সুখ-দুঃখের কথা বলা কতটা জরুরি

সুখ-দুঃখের কথা বললে যে প্রাণ জুড়ায়, সেটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিখ্যাত গানে লিখে গেছেন, ‘মোরা সুখের দুখের কথা কব,/ প্রাণ জুড়াবে তায়।’ তবে এখন এই প্রাণজুড়ানো আর সহজ নয়। সুখ-দুঃখের কথা বলা তো দূরের কথা, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎই তো বন্ধ প্রায়। সবার ব্যস্ততা বেড়েছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে যানজট। উপরন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম চলে আসায় শরীরও আর আগের মতো চলতে চায় না। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ শতাংশ নাগরিক বলছেন যে মুখোমুখি অন্যদের সঙ্গে বসে এখন আর তেমন কথা হয় না এবং ১৮ শতাংশ মানুষ বলেছেন যে এখন আর মুখোমুখি বসে কথা বলার মতো লোক খুঁজেও পাওয়া যায় না। 

এখন দেখা যাক, সত্যিকারের সামাজিক মেলামেশার দুধের স্বাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ঘোল দিয়ে কতটা মেটে? এটা নিয়ে কোনো গবেষণা আমার চোখে না পড়েনি। তবে পরিসংখ্যানমতে, এখন শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হচ্ছে। কয়েক দশক আগে মানুষের গড় আয়ু যেভাবে বাড়ছিল, এখন আর সেভাবে বাড়ছে না, অনেক দেশে সেটা কমেও গেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভালো নয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯১, ২০১৩ ও ২০১৭ সালে যথাক্রমে ১৭, ২১ ও ২৯ শতাংশ নারী অবসাদে আক্রান্ত হয়েছিলেন; অর্থাৎ প্রথম ১২ বছর থেকে পরের ৪ বছরে এটা বেড়েছে দ্বিগুণ। সম্প্রতি একটি জাতীয় পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল, ‘স্মার্ট ডিভাইসে মস্তিষ্ক ক্ষয়, বাড়ছে মৃত্যুহার, বাড়ছে রোগব্যাধি।’

আমাদের দেশে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার এ সুযোগ, প্রবণতা ও সংস্কৃতি যখন ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে, তখন নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ে কিছুটা নজর দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে এ ঢিলে হয়ে যাওয়া সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আবার দৃঢ় করার কাজ শুরু করতে পারব। 

উল্টো দিকে সামাজিক মেলামেশায় যে বেশ উপকার হয়, সেটা জন জি ব্রুন ও স্টুয়ার্ট উলফের লেখা দ্য পাওয়ার অব ক্ল্যান: দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব হিউম্যান রিলেশনশিপস অন হার্ট ডিজিজ বইটি পড়লে বোঝা যায়। লেখকদের ভাষ্য অনুযায়ী, রোম থেকে প্রায় ১০০ মাইল দূরের একটি প্রায় শিক্ষাবঞ্চিত ও পিছিয়ে পড়া গ্রাম রসেটো থেকে ১১ জন ১৮৮২ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়ার ব্যাঙ্গর শহরের কাছে একটি স্লেটপাথরের খনিতে কাজ নিয়ে বসবাস শুরু করে। 

ওই ১১ জনের দেখাদেখি আরও অনেক রসেটান ইতালি থেকে ওখানে চলে আসেন। পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার একটা গ্রাম গড়ে ওঠে। নাম হয় সেই রসেটো। একেবারে অখ্যাত-অজ্ঞাত একটি গ্রাম। কিন্তু স্টুয়ার্ট উলফ নামের এক চিকিৎসকের জন্য এখন অনেকেই সেই গ্রামের নাম জানেন। উলফ ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন। একবার ওই এলাকায় একটা বক্তৃতা দিতে এসে স্থানীয় এক চিকিৎসকের কাছ থেকে তিনি শোনেন যে ৬৫ বছরের নিচে সাধারণত কোনো রসেটানের হৃদ্‌রোগ হয় না। উলফ খুব অবাক হন। 

১৯৫০-এর দশকে আমেরিকায় সেই সময় ছিল হৃদ্‌রোগের মহামারির কাল। উলফ বিষয়টা খতিয়ে দেখে পেলেন, সেখানে ৫৫ বছরের কম বয়সী কোনো রসেটান হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হননি। আর ৬৫ বছরের বেশি বয়সে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত রোগীর হার সারা দেশের সেই শতকরা হারের অর্ধেক। অন্য সব রোগের কারণেও মৃত মানুষের সংখ্যা হিসাব করলে সেটাও সারা দেশ থেকে ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম। এরপর উলফের সঙ্গে সমাজতত্ত্ববিদ জন ব্রুন এবং কিছু ছাত্র যোগ দেন। অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন। দেখেন, রসেটানদের আরও অনেক ভালো দিক আছে। 

ব্রুনের ভাষায়, ‘সেখানে কোনো আত্মহত্যা নেই, মাদকাসক্তি নেই এবং অপরাধের ঘটনাও খুব কম।...তাঁদের পেপটিক আলসারও হয় না। তাঁদের মৃত্যুর কারণ মূলত বার্ধক্য আর কিছু নয়।’ উলফ এবার এসবের কারণ খোঁজার চেষ্টা করলেন। প্রথমেই খাদ্যাভ্যাস খেয়াল করলেন। কিন্তু সেটা যে তেমন ভালো, তা নয়। যেমন তারা অলিভ অয়েলের পরিবর্তে লার্ড খায়। যা-ই হোক, তারা যা যা খায়, তার সব একজন ডায়েটিশিয়ানকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হলো। দেখা গেল, তাদের ক্যালরির বেশির ভাগ আসে চর্বিজাতীয় খাবার থেকে। উপরন্তু তারা ইয়োগা বা অন্য কোনো ব্যায়াম করে না বলে ওবেসিটিতে ভোগে। এ ছাড়া ওদের প্রচুর ধূমপানের অভ্যাস আছে।

এত অনিয়মের পরও তাদের নীরোগ থাকার কারণ হয়তো জেনেটিক। কিন্তু উলফ আমেরিকার অন্য রসেটানদের খবর নিয়ে দেখলেন যে সেটা জেনেটিক নয়। অন্যদের স্বাস্থ্য এত ভালো নয়। তাহলে কি ওই গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান? কিন্তু আশপাশের গ্রামের মেডিকেল রেকর্ড তো তা বলে না। 

কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে উলফ আর ব্রুন এবার তাদের সঙ্গে ভালো করে মিশলেন। দেখলেন, পরিবার ও সমাজে সবার সঙ্গে সবার এক অসাধারণ বন্ধন আছে। একই পরিবারে তিন পুরুষের বসবাস। প্রবীণদের শ্রদ্ধার আসনটা একেবারে পাকাপোক্ত। সামাজিক কাঠামোটা এমনভাবে ওদের বর্মের মতো ঢেকে রেখেছে যে ওরা আধুনিক জগতের কোনো চাপ অনুভব করে না। অর্থাৎ খাবার, জিন বা প্রাকৃতিক পরিবেশ নয়, ওদের সুস্থ রেখেছে ওদের সমাজ। ওরা কেবল পরস্পরের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলতে পারে বলে, পরস্পরের সুখ-দুঃখ অনুভব করে বলে ওরা সুস্থ-নীরোগ জীবন যাপন করে।

আমাদের দেশে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়ার এ সুযোগ, প্রবণতা ও সংস্কৃতি যখন ক্রমে বিলুপ্ত হচ্ছে, তখন নতুন শিক্ষাক্রমে এ বিষয়ে কিছুটা নজর দেওয়া হয়েছে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করলে হয়তো আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্য দিয়ে এ ঢিলে হয়ে যাওয়া সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধনকে আবার দৃঢ় করার কাজ শুরু করতে পারব। 

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক