন্বিত জীবনচেতনার শিক্ষা অর্থাৎ আমার ভালো থাকা নির্ভর করে আরেকজনের ভালো থাকার ওপর।
কোভিডকালে বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ, যা গত ছয় দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। কোভিড-১৯-এর একটি বড় ক্ষতিকর প্রভাব হলো, দেশের অভ্যন্তরে ও পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক আর্থিক ও লিঙ্গবৈষম্য বৃদ্ধি। কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে, সৃষ্টি করেছে ভূরাজনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েন, যা আবার বৃদ্ধি করেছে দারিদ্র্য ও বৈষম্য। জ্বালানি তেল, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে শ্রমঘাটতি ও সরবরাহের বিঘ্ন মিলে সৃষ্টি হওয়া মূল্যস্ফীতি লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে পৃথিবীর প্রায় সব দেশে।
আইএমএফের এপ্রিল ২০২১ পূর্বাভাস অনুযায়ী বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২০ সালে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ সংকোচন হয়েছে, যা আদতে অক্টোবর ২০১৯-এর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় জিডিপিতে ৭ শতাংশ হ্রাস। আইএমএফের আওতাধীন সব দেশে ২০২০ সালে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থনীতির এই নিম্নগতি বেশি স্পষ্ট। বিশ্ব অর্থনীতির প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অবশ্য ২০২২-এর ৩ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৯ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৩ দশমিক ১ শতাংশ বাড়বে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।
প্রতিটি মন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে সাধারণত ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়; কিন্তু আমাদের জন্য সুখবর হলো, এবারের মন্দার পরে তা হচ্ছে না। আরও আশার কথা এই যে গত অক্টোবরের পূর্বাভাসের তুলনায় ২০২৩-এর জানুয়ারির পূর্বাভাসে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ০.২ শতাংশ পয়েন্ট বেশি, যা অর্থনীতিগুলোর স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করার ক্ষমতা নির্দেশ করে।
২০২৩ সালে জ্বালানি তেলের মূল্য ১৬ শতাংশ ও অজ্বালানি পণ্যের মূল্য ৬ দশমিক ৩ শতাংশ কমার পূর্বাভাস পাওয়া গেছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ২০২২ সালের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে নেমে ২০২৩ সালে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ আর ২০২৪ সালে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। অবশ্য এসব সংখ্যা এখনো মহামারি-পূর্ব (২০১৭-১৯) মূল্যস্ফীতি, ৩ দশমিক ৫ শতাংশের ওপরে। এ অবস্থায় মুদ্রাস্ফীতির অবস্থা থেকে অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক বা সুস্থিত অবস্থায় ফিরে আসার প্রক্রিয়া শুরু করতে পারাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। মূল্যস্ফীতি দমনে সম্মিলিত উদ্যোগ, ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ ও চীনে কোভিডের পুনরাবির্ভাব ২০২২ সালে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, ২০২২-এর তৃতীয় সপ্তাহে বিস্ময়করভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরো জোন, প্রধান উদীয়মান ও বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশসহ অনেক দেশেই প্রকৃত জিডিপি শক্তিশালী ছিল। তবে জিডিপির এই বিস্ময়কর শক্তিমত্তার কারণগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেশজ, যেমন, প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ব্যক্তিগত ব্যয় এবং কঠোর শ্রমবাজারের মধ্যেও ভালো বিনিয়োগ আর প্রত্যাশার চেয়েও বেশি আর্থিক সহায়তা। অন্যদিকে সরবরাহ লাইনে বাধাগুলো কমে যাওয়ার ও নিম্নগামী পরিবহন খরচের কারণে উৎপাদন ব্যয়ের চাপ হ্রাস পাওয়ায়, মোটর ইন্ডাস্ট্রি, জ্বালানি তেল ইত্যাদি খাত খুব ভালোভাবেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
২০২২ সালের চতুর্থ সপ্তাহে অবশ্য এই ঊর্ধ্বগামী প্রবণতা অধিকাংশ প্রধান প্রধান অর্থনীতিতে ম্লান হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন অর্থনীতি ব্যতিক্রম। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েছে। এখানে ভোক্তারা ব্যাপকভাবে খরচ করছে, বেকারত্বের হার প্রায় ইতিহাসের সর্বনিম্ন ও প্রচুর চাকরির সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশে ব্যবসায়ী ও ভোক্তাদের মনোভাবের মতো উচ্চ-ফ্রিকোয়েন্সি কার্যকলাপের সূচকগুলো নিম্নগতি প্রদর্শন করেছে। চীনে কোভিড-১৯-এর পুনরাবির্ভাবের ফলে সে দেশের অর্থনীতির ধীরগতি বিশ্ববাণিজ্য উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস করেছে। যদিও ২০২২ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিধিনিষেধ শিথিল করার পর চীনের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর পরপরই বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন করে গতির সঞ্চার হয়েছে।
প্রতিটি মন্দার পর বিশ্ব অর্থনীতিতে সাধারণত ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়; কিন্তু আমাদের জন্য সুখবর হলো, এবারের মন্দার পরে তা হচ্ছে না। আরও আশার কথা এই যে গত অক্টোবরের পূর্বাভাসের তুলনায় ২০২৩-এর জানুয়ারির পূর্বাভাসে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ০.২ শতাংশ পয়েন্ট বেশি, যা অর্থনীতিগুলোর স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করার ক্ষমতা নির্দেশ করে। একদিকে উন্নত অর্থনীতি আর অন্যদিকে উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির পুনরুদ্ধার দুই রকম। উন্নত অর্থনীতিগুলোতে প্রবৃদ্ধিতে অধোগতি ২০২২ সালে ২.৭% আর ২০২৩ সালে ১.২% কিন্তু ২০২৪ সালে গিয়ে জিডিপি বৃদ্ধি পাবে ১.৪%। পক্ষান্তরে, উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে পূর্বাভাস হলো, ২০২২ সালে ৩.৯%, ২০২৩ সালে ৪.০% এবং ২০২৪ সালে ৪.২% হারে প্রবৃদ্ধি হবে। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির প্রায় অর্ধেকে ২০২২-এর তুলনায় ২০২৩ সালে প্রবৃদ্ধি কম হবে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯-এর অভিঘাত অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় কম যদিও সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা যে সরকার খুব ভালোভাবে করতে পেরেছে, বলা যাবে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে ২০২২-এর দ্বিতীয়ার্ধে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়, ফলে বেড়ে যায় বাণিজ্যঘাটতি এবং দেশের অভ্যন্তরেও দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক বৃদ্ধি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২২ সালের আগস্টের শেষে নেমে আসে ৩৮.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। প্রকৃত জিডিপি বৃদ্ধি ২০২৩ অর্থবছরে কমে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, আমদানি হ্রাস করার ব্যবস্থা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত করে। তবে আশার কথা কথা হচ্ছে, মধ্য মেয়াদে বাংলাদেশে বৈদেশিক বাণিজ্যে উদ্বৃত্ত হবে বলে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস।
২০৩১ সাল নাগাদ উচ্চ মধ্য-আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য পূরণ করতে হলে বাংলাদেশকে এখনই বেশ কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ প্রচুর চাকরি সৃষ্টি করা, মানবসম্পদ ও দক্ষ শ্রমশক্তি সৃষ্টি করা, আধুনিক অবকাঠামো তৈরি করা এবং বিনিয়োগ আকর্ষণ করে এমন নীতি তৈরি না করতে পারলে লক্ষ্য পূরণ হবে না। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনগুলো প্রণিধানযোগ্য: শুধু তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর নির্ভরশীল না থেকে রপ্তানি বহুমুখী করা, আর্থিক খাতের সংস্কার ও বিচক্ষণ পরিচালনা, নগরায়ণকে আরও টেকসই করা, অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বাড়ানো, রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা, জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি মোকাবিলার সক্ষমতা আরও বাড়ানো এবং সর্বোপরি, ‘গ্রিন ইকোনমির’ দিকে যাত্রা করা।
ড. এন এন তরুণ ইউনিভার্সিটি অব বাথ, ইংল্যান্ড। সাউথ এশিয়া জার্নালের এডিটর অ্যাট লার্জ। বেবী সাউ রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক।