মতামত

বিরোধীদের ঐক্য ঠেকাতে এবারে বিজেপির দুই কৌশল

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

শুণ্ডির রাজাকে হাল্লার রাজা শুধিয়েছিলেন, ‘রাজকন্যে কি কম পড়িতেছে?’ বিজেপিকে সেই প্রশ্ন একটু অন্যভাবে করা যেতে পারে, ‘সঙ্গী কি কম হইতেছে?’ হয়তো তা-ই। বিজেপি হন্যে হয়ে সঙ্গী খুঁজছে নিজের প্রতি আস্থা কিছুটা টাল খেয়েছে বলে।

নইলে পাঁচ বছর অনুচ্চারিত ‘ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স’ বা এনডিএ জোটকে এভাবে আবাহন করবে কেন? কেনই-বা ‘৩৮টি দল আমাদের সঙ্গী’ বলে দলের সভাপতির গর্বমিশ্রিত হুংকার?

বিরোধী জোট গঠনের দ্বিতীয় বৈঠক হলো ১৭ ও ১৮ জুলাই। বেঙ্গালুরুতে। তার মোকাবিলায় ওই সময়েই দেখা গেল এনডিএ পুনরুজ্জীবনের তৎপরতা, ১৯৯৮ সালে বিজেপি যা গড়েছিল। উপলক্ষ, রজতজয়ন্তী উদ্‌যাপনের নামে অবহেলিত সঙ্গীদের বাবা-বাছা করা। তাড়না হ্যাটট্রিকের।

এই তাগিদের কারণ একাধিক এবং তার মধ্য দিয়ে কয়েকটি বিষয় প্রমাণিত। প্রথমত, বিরোধীদের জোট গঠনের উদ্যোগকে বিজেপি আর হেলাফেলা করছে না। বুঝেছে, লোকসভা ভোটে বিরোধীরা একটা জোটবদ্ধ চ্যালেঞ্জ ছুড়তে চাইছে। সে জন্য কংগ্রেসও বেশ নমনীয়। এর মোকাবিলায় বিজেপিকেও শরিক জোটাতে উদ্যোগী হতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এনডিএর পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ বোঝাচ্ছে বিজেপি নিজের শক্তি ও ক্ষমতার ওপর আগের মতো আর ভরসা রাখতে পারছে না। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বসহ বিভিন্ন অসন্তোষ মোদি-ম্যাজিকের মায়াজাল কিছুটা ফিকে করেছে, ১০ বছর ক্ষমতায় থাকলে যা স্বাভাবিক। তৃতীয়ত, তাদের জরিপ অনুযায়ী যেকোনো পরিস্থিতিতে বিজেপিকে ভোট দেবেই—এমন ‘ক্যাপটিভ সাপোর্ট বেজ’ ৩০ শতাংশের বেশি নয়। মোদির নাম-মাহাত্ম্য, সাংগঠনিক শক্তি মিলিয়ে আসবে আরও ৫ শতাংশ।

কিন্তু সম্মিলিত বিরোধীদের মোকাবিলায় বাড়তি আরও অন্তত ১০ শতাংশ ভোট প্রয়োজন। সে জন্য শরিক জোটানো দরকার। চতুর্থত, দলের বর্ণবাদী প্রাধান্য বিস্তারজনিত সমস্যা প্রকট হচ্ছে। গোবলয়ে শুধু উচ্চবর্ণের প্রাধান্যের কুফল তাদের জানা। সে কারণে ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’, অর্থাৎ জাতভিত্তিক ছোট ছোট শক্তি কাছে টানা দরকার। পাঁচ বছর দুয়োরানি করে রাখা শরিকদের কাছে টানার তাই এত তাগিদ। নতুন সঙ্গী জোটাতে এমন আকুতি।

ঘর ভাঙানোর খেলায় কংগ্রেসও বিজেপির টার্গেট। কিন্তু কর্ণাটকের সাফল্যের পর রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের কোন্দল মিটিয়েছেন মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধী। তা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সক্রিয়। অর্থনীতির অমোঘ বিধান, ‘এক টাকা সাশ্রয়ের অর্থ এক টাকা বাড়তি আয়’ তাদের মূলমন্ত্র। বিরোধীদের শক্তিক্ষয়ের অর্থ বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি।

জোট বাঁধতে বিজেপির অসুবিধা তুলনায় কম। কারণ, জোটের নেতৃত্বদানের প্রশ্নে কোনো দ্বিমত নেই। মোদিকে সামনে রেখে এধার-ওধার সামান্য দানখয়রাতি করে তারা কাজ হাসিল করতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার ইদানীং রাজনীতি প্রায় পুরোটাই দেনা-পাওনানির্ভর। আদর্শ বা নীতির বালাই নেই। শরিকদের দেনদরবার মেটানো সম্পদশালী ও ক্ষমতাবান বিজেপির কাছে নস্যি। তা ছাড়া তাদের মুখের ওপর ‘না’ বলা ছোট দলের পক্ষে বেশ কঠিন। সিবিআই, ইডির ভয় ‘নতুন ভারতে’ সর্বব্যাপী।

বিজেপি যেমন ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়, ছোট ও প্রান্তিক দলগুলোর তেমন অস্তিত্ব রক্ষার তাড়না প্রবল। দুই পক্ষের সেই তাগিদ কতখানি বোঝা যায় কর্ণাটক দেখে। কর্ণাটকের বিধানসভা নির্বাচনে কোণঠাসা হয়েছে জেডিএস।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার তৈরি পরিবারভিত্তিক এই দল নিছক বেঁচে থাকার তাগিদে বিজেপির দিকে তীর্থের কাকের মতো চেয়ে আছে। বিপর্যস্ত বিজেপিও হাত বাড়াতে আগ্রহী। গরজ তাদেরও। এনডিএ জোটে যোগ দেওয়া না-দেওয়ার চেয়েও বড় কথা, লোকসভা ভোটে বিজেপির সঙ্গে সমঝোতায় না গেলে বিপন্নতা বাড়বে।

বিজেপিকে এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে কংগ্রেস। তাদের বলিরেখা গাঢ় করেছে কর্ণাটক বিধানসভার ফলাফল। কংগ্রেস শুধু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতাই পায়নি, সিদ্ধারামাইয়া-শিবকুমার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে রাজ্য পরিচালনাও করছে হোঁচট না খেয়ে। প্রায় অপস্রিয়মাণ এনডিএকে জিয়নকাঠির ছোঁয়ায় জাগিয়ে তোলার তাগিদ তখন থেকেই। বিজেপি বুঝেছে, মোদির অবস্থান অপরিবর্তিত রাখতে হলে ২০১৯ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে হবে। সে জন্য ভোটের পাটিগণিত ও রসায়ন—দুটিই ঠিক করা জরুরি। নইলে নির্ভরশীল হতে হবে অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর।

বিজেপির নজরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি রাজ্য কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র ও বিহার। এই তিন রাজ্যে লোকসভার মোট আসন ১১৬। গতবার কর্ণাটকের ২৮টির মধ্যে ২৬, মহারাষ্ট্রের ৪৮টির মধ্যে ৪১ ও বিহারের ৪০টির মধ্যে ৩৯ আসন জিতেছিল বিজেপি ও তার সহযোগীরা। ১১৬ আসনের মধ্যে ১০৬টি পেয়ে নিজেদের তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিল। এই তিন রাজ্যের বাইরে গুজরাট, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, দিল্লি, হরিয়ানা, উত্তরাখন্ড, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে তাদের প্লাবনে ভেসে গিয়েছিল অন্যরা।

এই রাজ্যগুলোয় এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মোট ২৫ আসনে বিজেপির আসন বাড়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। পাবেই–বা কী করে? গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, দিল্লি, হিমাচল প্রদেশ ও উত্তরাখন্ডের ৭৭ আসনের মধ্যে বিজেপি একটিও অন্য কাউকে দেয়নি। মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ের মোট ৪০টি আসনের মধ্যে বিজেপি জেতে ৩৭টি, উত্তর প্রদেশের ৮০টির মধ্যে জোটসঙ্গী নিয়ে ৬৪টি। বিজেপির অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদন অনুযায়ী গতবারের ফল ধরে রাখা আগামীবার কঠিন। কারণগুলো আগেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তা ছাড়া ‘পুলওয়ামাও’ বারবার ঘটবে না। তা হলে উপায়?

প্রথম উপায় এনডিএ জাগানো। দ্বিতীয় উপায় বিরোধীদের দল ভাঙানো। দুটি কাজই তারা শুরু করে দিয়েছে। প্রথম হানা মহারাষ্ট্রে। কংগ্রেসের সঙ্গী শিবসেনা ও এনসিপির ঘর ভেঙে দিয়েছে। ভাঙতে চাইছে কংগ্রেসকেও। বিজেপির দ্বিতীয় লক্ষ্য বিহার। নীতীশ কুমার আরজেডির হাত ধরায় যাঁরা অখুশি, বিজেপি তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়েছে।

ইতিমধ্যেই আর পি সিং জেডিইউ ছেড়ে বিজেপিতে গিয়েছেন। উপেন্দ্র কুশওয়া আলাদা দল গড়ে এনডিএতে যাচ্ছেন। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জিতেন রাম মাজি বিজেপিকে সঙ্গ দিচ্ছেন। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশের ঘনিষ্ঠ নেতা নাগমণি কয়েক দিন আগে দেখা করেছেন অমিত শাহর সঙ্গে।

বিজেপি প্রস্তাব দিয়েছে নীতীশের অতি বিশ্বস্ত রাজীব রঞ্জন সিংকেও। নীতীশ বুঝতে পারছেন, মহারাষ্ট্রে শরদ পাওয়ারের মতো বিজেপি তাঁকেও ঘিরে ফেলছে চারদিক থেকে। এরই পাশাপাশি প্রবল চাপে রাখা হয়েছে উপমুখ্যমন্ত্রী তেজস্বী যাদবকে। ‘জমির বদলে চাকরি’ মামলায় কয়েক দিন আগে সিবিআই তেজস্বীর বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছে।

ঘর ভাঙানোর খেলায় কংগ্রেসও বিজেপির টার্গেট। কিন্তু কর্ণাটকের সাফল্যের পর রাজস্থান ও ছত্তিশগড়ের কোন্দল মিটিয়েছেন মল্লিকার্জুন খাড়গে ও রাহুল গান্ধী। তা সত্ত্বেও মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সক্রিয়। অর্থনীতির অমোঘ বিধান, ‘এক টাকা সাশ্রয়ের অর্থ এক টাকা বাড়তি আয়’ তাদের মূলমন্ত্র। বিরোধীদের শক্তিক্ষয়ের অর্থ বিজেপির শক্তিবৃদ্ধি।

বিজেপি এখনো বিশ্বাস করে, বিধানসভায় যা–ই হোক, দেশ চালানোর দায়িত্ব মানুষ মোদিকেই দেবে, যেমন ২০১৯ সালে দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নিশ্চিন্তে নেই।

তাই জোটছুট পাঞ্জাবের অকালি দল, অন্ধ্র প্রদেশের তেলেগু দেশম, উত্তর প্রদেশের সুহেলদেব ভারতীয় পার্টি ও নিষাদ পার্টি, বিহারের হিন্দুস্তান আওয়াম মোর্চা ও লোকজনশক্তি পার্টি, কর্ণাটকের জেডিএস, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা ও এনসিপিকে তারা কাছে টেনেছে। ঘটা করে এনডিএকে সক্রিয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। লক্ষ্য একটাই, লোকসভা জয়ের হ্যাটট্রিক করে নেহরুর পাশে মোদির আসন পেতে দেওয়া।

বিজেপি সঙ্গীহীন নয়, কিন্তু আরও সঙ্গীর প্রয়োজন। শুধু মোদির ভরসায় না থেকে এনডিএর নামাবলি তাই গায়ে জড়িয়েছে। দশের লাঠি সব সময় একের বোঝা।

  • সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি