মাটি হলো পরিবেশের অন্যতম মূল অংশ ও জীবনের ভিত্তি। আমাদের দেশের উন্নয়নের খড়্গ এই মৃত্তিকা বা মাটির ওপরেই নির্ভর করছে। এই কৃষিজমির মাটিই জীবিত ও উর্বর, যাকে বাঁচালে পরিবেশ ও দেশ বাঁচবে। পরিবেশ বাঁচলে রক্ষা পাবে জীব ও উদ্ভিদজগৎ। আবাদি জমির মাটি ফসলকে পুষ্টি সরবরাহ করে, পানিকে ফিল্টার করে, বন্যা থেকে রক্ষা করে এবং খরার বিরুদ্ধে লড়াই করে। বিলিয়ন জীবের বাসস্থান হিসেবে কাজ করে। আমাদের অ্যান্টিবায়োটিক সরবরাহ করে। মাটি কার্বন সিঙ্ক হিসেবে কাজ করে জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রশমিত করে। অন্যদিকে মাটিতে অতিরিক্ত প্লাস্টিক, কীটনাশক, রাসায়নিক সার ও ভারী ধাতুর উপস্থিতির কারণেও মাটি তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। ফলে ফসল উৎপাদন ও পরিবেশ রক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে না। তাই ২০২৩ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের নেপথ্যে রয়েছে প্লাস্টিক দূষণের সমাধান নিয়ে আরজি।
পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। চীন ৫০ বছর আগে মাটি পোড়ানো ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। ভিয়েতনামে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মিত ভবনে ৮০ শতাংশ ব্লক ইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব দুই শতাধিক ব্লক ইট তৈরির কারখানা রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় ব্লক ইটের কারখানা সংখ্যা খুবই কম।
বর্তমানে দেশে ইটভাটা, শিল্পায়ন, নগর উন্নয়নের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে শতভাগ আবাদযোগ্য কৃষিজমি। বাংলাদেশে ২০১৩ সালের ৫৯ নম্বর আইনের আওতায় ইটের সংজ্ঞায় বলা আছে, ‘ইট’ অর্থ বালু, মাটি বা অন্য কোনো উপকরণ দ্বারা ইটভাটায় পোড়াইয়া প্রস্তুতকৃত কোনো নির্মাণসামগ্রী। মাটি ছাড়া বালু বা অন্য কোনো উপকরণ দিয়ে তো ইট তৈরি সম্ভব নয়, কারণ বালুকে আগুনে পোড়ালে জমাটও বাঁধবে না, ইটেও রূপান্তরিত হবে না। মানুষ বালুকে উত্তপ্ত করে চাল থেকে মুড়ি তৈরি করে, ইট তৈরি করে না। তা ছাড়া অনুমতি সাপেক্ষে মজা পুকুর বা খাল বা বিল বা খাঁড়ি বা দিঘি বা নদ-নদী বা হাওর-বাঁওড় বা চরাঞ্চল বা পতিত জায়গার মাটি দিয়েও ইট তৈরিতে আগ্রহ দেখায় না। তাই সব ইটভাটায় উপকরণ হিসেবে আবাদযোগ্য কৃষিজমির মাটিই ব্যবহৃত হচ্ছে।
দেশে বর্তমানে ৭ হাজার ২০০ ইটভাটায় বছরে প্রায় ৩ হাজার ৫০০ কোটি ইট পোড়ানো হয়, এতে টপ সয়েল ব্যবহারের পরিমাণ প্রায় ১৩ কোটি টন, যা ৬৫ হাজার হেক্টর কৃষিজমির ওপরের স্তরের মাটির সমান। তা ছাড়া নানা কাজে আরও ১৫ হাজার হেক্টর আবাদযোগ্য জমিও অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। ওই হিসাবে বছরে মোট উর্বর জমি হারানোর পরিমাণ প্রায় ৮০ লাখ ৩০ হাজার হেক্টর। অর্থাৎ প্রতিবছরই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১ শতাংশ হারে আবাদযোগ্য জমি কমে যাচ্ছে, অপর দিকে ১ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে। ওই হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও আবাদি জমির অবক্ষয় চলতে থাকলে আগামী ৭০ বছর পরে বাংলাদেশে কোনো কৃষিজমি অবশিষ্ট থাকবে না।
পশ্চিমা দেশগুলোর পাশাপাশি চীন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, জাপান, কোরিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ ইট উৎপাদনে কৃষিজমির মাটির ব্যবহার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। চীন ৫০ বছর আগে মাটি পোড়ানো ইট উৎপাদন নিষিদ্ধ করেছে। ভিয়েতনামে রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মিত ভবনে ৮০ শতাংশ ব্লক ইট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করেছে। বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব দুই শতাধিক ব্লক ইট তৈরির কারখানা রয়েছে। তবে চাহিদার তুলনায় ব্লক ইটের কারখানা সংখ্যা খুবই কম।
ব্লক ইট তৈরিতে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহারের পরিবর্তে নদীর তলদেশের মোটা বালু ও সিমেন্ট ব্যবহার করা হয়। ১. ব্লক ইট তৈরি হয় কারখানায় আর ইট তৈরি হয় ইটভাটায়, তাতে জায়গাও কম লাগে এবং আগুনেও পোড়াতে হয় না। ২. ভবনের নির্মাণ ব্যয় ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। ৩. সার্বিকভাবে কৃষিবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, ভূমিকম্পসহ অন্যান্য দুর্যোগসহনীয়, টেকসই, ওজনে হালকা, দীর্ঘস্থায়ী, সহজ নির্মাণ, উন্নত মানের ফিনিশ, কম অপচয়, আগুন ও লবণাক্ততাপ্রতিরোধী। ৪. ব্লক ইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ড্রেসিংয়ের দরকার হয় না, ফলে নির্মাণকাজ দ্রুত সম্পন্ন করা যায়। ৫. ওজনে হালকা বিধায় স্থানান্তর সহজ। ৬. সাধারণ ইটের তুলনায় হালকা ওজনের হয়, ফলে ভবনের ভিত্তিতে চাপ কম পড়ে এবং মাটির ভারবহন ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত কম হলেও নির্মাণ করা সম্ভব। ৭. কম পুরুত্বের দেয়াল নির্মাণ করা যায়, ফলে ফ্লোর এরিয়া তুলনামূলকভাবে বেড়ে যায়। ৮. ব্লকের আকার বড় হয় এবং জোড়ার সংখ্যা কম হয়, ফলে মসলা কম লাগে। ৯. ব্লকে ফাঁকা থাকায় এগুলো তাপ, শব্দ ও আর্দ্রতায় অন্তরক হিসেবে উত্তম। ১০. এগুলোর পৃষ্ঠে প্লাস্টারের দরকার হয় না। ১১. ব্লকের দ্বারা নির্মিত দেয়াল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। ১২. চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকার-আকৃতির ব্লক তৈরি করা সম্ভব।
নতুন করে কোনো ইটভাটা স্থাপনের অনুমতি প্রদান না করা এবং মাটি পোড়ানো বৈধ ও অবৈধ সব ইটভাটাকে নিরুৎসাহিত করে পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট কারখানা স্থাপনকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ১. পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ২০১৯ সালের ২৪ নভেম্বর ব্লক ইট ব্যবহারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রচলিত ইটের ব্যবহার থেকে সরে এসে ধাপে ধাপে স্বল্প সময়ের মধ্যে সরকারি সব উন্নয়নকাজে ব্লক ইট ব্যবহারের লক্ষ্য নির্ধারণ করা। ২. ব্লক ইটের বাজার তৈরি করা। ৩. ব্লক ইটের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য সরকারের সব উন্নয়ন প্রকল্পে নির্দিষ্ট হারে ব্লকের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা। ৪. বেসরকারি পর্যায়ে নির্মিতব্য অ্যাপার্টমেন্ট ভবন ও সীমানাপ্রাচীরে নির্দিষ্ট হারে ব্লক ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া। ৫. ব্লক ইট প্রস্তুতকারক এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার জন্য একটি উপযুক্ত সরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা। ৬. ব্লক ইট উৎপাদনে ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ আমদানিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আমদানি শুল্ক থেকে অব্যাহতি দেওয়া। ৭. ব্লকের জাতীয় মান নির্ধারণ করা। ৮. ব্লককে বাজারে সহজলভ্য করা এবং ইটের সরবরাহ ও চাহিদা পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা। ৯. ইটভাটার মালিকদের পরিবেশবান্ধব ব্লক ইট তৈরির কারখানা স্থাপনে উৎসাহ দেওয়া এবং সহজ শর্তে ব্যাংকঋণ দিয়ে সহায়তা প্রদান করা। ১০. আবাদি জমিতে নতুন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, শিল্পকারখানা নির্মাণে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) অনুমোদন নেওয়া। ১১. কোনো কৃষককে তাঁর জমির মাটি বিক্রি বা সরানোর ক্ষেত্রে এসআরডিআইয়ের কর্মকর্তাদের অনুমোদন নেওয়া। ১২. সরকার কর্তৃক কৃষিজমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার আইন বাস্তবায়ন করা। ১৩. ব্লক ব্যবহারের সুফলগুলো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া, পত্রপত্রিকা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করা।
সবচেয়ে বড় কথা হলো আবাদি জমির মাটি আমাদের জীবনের ভিত্তি। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাকে রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য। তার জন্য দরকার সবার আন্তরিক সহযোগিতা, সব পক্ষের সমন্বয় ও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা।
অধ্যাপক আবুল কাসেম মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।