রিপাবলিকানরা অভিযোগ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসন কিংবা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি কেউই বলছেন না, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে ইউক্রেন কীভাবে জিতবে কিংবা ইউক্রেন এগিয়ে যাবে তার পরিকল্পনাই–বা কী।
মেক্সিকো সীমান্তে কঠোর নিরাপত্তা চালু করার যে দাবি রিপাবলিকানরা করে আসছেন, তার অগ্রগতির ক্ষেত্রেও রিপাবলিকানরা খুশি নন। সে কারণেই মার্কিন আইনসভার দুই কক্ষেই ইউক্রেনের জন্য পদক্ষেপগুলো অচলাবস্থার মধ্যে পড়েছে। বড়দিন ও নববর্ষের ছুটি শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত এ বিষয়ে অগ্রগতি ঘটার সুযোগ নেই।
বাইডেন প্রশাসনের ইউক্রেন সমস্যাটি এখন অর্থায়ন জোগানোর চেয়েও গভীর সমস্যা। আইনপ্রণেতারা এখন বুঝতে পারছেন, এই যুদ্ধে জেতা যাবে না। তাঁরা এ ব্যাপারে অবাক হচ্ছেন, জেলেনস্কিকে সমর্থন দেওয়ার মধ্য দিয়ে বাইডেন প্রশাসন কি ফাঁদে আটকা পড়েছে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, অনেকের কাছে এটা এখন খুব বাজে ব্যাপার, যে যুদ্ধে জেতা যাবে না সেই যুদ্ধে কেন জেলেনস্কিকে সমর্থন দেওয়া হবে।
মাসের পর পর ধরে কিয়েভ ও ওয়াশিংটনে বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার করে আশ্বস্ত করার পরও জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো সমরনেতার পক্ষেই এই তত্ত্ব বিশ্বাস করা সম্ভব নয় যে ইউক্রেন যুদ্ধে জিতবে। আইনপ্রণেতারা প্রায় দুই বছর ধরে এ যুক্তি শুনতে শুনতে এখন উপলব্ধিতে পৌঁছেছেন যে বাইডেন প্রশাসন তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
গত গ্রীষ্মে ইউক্রেনের চালানো আক্রমণ অভিযানের অবস্থা দেখেই অনেকে এই যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর দেওয়া প্রশিক্ষণ ও ব্যাপক গোয়েন্দা সমর্থন পাওয়ার পরও রাশিয়ানদের কাছে বড় পরাজয় বরণ করতে হয়েছে ইউক্রেনীয়দের। কেবলমাত্র অতি নগণ্য কিছু জয় তারা পেয়েছে।
জেলেনস্কি এখনো যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধরনা দিচ্ছেন এই দাবি নিয়ে যে আক্রমণ অভিযানে ইউক্রেন অনেক বিজয় অর্জন করতে পেরেছে এবং রুশ জেনারেল সুরোভিকিনের গড়া প্রতিরক্ষা লাইন ভেঙে দিয়েছে। আগে সেটা হলেও হতে পারে, বর্তমানে এই যুক্তির কোনো সত্যতা নেই।
সামনে আরও বড় হাঙ্গামা অপেক্ষা করছে। পেন্টাগন থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আন্টনিও আগুতো জুনিয়রকে ইউক্রেনকে পাঠানো হয়েছে। ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর ছায়া কমান্ডার হিসাবে তাঁকে পাঠানো হচ্ছে। মূলত বর্তমান কমান্ডারের জায়গায় তাঁকে বসানো হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ইউক্রেনের স্থল অভিযানের প্রধান ওলেকসান্দ্রা সিরিক্সির জায়গায় আগুতোকে বসানো হবে।
আগুতোর নির্দেশনা পরস্পরবিরোধী। একদিকে তিনি ইউক্রেনীয়দের ‘ধরে রাখা ও নির্মাণ করা’ কৌশলনীতিতে পরিচালনা করতে চাইছেন। অন্যদিকে তিনি জেলেনস্কিকে সংঘাত স্থগিত রাখতে বলছেন, কমপক্ষে সেটা আসন্ন বসন্তকাল পর্যন্ত।
‘ধরে রাখার’ অর্থ হচ্ছে সামনে অগ্রসর না হওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু ইউক্রেনের অধীন যতটা ভূখণ্ড আছে, তার ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা। এই চিন্তা এরই মধ্যে মাঠে মারা গেছে। কেননা, বেশির ভাগ নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে রাশিয়ানরা সামনে এগোচ্ছে।
রুশ বাহিনী এরই মধ্যে ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণে থাকা দোনেৎস্ক অঞ্চলের ছোট্ট শহর ম্যারিনকায় প্রবেশ করেছে। একই অঞ্চলের আভদিভকা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে রুশ বাহিনী এবং শহরটির কিছুটা অঞ্চলের ওপর নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নিয়েছে।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে এখন ব্যাপক জনবলসংকট দেখা দিয়েছে। শূন্যস্থান পূরণে তারা নানা কদাকার ও কালো কৌশল গ্রহণ করেছে। বড় শহরগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছু অভিজাত সম্প্রদায়ের (রাশিয়ানরা যাদের নমেনক্লাটুরা বলে) ছেলেমেয়েদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। জেলেনস্কি সরকার তাদের সুরক্ষিত রেখেছে।
বাখমুতের চিত্রও ভিন্ন নয়। বাখমুতে বড় যুদ্ধের সময় শহরের বাইরে যেসব গ্রাম ইউক্রেন বাহিনী করায়ত্ত করে নিয়েছিল, সেগুলো তাদের কাছ থেকে পুনর্দখল করে নিচ্ছে রুশ বাহিনী। তারা শিগগিরই ইউক্রেনীয় বাহিনীর প্রধান একটি রসদভান্ডার চাসিভ ইয়ারের দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছে।
একইভাবে জাপোরিঝঝিয়া অঞ্চলের যুদ্ধক্ষেত্রে রাশিয়ানরা এখন রোবোটাইন এলাকায় চাপ তৈরি করেছে। ছোট এই গ্রাম কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রুশ বাহিনীর সাফল্য নির্ভর করছে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গ্রামটি রক্ষা করার জন্য ইউক্রেনীয়রা কতজনের প্রাণ আত্মত্যাগ করতে রাজি হয় তার ওপর।
এ কারণেই ‘ধরে রাখা’ নীতি কোনোভাবেই সুসংগত কৌশলনীতি নয়। এর বিপরীতে জেলেনস্কির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইউক্রেনীয় বাহিনীর বর্তমান সেনাপ্রধান ভ্যালেরি জালুঝনির প্রস্তাব হলো, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সংহত করে একটি সত্যিকারের প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি করা। অবশ্য জেলেনস্কি নিজে এই প্রস্তাবে আগ্রহ দেখালেও তিনি বাখমুত ও আভদিভকায় যুদ্ধ চালিয়ে নিতে জোর দিচ্ছেন।
‘নির্মাণ করো’ ধারণাটি যুক্তরাষ্ট্রের।
চলমান যুদ্ধে যেভাবে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণের জন্য তারা ইউক্রেনীয় বাহিনী পুনর্গঠন করার ধারণাটি সামনে নিয়ে এসেছে। নির্মাণের অর্থ হলো, ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর জন্য একদিকে নতুন জনবল নিয়োগ দেওয়া, অন্যদিকে তাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাজ্জিত করা।
ইউক্রেনের সেনাবাহিনীতে এখন ব্যাপক জনবলসংকট দেখা দিয়েছে। শূন্যস্থান পূরণে তারা নানা কদাকার ও কালো কৌশল গ্রহণ করেছে। বড় শহরগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছু অভিজাত সম্প্রদায়ের (রাশিয়ানরা যাদের নমেনক্লাটুরা বলে) ছেলেমেয়েদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ দেওয়া থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। জেলেনস্কি সরকার তাদের সুরক্ষিত রেখেছে।
এর কারণ হচ্ছে, সমাজতন্ত্র বিদায় নিয়েছে তার মানে এই নয় যে ইউক্রেনের অতি দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত সম্প্রদায় বিদায় নিয়েছে কিংবা রাশিয়ার থেকে কোনো অংশে তাদের সংখ্যা কম। এই শ্রেণির লোকদের ওপর যখন কোনো চাপ দেওয়া হবে, তখন গুরুতর রাজনৈতিক সমস্যা তৈরি হবে।
এদিকে ইউক্রেনে নির্বাচন হচ্ছে না বলে একটা অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। গত সপ্তাহে জেলেনস্কির দলের নেতা ডেভিড আর্কহামিয়া ইউক্রেনীয় পার্লামেন্টে বিদ্রোহ করার কথা বলেন। উল্লেখ্য, আর্কহামিয়া প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির মুখপাত্র হিসেবেই পরিচিত। অনেক আইনপ্রণেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইউক্রেন ছেড়ে চলে যেতে চান। অনেকে এর মধ্যে ইউক্রেন ছেড়েও গেছেন।
এসব কারণেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল আগুতো ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে পারবেন অথবা ইউক্রেন সরকারের হারানো আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করতে পারবেন, সেটা ভাবা খুব কঠিন।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি ও ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত