শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশকারা দেওয়া বন্ধ করবে কি কানাডা?

জাস্টিন ট্রুডো কোনো রকম তথ্য প্রমাণ না দেখিয়েই সরাসরি ভারত সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন।
ছবি : রয়টার্স

কানাডা ও ভারতের মধ্যে যে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব চলছে, তার মতো কুৎসিত বিতণ্ডা দুটো বড় গণতন্ত্রের মধ্যে কদাচিৎই দেখা যায়। এই দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। সম্পর্কটি যাতে আরও খারাপ অবস্থায় চলে না যায় সে জন্য কানাডার ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দুই দেশের কূটনৈতিক কোলাহল স্তিমিত হলেও কানাডা যতক্ষণ তার ভূখণ্ডে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশকারা দেবে ততক্ষণ ভারত-কানাডার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।

গত জুনে কানাডার মাটিতে শিখ নেতা হরদ্বীপ সিং নিজ্জরের গুলিতে নিহত হওয়ার পেছনে ভারত সরকারের ‘সম্ভাব্য যোগ’ থাকার ‘বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ’ থাকার কথা সম্প্রতি বলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তাঁর এই সংবেদনশীল মন্তব্যের জের ধরে ভারত ও কানাডার সম্পর্ক অস্থির হয়ে ওঠে। কানাডা ভারতের কূটনীতিকদের বহিষ্কার করার পর ভারত পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে। ভারতও কানাডার কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের বের করে দিয়েছে। কানাডার নাগরিকদের ভিসা বন্ধ করেছে। ভারত অভিযোগ করেছে, কানাডা ‘সন্ত্রাসীদের অভয়াশ্রম’ গড়েছে এবং সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে রাখার জন্য কানাডা ভারতের বিরুদ্ধে ‘আজগুবি’ অভিযোগ তুলেছে।

কানাডার আশ্রয়ে থাকা ভারতীয় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মধ্যে নিজ্জরই একমাত্র নেতা নন। আদতে, শিখদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলা ‘খালিস্তান’ জঙ্গি আন্দোলনের সমর্থনে দুনিয়া জুড়ে যত সংখ্যক শিখ আছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কানাডায় আছেন। সেখানে তাঁরা প্রকাশ্যে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালাচ্ছেন। খালিস্তান বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মূলত শিখ প্রবাসীদের একটি ছোট সংখ্যালঘু অংশ। এরা মূলত কানাডায় জড়ো হওয়া একটি সম্প্রদায়। ভারতে বসবাসকারী শিখরা ভারতীয় হিসেবেই গর্ব বোধ করেন, তাঁরা বিচ্ছিন্নতাবাদকে সমর্থন করেন না।

কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়াকে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা তাদের তৎপরতা চালানোর আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। এখান থেকেই তাঁরা রাজনৈতিক সহিংসতাকে মহিমান্বিত করে ব্যাপক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। যেমন, তাঁরা ভারতীয় কূটনীতিকদের হত্যাকাণ্ডের সমর্থনে বিলবোর্ড টাঙিয়েছে; কারাদণ্ড পাওয়া খালিস্তানি জঙ্গিদের স্বাধীনতাকামী হিসেবে সম্মান দেখিয়েছে; নিহত জঙ্গিদের ‘শহীদের মর্যাদা’ দিয়েছে; প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হত্যাকাণ্ডকে উদ্যাপনের ভঙ্গিমায় সেই হত্যাকাণ্ডকে মঞ্চে অভিনয়ের মতো করে দেখিয়েছে এবং কানাডায় ভারতীয় কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালিয়েছে। তারা কানাডায় খালিস্তানের স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোটও করেছে।

সন্দেহ নেই, শিখ কট্টরপন্থীরা কানাডার মূল ধারার রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখেন। এমনকি তারা দেশটির বড় অর্থ জোগানদাতাও। ট্রুডোর সংখ্যালঘু সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে খালিস্তান আন্দোলনে মদদ দেওয়া শিখ নেতা জগমিত সিংয়ের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সহায়তা বড় ভূমিকা রেখে থাকে। ট্রুডো সরকারের একজন প্রাক্তন পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টার মতে, ট্রুডো শিখদের ভোট হারাতে চাননি। এ কারণেই তিনি খালিস্তানি জঙ্গিদের অর্থায়ন বন্ধ করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেননি।

কিন্তু ভারতের জন্য সবচেয়ে যেটি হতাশার, সেটি হলো, শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের তৎপরতা বন্ধে কানাডা সরকারের অনীহা। ২০১৮ সালে জাস্টিন ট্রুডোর প্রথম ভারত সফর বিপর্যয়কর অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। ওই সময় ট্রুডোর সফরসঙ্গীর তালিকায় এমন একজন শিখ সন্ত্রাসীর নাম ছিল যিনি কানাডা সফরে যাওয়া একজন ভারতীয় প্রতিমন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন এবং সেই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে বেশ কয়েক বছর কানাডার কারাগারে ছিলেন।

গত মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে জাস্টিন ট্রুডোকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহিংস উগ্রপন্থীদের প্রতি কানাডার নমনীয়তা প্রদর্শনের বিষয়ে ভারতের আপত্তির কথা জানিয়ে দিয়েছেন। শিখ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কানাডার আগে থেকেই চাপান-উতোর ছিল। তার মধ্যেই ট্রুডো নিজ্জর হত্যা বিষয়ক অভিযোগটি তোলেন। যখন কোনো দেশের মাটিতে কোনো ব্যক্তি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এবং সেই হত্যাকাণ্ডের পেছনে দেশটি বিদেশি গোয়েন্দাদের হাত থাকার অভিযোগ তোলে, তখন অভিযোগকারী দেশ অভিযুক্ত দেশের হাতে এ সংক্রান্ত ভিডিও, অডিও অথবা ফরেনসিক তথ্যপ্রমাণ হস্তান্তর করে থাকে।

কিন্তু জাস্টিন ট্রুডো কোনো রকম তথ্য প্রমাণ না দেখিয়েই সরাসরি ভারতেরে সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন। তিনি বলেছেন, ফাইভ আইজ পার্টনার দেশগুলোর (অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে ফাইভ আইজ পার্টনার বলা হয়ে থাকে) একটির নির্ভরযোগ্য গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি অভিযোগটি করেছেন। কিন্তু ট্রুডো ভারতের কর্তৃপক্ষের হাতে সেসব তথ্যের কিছুই হস্তান্তর করেনি। এমনকি কানাডার বিরোধী দলীয় নেতা ও প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য পিয়েরে পোইলিভারকেও এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য প্রমাণ দেখাননি।

সন্দেহ নেই, শিখ কট্টরপন্থীরা কানাডার মূল ধারার রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব রাখেন। এমনকি তারা দেশটির বড় অর্থ জোগানদাতাও। ট্রুডোর সংখ্যালঘু সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে খালিস্তান আন্দোলনে মদদ দেওয়া শিখ নেতা জগমিত সিংয়ের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সহায়তা বড় ভূমিকা রেখে থাকে। ট্রুডো সরকারের একজন প্রাক্তন পররাষ্ট্র নীতি উপদেষ্টার মতে, ট্রুডো শিখদের ভোট হারাতে চাননি। এ কারণেই তিনি খালিস্তানি জঙ্গিদের অর্থায়ন বন্ধ করার বিষয়ে পদক্ষেপ নেননি।

তবে কানাডাকে মনে রাখতে হবে, এই শিখ জঙ্গিরা তাদের জন্যই হুমকি হয়ে উঠছে এবং এখনই তাদের এই হুমকি মোকাবিলায় জেগে উঠতে হবে। ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় মাদক চোরাচালানি ক্রমবর্ধমানভাবে লাভজনক এবং আগ্নেয়াস্ত্র সহজপ্রাপ্য হওয়ায় গোটা প্রদেশজুড়ে খালিস্তানি উগ্রপন্থীদের মধ্য আন্তঃসংঘাত ঘটাচ্ছে। শিখ জঙ্গিবাদ, মাদকের কারবার ও সংঘবদ্ধ হয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পরিবেশ কানাডার নিরাপত্তার ওপর ভয়ানক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ইতিপূর্বে ভারত সরকার কানাডায় আশ্রয় নেওয়া শিখ জঙ্গিদের ফেরত চেয়ে আবেদন করার পর ট্রুডোর পিতা ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডোর সরকার ভারতের কাছে তাদের হস্তান্তর করতে অনীহা প্রকাশ করেছিল। সে কারণেই ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানকে নিশানা করে শিখ জঙ্গিরা জোড়া বোমা হামলা চালিয়েছিল। টরোন্টোতে চালানো একটি হামলায় ৩২৯ জন যাত্রী নিহত হয়েছিল যাঁদের বেশির ভাগই ছিল ভারতীয় বংশোদ্ভূত নাগরিক। আরেকটি হামলা হয়েছিল টোকিওর নারিতা বিমানবন্দরে। সেটি ব্যর্থ হলেও দুজন ব্যাগেজ বহনকারী কর্মী নিহত হয়েছিলেন।

কানাডার করা পৃথক দুটি তদন্তে তালভিন্দর সিং পারমা-দুটি হামলার জন্য মূল পরিকল্পনাকারী প্রমাণিত হওয়ার পরও খালিস্তানি জঙ্গিরা তাঁকে অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মহিমান্বিত করে থাকে। এটি জেনেও কানাডা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ায় সেই ধরনের অঘটনের পুনরাবৃত্তি হতে পারে। ট্রুডো ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সেই পুরোনো ক্ষতকে যেন আবার উসকে দিয়েছেন। এটি ভারতে একটি বিরল জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করেছে।

কানাডা যাতে খালিস্তানিদের আশ্রয় প্রশ্রয় না দেয় সে জন্য ভারতের অনেকেই মোদি সরকারকে ট্রুডোর ওপর চাপ দিতে আহ্বান জানাচ্ছে। তবে আরও বেশি তিক্ততা ও পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি দিন শেষে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ কারণে উভয় পক্ষকেই উদ্বেগ মোকাবিলায় কার্যকর ও সহযোগিতামূলক কূটনীতির পথে হাঁটতে হবে।

  • ব্রহ্ম চেলানি নয়াদিল্লিভিত্তিক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক

    স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ