বিশ্বের বিদ্যালয়ে নিঃস্বের আস্ফালন

বছর পঁচিশ আগে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া এক ঘটনায় বিস্ময়ে-লজ্জায়-ক্রোধে-অপমানে পিষ্ট হয়েছিলাম। ধর্ষণের শততম ‘কৃতিত্ব’ উদ্‌যাপন করছিল এক ছাত্রনেতা, সঙ্গে ছিল উল্লাসরত সাঙ্গপাঙ্গরা। ‘প্রতিকারহীন শক্তি’র বিরুদ্ধে অসহায় আত্মগ্লানিতে শুধু বিনিদ্র রাত্রিই কাটাতে পেরেছি। তবু কিছু প্রবোধ মনকে দেওয়া গিয়েছিল এটি দেখে যে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক-ছাত্রদের কিছু ও সমাজের কিছু অংশের ভেতর থেকে প্রতিবাদ উঠেছিল। শাসককুলের অনীহা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত অপর্যাপ্ত হলেও কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।

এখন অবশ্য যৌন নিপীড়নে সমাজে নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে গা-সওয়া হয়ে গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়েও এমন ঘটনা আর কাউকে বিচলিত করে বলে মনে হয় না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার আদি পর্ব কাটিয়েছি জিয়া-এরশাদের পৃষ্ঠপোষকতায় মৌলবাদী রাজনীতির ছাত্রসংগঠনের একক আধিপত্যে প্রতিষ্ঠিত আতঙ্কের মধ্যে। যখন ভাবতে শুরু করেছি, অন্ধকারের শেষে আলোর আভাস দেখা দিল বুঝি, তখন দেখি—কৃষ্ণগহ্বর আরও দীর্ঘ।

বর্তমান সময় ও রাজনীতিকে মাপার জন্য যদি কোনো লিটমাস পেপার দরকার হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার সবচেয়ে উত্তম উদাহরণ।

শিক্ষকতা শেষে অবসরে গিয়েছি সে–ও দশক পেরিয়েছে, তবু যখন দেখি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্য কিছুতে না হলেও অভূতপূর্ব ঘটনা সম্পাদনে প্রায়ই সবার ওপরে অবস্থান করছে, তখন মাথাটি উঁচিয়ে ধরব না লুকাব, বুঝে উঠতে পারি না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ কেবল ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে আর সীমিত নেই, শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও সঞ্চারিত হয়েছে। শুধু ছাত্রনেতাদের কথা বলে লাভ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বা নেপথ্যে যাঁরা শক্তি ও অভয়ের জোগানদার, যাঁরা নিজেরাই অনুসারীদের জন্য উদাহরণ নির্মাণ করেন, বিচারের প্রয়াসকে নিবৃত্ত করার কলকাঠি নাড়েন, তাঁরাও কি দায়ের ভাগী নন?

৩৮ বছর শিক্ষকতা করে ৩৮টি সবক মনে গেঁথে নিয়েছি। তার সব কটি এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রথমে বলার কথা—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ শতাংশ ছাত্র আসে গ্রাম বা মফস্‌সল থেকে, স্বল্প আয়ের পরিবারে কষ্ট করে জ্ঞানার্জন তথা ডিগ্রি অর্জন করে নিজের বা সংসারের খেদমত করার বাসনায়। কিন্তু তারা কণ্ঠহীন। দশ বা তারও কম ভাগের দাপটের খুঁটি কতটা ওপরে, সেটুকু তারা বুঝে নেয়, অসহায় নিশ্চুপতাকে মেনে নেয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-বাসে যাতায়াত করতাম, আসতে-যেতে দু-তিন ঘণ্টা লেগে যেত। দীর্ঘ যাত্রাপথে নীল-হলুদ-সাদায় চিহ্নিত প্রগতিশীল-মধ্যপন্থী-রক্ষণশীল-মৌলবাদী নানা কিসিমের শিক্ষকদের জানার ভালো একটি মওকা পাওয়া যেত। কিছু শিক্ষক ছিলেন অগতিশীল, নিতান্তই অগোচরে থাকা এই বেচারাদের দাম বাড়ত শুধু নির্বাচনকালে।

এখানে জুটেছে দ্বিতীয় সব কটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনুজ্জ্বল প্রাণহীন আবহ নির্মাণে সাধারণভাবে শিক্ষকদের দায়ও কম নয়। তাৎক্ষণিক প্রাপ্তির চিন্তার বাইরে নিজের শিক্ষাদান-পঠন-গবেষণার মধ্যেই ডুবে থাকতেন, গুরুত্বপূর্ণ অর্জনের অংশ হয়েও নির্বিকার থাকতেন—এমন শিক্ষক নেই বা ছিলেন না এমন নয়, তবে দলভিত্তিক অগ্রাধিকারের সংস্কৃতিতে তাঁরা অপাঙ্‌ক্তেয় থাকেন।

আবার বিপরীত চিত্রও দেখতে হয়েছে—সারা বছর একটিও ক্লাস না নিয়ে, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে না এসেও দিব্যি চাকরি করেছেন, নেতাগিরিও করেছেন। আর অধিকাংশ শিক্ষক মাঝারি সত্তার নিরাপত্তার মধ্যে নিশ্চিন্ত থাকতেই পছন্দ করতেন, জ্ঞান ও চিন্তা হালনাগাদ করার প্রয়োজনও তেমন আসলে পড়ত না, হয়তো এখনো পড়ে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে স্বজনপ্রীতি বা যোগ্যতরকে বাদ দেওয়া এখন আর তেমন অভূতপূর্ব সংবাদ নয়, তবে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও বেশি দিন রসাল থাকবে বলে মনে হয় না। কর্মচারী নিয়োগে বড় কর্তা-মেজ কর্তার গ্রামসুদ্ধ নিয়োগে রেকর্ড সৃষ্টির কাছাকাছি অবস্থান করছি আমরা। এই ‘মেরুদণ্ডহীন’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সমাজে জ্ঞান-চিন্তা-যুক্তিভিত্তিক আলোকিত ও সচেতন মানুষ নির্মাণে দিশারির ভূমিকা পালনের যোগ্যতা রাখে?

আমাদের ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলোয় জাতির পথনির্দেশক হিসেবে শিক্ষকসমাজ আর সংগ্রাম-আত্মদানের অগ্রপথিক হিসেবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছাত্রসমাজের অবদান স্বর্ণের ও রক্তের অক্ষরে লেখা রয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস তাঁদের ভূমিকা বাদ দিয়ে রচিত হওয়া সম্ভব নয়।

কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য উপাচার্য আছেন বটে, কিন্তু তারও অধিক আছেন যোগ্যতাহীন অনুগত ‘জি-হুজুররা’। তাঁরা নিয়োগ দেন একই ধারার অনুগত বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভয়ংকর অন্যায় কিছু ঘটলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের উত্তর থাকে গতানুগতিক—‘এমন কিছু জানা নেই’, ‘অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে’ ইত্যাদি। সবচেয়ে নিরাপদ হলো তদন্ত কমিটি গঠন, এতে সাপও মরে, লাঠিও ভাঙে না। এটি মোটামুটি সবাই জানেন, কমিটির সুপারিশ প্রকাশ হবে না, হলেও সে অনুযায়ী শাস্তি অতিশয় বিরল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে স্বজনপ্রীতি বা যোগ্যতরকে বাদ দেওয়া এখন আর তেমন অভূতপূর্ব সংবাদ নয়, তবে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগও বেশি দিন রসাল থাকবে বলে মনে হয় না। কর্মচারী নিয়োগে বড় কর্তা-মেজ কর্তার গ্রামসুদ্ধ নিয়োগে রেকর্ড সৃষ্টির কাছাকাছি অবস্থান করছি আমরা। এই ‘মেরুদণ্ডহীন’ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সমাজে জ্ঞান-চিন্তা-যুক্তিভিত্তিক আলোকিত ও সচেতন মানুষ নির্মাণে দিশারির ভূমিকা পালনের যোগ্যতা রাখে?

সচেতন মানে বিবেকের কাছেও দায়বদ্ধ হওয়া, ঝুঁকি নিয়েও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। সেটি হচ্ছে না, কারণ কণ্ঠহীন সাধারণের প্রত্যাশা-স্বপ্ন, এমনকি ন্যূনতম চাহিদার প্রতি বর্তমানের রাজনীতি বা বিশ্ববিদ্যালয়—কেউই সংবেদনশীল নয়। দুর্বলের প্রতি দলবদ্ধ নিপীড়নকে যখন রাজনীতি তথা সমাজ উপভোগ করে, তখন ছাত্ররাজনীতিকে এককভাবে দায়ী করে কোনো সমাধান আসবে না। উদাহরণ সৃষ্টির সূচনা তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছেই প্রত্যাশিত, অতীতে তা ঘটেছেও।

এ জন্য তার সহায়ক অবকাঠামো, সুবিধা ও পরিবেশ দরকার। ছাত্র ও শিক্ষকের রাজনীতি-সচেতনতা অবশ্যই চাই, তবে সেটি চাইব জনসম্পৃক্ততা ও জনকল্যাণের প্রেক্ষাপটে, কোনো রাজনৈতিক মহলের অন্ধ আনুগত্যে অর্জিত সুবিধার জন্য নয়। অবশ্যই পরিপূরক হিসেবে চাইব সংস্কৃতিমনস্কতা ও সার্বিকভাবে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ। আলোকিত শিক্ষক ও সচেতন ছাত্র—এ দুইয়ের মিলনেই স্রোতের বিপরীতে তরি বেয়ে আবারও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠতে পারে সমাজের আলোকবর্তিকা, পথপ্রদর্শক। নির্মূল হতে পারে বিশ্বের বিদ্যালয়ে নিঃস্বের আস্ফালন।

আবুল মনসুর অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়