এই ‘জুলিয়ানা ভার্সেস আমেরিকা’ শিরোনামের মামলাটি ইতিমধ্যে আইনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
এই ‘জুলিয়ানা ভার্সেস আমেরিকা’ শিরোনামের মামলাটি ইতিমধ্যে আইনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।

মতামত

বাইডেন সরকার কেন শিশু পরিবেশকর্মীদের বিরুদ্ধে

আমাদের সবাইকে যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের চড়া মূল্য এখনই দিয়ে যেতে হচ্ছে; কিন্তু আজকের শিশু ও তরুণ প্রজন্মকে আরও খারাপ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘ সময় ধরে মোকাবিলা করে যেতে হবে। আমরা এখন যে পথে হাঁটছি, সে পথেই যদি হাঁটতে থাকি, তাহলে নিশ্চিতভাবে তাদের বাকি জীবনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকবে।

এ কারণে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এক দল আমেরিকান শিশু একটি মামলা রুজু করে দাবি করেছিল, যেকোনো সরকারি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কথা গুরুত্বসহকারে মাথায় রাখতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পুরোদমে অনুভূত হওয়ার আগেই হয়তো আমি ভালোয় ভালোয় জীবন কাটিয়ে চলে যাবে।

কিন্তু যে ২১ জন কিশোর-কিশোরী ‘জুলিয়ানা ভার্সেস আমেরিকা’ শীর্ষক মামলাটি রুজু করেছে, তাদের প্রত্যেককেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মৌলিকভাবে বদলে যাওয়া জীবন অতিবাহিত করতে হবে। তাদের ভবিষ্যৎ যখন নিশ্চিত ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে, সে অবস্থায় এই আমেরিকান ছেলেমেয়েদের পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলাটা কোনো কার্যকর বিকল্প হতে পারে না।

জলবায়ু পরিবর্তনের শেষবেলায় এসে এখন শিশুদের হাতে এই মামলাই একমাত্র মুক্তির উপায়। তরুণদের উদ্বেগ ও বিষণ্নতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ানো জলবায়ু পরিবর্তন ইতিমধ্যে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

এই ২১ কিশোর-কিশোরী সব আমেরিকানের জন্যই একটি নজির রেখে যাচ্ছে। সুপেয় পানি ও নির্মল বাতাসের একটি বাসযোগ্য জলবায়ু আমাদের সবার অধিকার। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারকে এই মামলাটিকে বিধি অনুযায়ী এগিয়ে নিয়ে যেতে দেওয়ার বদলে তরুণ বাদীদের আদালতে আসার তীব্র বিরোধিতায় অনড় থাকতে দেখা যাচ্ছে।

মামলাটি করার পর গত ৯ বছরে বাদী ২১ কিশোর-কিশোরী এবং তাদের আইনি দলকে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কমপক্ষে ১৪ বার মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে এবং বাদীরা প্রতিবারই নিজেদের অবস্থানে অনড় থেকেছে। এই তো গত মাসেই কেন্দ্রীয় সরকার সপ্তমবারের মতো উচ্চ আদালতে একটি রিট পিটিশন দায়ের করেছে।

সাধারণ আইনি প্রক্রিয়ায় নিম্ন আদালতে কোনো মামলার শুনানি হওয়ার পর সেই আদালতে দেওয়া রায় উচ্চ আদালতে যায়। উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের সেই শুনানি ও রায় বিশ্লেষণ করে রায় দেন। কিন্তু সরকার চাইছে উচ্চ আদালত এই মামলায় নিম্ন আদালত কোনো ধরনের শুনানি গ্রহণ না করুক, সেই আদেশ দিক। সরকারের এই নতুন পদক্ষেপটি বিচারিক প্রক্রিয়াকে বিপর্যস্ত করেছে। এই পদক্ষেপটি উন্মুক্ত আদালতে ২১ তরুণ-তরুণীর পেশ করা তথ্য-প্রমাণগুলোর শুনানি গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করছে।

মার্কিন সরকারের এই পদক্ষেপ বিভ্রান্তিকর। তাদের এ ধরনের পদক্ষেপের কারণে যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের অন্যান্য আদালতে তরুণ প্রজন্ম একই ধরনের মামলা করতে আগ্রহী হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, অলাভজনক সংস্থা আওয়ার চিলড্রেনস ট্রাস্ট মন্টানার একটি আদালতে একটি মামলা করেছে।

এই ‘জুলিয়ানা ভার্সেস আমেরিকা’ শিরোনামের মামলাটি ইতিমধ্যে আইনি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রে অন্য কোনো মামলার ক্ষেত্রে নিম্ন আদালতে শুনানি গ্রহণ বন্ধে সাতটি পিটিশন হয়নি। মন্টানার আদালত বলেছেন, জলবায়ু সংকট দিন দিন গুরুতর হয়ে উঠেছে। বাস্তবতা হলো প্রতিদিন অধিকতর হারে কার্বন ডাই–অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে নির্গত হচ্ছে এবং প্রতিদিন মার্কিন সরকার জীবাশ্ম জ্বালানিশিল্পে ভর্তুকি হিসেবে লাখ লাখ ডলার খরচ করছে।

এর জন্য আমাদের দ্বিগুণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। একদিকে আমাদের ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে অত্যন্ত দূষিত জ্বালানি দিয়ে আমাদের বিদ্যুৎ খাতগুলো চালানো হচ্ছে বলে পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত—উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের ক্ষতির মূল্য পরিশোধ করতে হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে সরকার শিশুদের সঙ্গে সমঝোতায়ও আসছে না, আবার মামলার কার্যক্রমকে এগোতেও দিচ্ছে না। সরকার শিশু–কিশোরদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার জন্য ৯ বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

এই মামলার ক্ষেত্রে সরকারের ‘আমরা বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপ করি না’ বলে সরে থাকার নৈতিক সুযোগ নেই। কেননা এই মামলায় সরকার আসামিপক্ষ এবং সরকারের সলিসিটর জেনারেলের ক্রিয়াকলাপের দায় সরকারকেই নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিশুদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছানোই নৈতিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে এবং পরিবেশগতভাবে সবচেয়ে ভালো ফল বয়ে আনবে। তারা শুধু চায় সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় তাদের এবং পরবর্তী প্রজন্মের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয় বিবেচনা করুক। এটি একটি সরল–সোজা চাওয়া বলে মনে হচ্ছে। এরপরও যদি কোনো অদ্ভুত কারণে প্রশাসন মীমাংসা করতে না চায়, তাহলে অন্তত বিষয়টিকে বিচারের দিকে এগিয়ে যেতে দেওয়া উচিত।

আমাদের অবশ্যই এই ২১ জন শিশু–কিশোরের পাশে দাঁড়াতে হবে। কারণ, এ ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার বিলম্বিত হওয়ার সত্যিকার অর্থ দাঁড়াবে ন্যায়বিচারকে অস্বীকার করা।

● জোসেফ ই স্টিগলিৎজ নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত