বিভিন্ন সময়ে ছাত্রসংগঠনের নেতারা আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। হল ব্যবহার করে তাঁরা যেমন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করেছেন, তেমনি নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজও করেছেন। যখন যে দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থেকেছে, মূলত সে দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠন আধিপত্য বিস্তার করেছে। হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাত্রনেতাদের কাছে একরকম ‘জিম্মি’ হয়ে থেকেছেন। যে নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনের থাকার কথা, সে নিয়ন্ত্রণ ছাত্রনেতাদের হাতে কীভাবে যায়, সেটি বুঝেও সবাই মুখ বুজে থাকতেন।
দেশের স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কার্যত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের একটি অংশ গণরুমে কোনোরকমে রাত কাটাতেন। প্রশাসনিকভাবে ‘গণরুম’ বলতে কিছু নেই। গণরুম আসলে কী, সেটি হলে না থাকলে বোঝা সম্ভব নয়। ছাত্রনেতারা নিজেদের শক্তি ও ক্ষমতাবলে কিছুসংখ্যক কক্ষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেন। সেখানে মেঝেতে গাদাগাদি করে শিক্ষার্থীদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতেন। এভাবে ৪ জনের বসবাসের উপযোগী একটি কক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ জনকেও ওঠানো হতো। পড়াশোনা করার অবস্থা সেখানে কতটুকু আছে, এ থেকেই উপলব্ধি করা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর আগে হলগুলোর তথ্য ডিজিটালাইজেশন করার উদ্যোগ নিয়ে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। হলের কোন কক্ষে কোন শিক্ষার্থী বা কোন কোন শিক্ষার্থী থাকেন, তার তালিকা সম্পূর্ণ করা যায়নি। মূলত ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের অসহযোগিতার কারণে এটি সম্ভব হয়নি। যেসব কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব কক্ষে কারা থাকতেন, এটা হল প্রশাসন জানত না। আবার হল প্রশাসনের কাছে অন্যান্য কক্ষে অবস্থানকারী শিক্ষার্থী সম্পর্কে যে তথ্য থাকত, বাস্তবে তার সঙ্গে প্রায় ক্ষেত্রেই মিল থাকত না। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর এই তালিকা হালনাগাদ করার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীর পক্ষে বাড়তি খরচ করা সম্ভব হয় না। তাঁদের পক্ষে আশেপাশের মেস বা বাসাবাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আবাসিক হলে থাকার জন্য তাঁরা এই অনিয়মকে স্বীকার করে কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছিলেন। মূলত রাজনীতিতে ‘ব্যবহৃত’ হওয়ার শর্তে সাধারণ শিক্ষার্থীরা এভাবে হলে থাকার সুযোগ পেতেন। এসব ছাত্রকে মিছিল-মিটিং ও রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে বাধ্য করা হতো।
এমনকি এই শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেই চাঁদাবাজি, টেন্ডার–বাণিজ্য, নিয়োগ–বাণিজ্য, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের শক্তি পেতেন ছাত্রনেতারা। অনিচ্ছায় হলেও ছাত্রসংগঠনগুলোর অনৈতিক বা অন্যায় কাজের ক্রীড়নক হতে হতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এমন পরিস্থিতি প্রকট হয়ে উঠেছিল। ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসগুলো ও এর আবাসিক হলগুলোর কী পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছিল, তা আমাদের কারও অজানা নয়।
প্রায় প্রতিটি হলের গেস্টরুমকে ব্যবহার করা হতো প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানার’ বা আদবকেতা শেখানোর প্রশিক্ষণশালা হিসেবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রীতিমতো ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল। তা ছাড়া প্রতিটি হলেই ছিল টর্চার সেল। কোনো শিক্ষার্থী ‘অবাধ্য’ হলে তাঁকে সেখানে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। পত্রপত্রিকায় ও সংবাদমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার, এমনকি মারা যাওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়েছে। নির্যাতনের অভিযোগে হল প্রশাসনের পক্ষ থেকে হয়তো কখনো কখনো কাউকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে এমনও দেখা গেছে, সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার পদ নিয়ে তিনি আবার হলে ফিরে এসেছেন!
আবাসিক হলগুলোর প্রচুরসংখ্যক কক্ষ ছাত্রনেতাদের দখলে ছিল। এসব কক্ষ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনকে একরকম অন্ধকারেই থাকতে হয়েছে। কারণ, হলের প্রভোস্ট কিংবা আবাসিক শিক্ষকেরা এসব কক্ষে ঢুকতে পারতেন না। হলে অবস্থানকারী অছাত্র বা বহিরাগতদের বিষয়েও হল প্রশাসনের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। ক্যাম্পাসে থেকে তাঁরা আশপাশের এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালাতেন, টেন্ডারবাজি করতেন। নেতার বদল হলে হল নিয়ন্ত্রণেরও হাতবদল ঘটেছে। তবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন চলেছে আগের মতোই।
আবাসনসংকটের জন্য কিছু সাধারণ শিক্ষার্থীও দায়ী। তাঁরা পড়াশোনা শেষ করেও হলে অবস্থান করেন। কেউ কেউ সিট ধরে রাখার জন্য এমফিল বা পিএইচডিতে ভর্তি হন। কিন্তু ডিগ্রি সম্পন্ন না করে কয়েক বছর ধরে হলে থাকার সুবিধা ভোগ করতে থাকেন। আবাসনসংকট নিরসনের জন্য এবং অবৈধ শিক্ষার্থীদের বহিষ্কারের জন্য কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করেছেন। আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কখনো কখনো আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নতুন হল নির্মাণ করা হলে আবাসনসংকট কমে যাবে। তবে বাস্তবতা এ–ই, সংকট কমেনি। কারণ, সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষার্থীরা মূলত দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষে গিয়ে থাকার জন্য সিট বরাদ্দ পেয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রেও দেখা যায়, যেসব শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে কষ্ট করে হলে থেকেছেন, মূলত তাঁরাই সিট পেয়েছেন। তবে হল প্রশাসন কোনো শিক্ষার্থীকে সিট বরাদ্দ দিলেও সেই সিটে ওঠার নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। আর সিট পাওয়া মানে একজনের বিছানায় দুজন ভাগ করে থাকা। কখনো কখনো মেঝেতে বিছানা করেও থাকতে হয়। পূর্ণ আবাসিক নামে চলছে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়, সেগুলোতেও প্রায় একই রকম অবস্থা। পড়াশোনা করার জন্য শিক্ষার্থীদের নিজের কক্ষ ছেড়ে রিডিংরুম বা লাইব্রেরিতে যেতে হয়। ছাত্রী হলগুলো পরিচালনা করার ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু শৃঙ্খলা দেখা যায়।
আবাসনসংকট সত্যিই দূর করতে হলে হলগুলোকে নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। কেবল নতুন হল নির্মাণ করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাময়িকভাবে এই সংকট কিছুটা দূর হয়েছে। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীন নেতাদের খবরদারি ও নির্যাতন নেই। কিন্তু ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সরকার এলে এ রকম অবস্থা থাকবে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই শিক্ষার্থীর মেধা ও প্রয়োজনকে বিবেচনায় নিয়ে এখনই সিট বরাদ্দের পদ্ধতি ঠিক করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এর আগে হলগুলোর তথ্য ডিজিটালাইজেশন করার উদ্যোগ নিয়ে পুরোপুরি সফল হতে পারেনি। হলের কোন কক্ষে কোন শিক্ষার্থী বা কোন কোন শিক্ষার্থী থাকেন, তার তালিকা সম্পূর্ণ করা যায়নি। মূলত ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের অসহযোগিতার কারণে এটি সম্ভব হয়নি। যেসব কক্ষ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব কক্ষে কারা থাকতেন, এটা হল প্রশাসন জানত না। আবার হল প্রশাসনের কাছে অন্যান্য কক্ষে অবস্থানকারী শিক্ষার্থী সম্পর্কে যে তথ্য থাকত, বাস্তবে তার সঙ্গে প্রায় ক্ষেত্রেই মিল থাকত না। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পর এই তালিকা হালনাগাদ করার কাজ অনেক দূর এগিয়েছে।
প্রতিটি কক্ষে অবস্থানকারী শিক্ষার্থীর তথ্য এবং সিট বরাদ্দের তথ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত করা উচিত। এতে অনিয়মের সুযোগ কমে যাবে। তা ছাড়া শিক্ষার্থীর আবাসনসুবিধার প্রয়োজন আছে কি না, তা ভর্তির সময়ই তাঁর কাছ থেকে জেনে নেওয়া যেতে পারে। আবাসিক হলগুলোয় শূন্য হওয়া আসনগুলোয় মেধার ভিত্তিতে শিক্ষার্থীকে কক্ষ বরাদ্দ দিতে হবে। পুরো প্রক্রিয়া হবে স্বয়ংক্রিয়। এখানে শিক্ষক বা অন্য কারও সুপারিশ বিবেচনা করার সুযোগ রাখা যাবে না।
আবাসিক হলের কক্ষগুলোয় পড়াশোনার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য সবার আগে দরকার সিট বরাদ্দের ক্ষেত্রে সব ধরনের অনিয়ম দূর করা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যে সুযোগ সামনে এসেছে, তাকে কাজে লাগানো সম্ভব না হলে ভবিষ্যতে সংকট আরও বাড়তে পারে।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক