নাভালনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তিনি পুতিনের অসার, মিথ্যে কথার জাল ভেদ করতে পেরেছিলেন। সে কারণে তিনি আরও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, তিনি একজন শহীদ।
নাভালনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তিনি পুতিনের অসার, মিথ্যে কথার জাল ভেদ করতে পেরেছিলেন। সে কারণে তিনি আরও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, তিনি একজন শহীদ।

মতামত

মৃত নাভালনি পুতিনের জন্য আরও বেশি বিপজ্জনক কেন

এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আলেক্সি নাভালনি ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে ক্রুসেড চালিয়ে যাচ্ছিলেন।  তাঁর নামটাও মুখে নিতেন না পুতিন। যদিও তিনি ও তাঁর বশংবদরা এমনকি খুন করে হলেও তাঁর মুখ বন্ধ করতে চেয়েছিলেন।

রাশিয়ার উত্তরে দুর্গম এক কারাগারে নাভালনির মৃত্যুর পর তিনি রুশ প্রচারমাধ্যমে জায়গা পেলেন। পুতিন যে নাভালনির মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত সেই তথ্যটিও ওই সব খবরে কায়দা করে নিশ্চিত করা হয়।

রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রগুলোর কোনো কোনোটি আবার নাভালনির মৃত্যুতে পশ্চিমের প্রতিক্রিয়ার খবরও প্রচার করে। অবশ্য খবরের ধরন ছিল আলাদা।

নাভালনির মৃত্যুকে কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা পুঁজি করবে, আরও নিষেধাজ্ঞা দেবে কি না মোটের ওপর আলোচনা ছিল এমন। কোথাও কোথাও রুশ আইনসভার আলোচনার খবর এসেছে।

নাভালনির মতো ব্যক্তিত্বের মৃত্যুর খবর জাতীয় সংকট হিসেবে বিবেচিত। সরকারও তাঁর মৃত্যুর খবর যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে। যদিও এর আগে তাঁকে চিত্রিত করা হয়েছে একটা বাজে লোক, সন্ত্রাসী, চরমপন্থী, নাৎসি হিসেবে। যে লেবার ক্যাম্পে তাঁকে রাখা হয়েছিল, সেখানে প্রধানত এ ধরনের অভিযোগে আটক বন্দীদের জায়গা হতো।

আনুষ্ঠানিক এসব খবর অসাবধানতাবশত এমন অনেক তথ্য প্রকাশ করে ফেলেছে, যা পুতিন গোপন রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এসব তথ্যের মধ্যে পুতিনের একনায়কতন্ত্রের জন্য গুরুতর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ দুর্নীতি ও অপশাসনের উল্লেখ ছিল। এসব নিয়ে নাভালনি নিরলসভাবে অভিযোগ করে গেছেন।

মৃত্যুর পর নাভালনি আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারেন, এমন কথাও বলা হয়েছে।  

ক্রেমলিনে পুতিনের পূর্বসুরীরা দমন–পীড়নের পক্ষে অকাট্য সব যুক্তি তুলে ধরতেন। পুতিনও গণতন্ত্রের একটা মনগড়া সংস্করণ তৈরি করে নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থায় তিনি নির্বাচনে কারচুপি আর আদালতকে নিজের করায়ত্ব করে দুর্নীতির পথ প্রশস্ত করেন।

নীতিবান ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের সঙ্গে তিনি সরাসরি লড়াই করেছেন। নাভালনির মতো এই মানুষদের তিনি ‘বিদেশি চর’ অথবা সন্ত্রাসী বলে আখ্যা দিয়েছেন।

নাভালনি বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন, কারণ তিনি পুতিনের অসার, মিথ্যে কথার জাল ভেদ করতে পেরেছিলেন। সে কারণে তিনি আরও শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব, তিনি একজন শহীদ। নির্বাচনের এক মাস আগে ক্রেমলিনের জন্য এই পরিস্থিতি বড় ঝুঁকি। যদিও পুতিন এই নির্বাচনে তাঁর শাসন ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি জনসমর্থনকে পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিলেন।

নাভালনির মৃত্যুর কী প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে এখনই পরিষ্কারভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। পুতিনের বিরুদ্ধে যখনই কোনো আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, তখনই তিনি তা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, বা বিরোধীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছেন। কিন্তু নাভালনির মৃত্যু  রাশিয়ার মহত্ত্ব নিয়ে পুতিন যে কল্পকথা তৈরি করেছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে ভাঙন ধরাবে।

শুরু থেকেই নাভালনি ইউক্রেন দখল অভিযানের কট্টর সমালোচক। মস্কোর আদালতে তিনি বলেন, ‘এই যুদ্ধ একটা নির্বোধের যুদ্ধ, যেটা শুরু করেছেন পুতিন।’ পুতিনের বিশ্বাস ছিল তিনি সমালোচকদের ধরে ধরে নির্বাসনে পাঠালেই বিরোধীপক্ষের মুখ বন্ধ করে দিতে পারবেন।

ইউক্রেন অভিযানের বিরুদ্ধে যারা অবস্থান নিয়েছেন তাঁদের বড় অংশই শহুরে শিক্ষিত শ্রেণির লোকজন। গ্রামের মানুষ ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডা বিশ্বাস করে। তাঁরা এই যুদ্ধের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘কূটকৌশল’ কিংবা ইউক্রেনের দিক থেকে হুমকিকে দায়ী করে।  

নাভালনি সাধারণ রুশিদের মনের কথা বলতেন। তিনি নিশানা করেছিলেন দুর্নীতিকে, বিশেষ করে পুতিন ও তাঁর আত্মীয়স্বজনের সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠার বিরুদ্ধে ছিল তাঁর অবস্থান। তিনি গ্রাম্য ভাষায়, রসিয়ে রসিয়ে, সাহস নিয়ে কথা বলতেন। তা ছাড়াও একটি সংগঠন থেকে ফাটাফাটি সব ভিডিও প্রকাশ করতেন।

ক্রেমলিনই যে তাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করতে চেয়েছে এটা বোঝাতে নাভালনি একটা ভিডিও বানিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রুশ নিরাপত্তা কর্মকর্তা সেজে তথ্য বের করার চেষ্টা করেন। এভাবে তিনি পুলিশি রাষ্ট্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তিনি পুতিন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভের বেশুমার সম্পদের ভিডিও দেখিয়েছিলেন। এই সব ভিডিও লাখ–লাখ বার দেখা হয়। ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড রাশিয়া পার্টিকে চোর বদমাশের দল বলে তিনি নিন্দা করতেন। দলটি এই তকমা আর কখনো মুছে ফেলতে পারেনি।  

যদিও নাভালনি সরকার গঠন করতে চেয়েছিলেন, পুতিনের বিরুদ্ধে তাঁর সমর্থকদের ভোট দিতে বলেছিলেন। প্রথমে তিনি বিরোধী দল ইবলোকো দলের সদস্য ছিলেন। পরে তিনি দল থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, পুতিন বিরোধী যে কারও সঙ্গে তিনি মৈত্রী করতে চান, তাঁর মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন।  

সোলঝেনিৎসিন এবং সোভিয়েত যুগের ভিন্নমতাবলম্বীরা ইউটোপিয় মতাদর্শের ধুয়া তুলে যারা স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। নাভালনির যুদ্ধ ছিল যারা কমিউনিজমের বিরুদ্ধে বিজয়কে শক্তি আর সম্পদ অর্জনের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন।

নাভালনি বলেছিলেন, ‘নব্বইয়ের পর আমাদের জন্য যে ঐতিহাসিক ও অপার সম্ভাবনা ছিল, সেই সম্ভাবনা যারা বিক্রি করে দিয়েছে, বেহিসেবি খরচ করেছে তাদের আমি অন্তর থেকে ঘৃণা করি।’

পুতিন ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা, যাদের অনেকেই গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির লোকজন, তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন নাভালনি তাঁদের জন্য কত বড় হুমকি। নাভালনিকে থামিয়ে দিতে এমন কিছু নেই যা করেনি তারা। নাভালনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁর সমর্থকেরা হয়রানির শিকার হয়েছেন। এমনকি ২০২০ সালে সাইবেরিয়ায় নভিচক প্রয়োগে তাঁর স্নায়ু বিকলের চেষ্টাও হয়েছে।

কিন্তু নাভালনি বেঁচে গেছেন। তিনি পরের বছর রাশিয়ায় ফিরেছেন। তিনি জানতেন পুতিন তাঁকে শ্রমশিবিরে পাঠাতে পারেন। এ জায়গাতেই ভিন্নমতাবলম্বীদের সাধারণত অন্তরীণ রাখা হয়। তিনি এও জানতেন যে হয়তো তিনি আর বাঁচবেন না। ২০২১ সাল থেকে তিনি কারাগারে। সবশেষ তাঁকে আর্কটিক সার্কেলের দুর্গম এক কারাগার ‘পোলার উলফে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তারপরও নাভালনিকে দমিয়ে রাখা যায়নি। তিনি তাঁর আইনজীবী, তাঁর সংগঠন বা পরিবার মারফত বার্তা দিয়ে গেছেন। নাভালনির ওয়েবসাইট থেকে আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন নিয়ে মিথ্যে প্রচার প্রচারণার জবাব দেওয়া হচ্ছিল। তিনি পুতিনের পরিকল্পনা ভেস্তে দেওয়ার আহ্বান জানান, যেন ১৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের সাজানো ফল নিয়ে সবাই আগ্রহ হারায়। রাশিয়া যে পুতিনকে প্রত্যাখান করেছে এমনটা প্রমাণের ব্রত ছিল তাঁর।

নাভালনির মৃত্যুর কী প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে এখনই পরিষ্কারভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। পুতিনের বিরুদ্ধে যখনই কোনো আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে, তখনই তিনি তা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন, বা বিরোধীদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছেন। কিন্তু নাভালনির মৃত্যু  রাশিয়ার মহত্ত্ব নিয়ে পুতিন যে কল্পকথা তৈরি করেছিলেন তাতে নিঃসন্দেহে ভাঙন ধরাবে।

নাভালনি নির্যাতনকে ভয় পাননি। তিনি তাঁর বিশ্বাসের পক্ষে স্বেচ্ছায় লড়াই চালিয়ে যেতে চেয়েছেন। নাভালনি বলেছিলেন, তিনি সত্যিকারের ভালোবাসায় বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন রাশিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে, রাশিয়া মুক্তি পাবে। মৃত্যুতে,ক্ষয়ে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিবন্ধটির লেখক সার্জ স্মুম্যান। তিনি দ্য টাইমসে যোগ দেন ১৯৮০ সালে। মস্কো, বন , জেরুজালেম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে  অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম