চীনের মতো ভারতও তার সভ্যতার মাপকাঠি এবং প্রাচীনত্ব নিয়ে প্রবলভাবে গর্ব করে—এই গৌরব অমূলকও নয়। কিন্তু এ ধরনের আত্মতুষ্টি কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশটিকে বিপজ্জনক অস্থিরতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
পৌনে এক শতাব্দী আগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারত প্রধানত অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন ও অগ্রগতির দিকে নজর দিয়েছে; একটি শক্তিশালী গণতন্ত্র এবং একটি স্বাস্থ্যকর অর্থনীতি গড়ে তোলার মাধ্যমে তার জনসংখ্যার কল্যাণের দিকে মনোনিবেশ করেছে।
গত চার দশকে চীনও একই কাজ করেছে। কিন্তু এর পাশাপাশি চীন তার অর্থনীতিকে পরিবর্তন করে সমগ্র ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে তার পেশি শক্তিকে সম্প্রসারিত করেছে।
চীনের ভূরাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিপ্রেক্ষিতকে মাথায় রেখে ভারতকেও এখন বাইরের দিকে তাকাতে হবে এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। বিশেষ করে ভারতকে তার ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল প্রতিবেশী দেশগুলোতে স্থিতিশীলতা ফেরাতে ভূমিকা রাখতে হবে। পশ্চিম দিকে থাকা পাকিস্তান ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ।
এই উদ্বেগের কারণ হলো পাকিস্তানের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র আছে; সেখানকার শাসনব্যবস্থা অস্থিতিশীল এবং আফগানিস্তানে, এমনকি জম্মু-কাশ্মীরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সঙ্গে পাকিস্তানের যোগসাজশ রয়েছে। ভারতের দক্ষিণে আছে শ্রীলঙ্কা, যার অর্থনীতি আবারও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হয়েছে।
ভারতের উত্তরে থাকা ক্রমবর্ধমান দৃঢ়চেতা চীন বারবার হিংসাত্মকভাবে অরুণাচল প্রদেশ, লাদাখসহ হিমালয় এবং ভুটান ও সিকিমের সঙ্গে লাগোয়া ভারতীয় ভূখণ্ড দখল করেছে। চীনের ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ বা ‘মুক্তার মালা’খ্যাত ভারত মহাসাগর থেকে হর্ন অব আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত নৌঘাঁটি এবং বাণিজ্যিক প্রকল্পগুলোর একটি বিশাল অঞ্চল ভারতের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতাকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য ভারতের আর নেই। এর বিশাল আয়তনের কারণে তার চারদিক থেকে ছুটে আসা ঝড় তার পক্ষে রাতারাতি ঠেকানো কঠিন। সে কারণে ভারতকে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে আগ্রহী হতেই হবে।
চীনের মালায় নতুন ‘মুক্তা’ হিসেবে যুক্ত হয়েছে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের নৌঘাঁটি। এই ঘাঁটি দিয়েই চীন এখন পাকিস্তানের কার্যত রক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ঝুঁকিপূর্ণভাবে পাকিস্তানকে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান উন্নত করাসহ উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানিদের নিরঙ্কুশভাবে চীনাদের পাশে দাঁড়ানো থেকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা ভারতের চ্যালেঞ্জগুলোকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ভারতের পূর্ব দিকেও সমস্যা আছে। তুলনামূলকভাবে অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে তার পূর্ব দিকের প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল এবং নিরাপত্তা অংশীদারি ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ছিল। কিন্তু মিয়ানমারে সামরিক শাসন ফিরে আসায় সে অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। ক্ষমতাচ্যুত নেত্রী অং সান সু চিকে জেলে পোরার পর দেশজুড়ে একটি নতুন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে ওঠায় মিয়ানমার গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এদিকে প্রতিবেশী লাওস মারাত্মক আর্থিক সংকটে রয়েছে এবং চীনের কাছে গভীরভাবে ঋণের জালে আটকে আছে।
মালয়েশিয়ায় স্থানীয় দুর্নীতি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটাই দেউলিয়া করে দিয়েছে যে দেশের কোষাগার লুট করার জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক ও তাঁর স্ত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করা এবং কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
থাইল্যান্ড (যে দেশটি একটি আপাতদৃষ্টিতে অসংলগ্ন রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে অস্থিতিশীল) আবারও একটি রাজনৈতিক অতলগহ্বরের কিনারে চলে গেছে। কারণ, দেশটি পরের বছর একটি নতুন এবং অজনপ্রিয় সংবিধানের অধীনে একটি বিতর্কিত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
আসিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতা চীনের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। কারণ, অস্থিতিশীলতা চীনাদের বিভিন্ন দেশের প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোকে চালিত করে তাদের ওপর খবরদারি করার সুযোগ করে দেয়। কিন্তু ভারতের জন্য এ অঞ্চলের রাজনৈতিক অস্থিরতা কোনো আশীর্বাদ নয় বরং জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উদাহরণস্বরূপ, কয়েক লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমারের গণহত্যা থেকে বাঁচতে প্রতিবেশী বাংলাদেশ ও ভারতে পালিয়ে এসেছে। এ কারণে ভারতের সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিকজুড়ে ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতাকে উপেক্ষা করার সামর্থ্য ভারতের আর নেই। এর বিশাল আয়তনের কারণে তার চারদিক থেকে ছুটে আসা ঝড় তার পক্ষে রাতারাতি ঠেকানো কঠিন। সে কারণে ভারতকে প্রতিবেশী দেশগুলোর বিষয়ে আগ্রহী হতেই হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত
থিতিনান পংসুধিরাক ব্যাংককের চুলালংকর্ন ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক