সম্ভাবনার চায়ে কৃষকের কান্না 

সমতলের চা–শিল্পে ক্ষুদ্র চা–চাষি অন্তত ১০ হাজার। ৫ বছর আগে প্রতি কেজি কাঁচা চা-পাতা ২৬-৩৯ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা এখন ১৪-১৬ টাকা।

ক্ষুদ্র চা–চাষি জাহাঙ্গীর আলম লোকসান সামলাতে গত বছর দেড় একরের একটি চা–বাগান ১০ লাখ টাকায় বন্ধক রেখেছেন। গত ১৪ মে পঞ্চগড় সদরের সোনারবান গ্রামে

উত্তরের জেলা পঞ্চগড় থেকে সমতলে সম্ভাবনার চা চাষের যাত্রা শুরু হয় ২০০০ সালে। বর্তমানে জাতীয় চা উৎপাদনে সমতলের অবদান প্রায় ১৯ শতাংশ। কিন্তু সমতলের চা–চাষিরা ভালো নেই। তাঁরা বলছেন, তিন বছর ধরে কাঁচা চা–পাতার দাম কমার কারণে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ বেশি লোকসানে পড়ে চা–বাগান বন্ধক রেখেছেন।

দাম কমার কারণ হিসেবে চাষি ও চা কারখানামালিকেরা পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন। কৃষকদের অভিযোগ, কারখানাগুলো যোগসাজশ করে ঠকাচ্ছে। কারখানামালিকদের দাবি, কৃষকেরা মানসম্মত পাতা সরবরাহ করতে পারছেন না।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্যমতে, উত্তরাঞ্চলের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও দিনাজপুরে ১২ হাজার ৭৯ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। পঞ্চগড়ে চাষ হচ্ছে ১০ হাজার ২৩৯ একর জমিতে। ক্ষুদ্র চা–চাষি অন্তত ১০ হাজার।

দামের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি

পঞ্চগড়ের ৫ উপজেলায় ক্ষুদ্র চা–চাষি আছেন ৫ হাজার ৯৫০ জন। তাঁদের মধ্যে পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারি ও তেঁতুলিয়ার উপজেলার ৮ গ্রামের অন্তত ৭০ জন চা–চাষির সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। কৃষকদের দাবি, কাঁচা চা–পাতা বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না।

নিয়ম অনুযায়ী, নিলামবাজারের তিনটি নিলামে তৈরি চায়ের গড় দাম অনুযায়ী কাঁচা চা–পাতার মূল্য নির্ধারিত হয়। জেলা কাঁচা চা–পাতা মূল্য নির্ধারণ কমিটি গত বছর প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতার সর্বনিম্ন দাম ঠিক করে ১৮ টাকা।

তবে কৃষকেরা বলছেন, বর্তমানে প্রতি কেজি পাতা কারখানাগুলো কিনছে ১৪-১৬ টাকায়। অথচ পাঁচ বছর আগে ২৬-৩৯ টাকায় বিক্রি হতো। কৃষকদের ভাষ্য, সার-কীটনাশকের মূল্যবৃদ্ধি ও এবারের খরায় বাড়তি সেচের কারণে প্রতি কেজি কাঁচা চা–পাতাতে ১২-১৩ টাকা উৎপাদন খরচ হচ্ছে। প্রতি কেজি চা–পাতা তুলতে শ্রমিকদের দিতে হয় ৩ টাকা। পাশাপাশি কারখানাগুলো নানা অজুহাতে (ভেজা, নিম্নমানের, কাণ্ডসহ কর্তন) কাঁচা চা–পাতার প্রকৃত ওজন থেকে ২০-৩০ শতাংশ কর্তন করে। একদিকে দাম কম, অন্যদিকে ওজনে ঠকে তাঁরা লোকসানে পড়ছেন।

পঞ্চগড়ের চা–চাষি অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি সাইদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, বাগানমালিকেরা চা কারখানাগুলোর কাছে পাতা বেচতে গেলে নিতে চান না। বেশি লাভের জন্য পাইকার প্রথা বা মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রতিবছর মৌসুম শুরুর আগে (মার্চ থেকে ডিসেম্বর) মূল্য নির্ধারণী সভা হলেও এবার হয়নি।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক ও কাঁচা চা–পাতা মূল্য নির্ধারণী কমিটির সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেছেন, শিগগির সভা ডেকে বিষয়টির সমাধানের চেষ্টা করবেন।

ঋণের জালে কৃষকেরা

পঞ্চগড় সদরের সোনারবান গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম (৬০) একজন ক্ষুদ্র চা–চাষি। লোকসান সামলাতে গত বছর তিনি দেড় একরের একটি চা–বাগান ১০ লাখ টাকায় বন্ধক রেখেছেন। গত ১৪ মে দুপুরে নিজ বাড়ির উঠানে জাহাঙ্গীর প্রথম আলোকে বলেন, চা–বাগান করতে গিয়ে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। বাগান রাখবেন কি না, ভাবছেন।

পরদিন সকালে সদর উপজেলার চাকলাহাট বাজারে অন্তত ১৫ জন চাষির সঙ্গে এ দুই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের দাবি ছিল, বাগান বন্ধক ও ঋণ নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

পঞ্চগড়ের চা–কারখানার মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ বট লিফ টি ফ্যাক্টরি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নিয়াজ আলী দাবি করেন, ভালো চা উৎপাদন করতে দুটি পাতা, একটি কুঁড়ি তুলতে হয়। কিন্তু কাস্তে দিয়ে কাটার ফলে অনেক সময় ডালসহ আট-নয়টি পাতা তোলা হয়। আর প্রতি রাউন্ডে ৪০-৪৫ দিন পরপর পাতা তোলায় পাতা পোক্ত হয়ে যায়। ফলে চায়ের মান খারাপ হয়।

তবে চা–চাষি সমিতির নেতাদের অভিযোগ, কিছু কারখানা তাদের উৎপাদিত ভালো মানের চা কালোবাজারে বিক্রি করে। আর নিলামকেন্দ্রে নিয়ে যায় নিম্নমানের চা। অবশ্য নিয়াজ আলীর দাবি, ছোট কিছু কারখানা এ রকম করতে পারে।

হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের অধ্যাপক মো. ফারুক হাসান প্রথম আলোকে বলেন, পঞ্চগড়ে কী পরিমাণ জমিতে চা চাষ হবে, তার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছিল না। এখন কৃষকের স্বার্থে কাঁচা চা–পাতার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে প্রশাসন ও চা বোর্ডকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে হবে।