অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সবচেয়ে বেশি আলোচনায় ছিল রাষ্ট্র সংস্কার। কেউ কেউ সংস্কার ছাড়িয়ে পুরো রাষ্ট্রের খোলনলচে সব বদলে দেওয়া এবং সংবিধান পুনর্লিখনের কথাও বলেছিলেন।
প্রশ্ন উঠেছে, সংবিধান পুনর্লিখন হলে সেটি অনুমোদন করা হবে কীভাবে? এ ক্ষেত্রে নানা ধরনের মত আছে। কেউ বলেছেন, সংবিধান সভা গঠন করতে হবে, যারা সংবিধান প্রণয়নের পর পাঁচ বছর জাতীয় সংসদ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করতে পারবে।
অন্যদের যুক্তি হলো, সংবিধান সভা সংবিধান প্রণয়ন করেই দায়িত্ব শেষ করবে। নতুন সরকার গঠন করতে হলে নতুন করে জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে হবে। যেমনটি হয়েছিল ১৯৭২ সালে। আবার কারও মতে, গণভোটের মাধ্যমেও সংবিধান অনুমোদন করা হবে। এরপর নতুন নির্বাচন হবে জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য।
আমাদের দেশে গণভোটের উদাহরণ খুব সুখকর নয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গণভোট করে তাঁদের কর্মসূচি যথাক্রমে ১৯ দফা ও ১৮ দফা অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন। গণভোটে অবিশ্বাস্যভাবে কোথাও কোথাও ৯৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। তবে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি শাসনপদ্ধতি থেকে সংসদীয় পদ্ধতির শাসনে ফিরে আসতে যে গণভোট হয়েছিল, সেটা অপেক্ষাকৃত কম বিতর্কিত ছিল। রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সংসদীয় পদ্ধতি চালু হয়। গণভোট ছিল নিয়ম রক্ষা।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা বলেছেন; কিন্তু সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেননি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচন আয়োজনে যে সংস্কার কমিশনের সুপারিশমালায় রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের সব মানুষের মতামত অপরিহার্য, সেই কমিশন হলো সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই সুপারিশমালার কোন অংশ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তার ভিত্তিতে নির্বাচনী আইন সংশোধন করতে হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কিংবা লিখিত সুপারিশের ভিত্তিতে জানা যাবে; কিন্তু দেশের সব মানুষের মতামত কীভাবে জানা যাবে? এর মাধ্যমে কি প্রধান উপদেষ্টা নতুন করে গণভোটের ইঙ্গিত দিলেন কি না, সেটাই প্রশ্ন।
সংস্কার কমিশনের সুপারিশ সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, আপনারা সুযোগ দিলে প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই আমরা আপনাদের কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন আয়োজন করব। তত দিন পর্যন্ত আমি আপনাদের ধৈর্য ধারণ করার অনুরোধ করব।’
প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যের প্রতিধ্বনি পাওয়া গেল আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কথায়ও। মঙ্গলবার আইন মন্ত্রণালয়ের গত ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেছেন, অতিপ্রয়োজনীয় কিছুসংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেওয়া হবে।
সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে সর্বত্রই একটি প্রশ্ন শোনা যায়, সেটি হলো তারা কত দিন থাকবে, তাদের মেয়াদ কত দিন হবে, নির্বাচন কবে হবে?’
আইন উপদেষ্টার জবাব ছিল এমন ‘এটি আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। তবে আপনাকে একটি বিষয় বলি, আমরা মোস্ট এসেনশিয়াল কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আর এটা চাই না, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নাই।’
প্রধান উপদেষ্টা ও আইন উপদেষ্টার কথার মধ্যে ঘোরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু কোনো কোনো উপদেষ্টার কথাবার্তায় এমনও আভাস পাওয়া যায় যে সংস্কারকাজ শেষ না হলে নির্বাচন হবে না। এখানেই রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি। তাদের মতে, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, সংস্কারের উদ্দেশ্যে গঠিত কমিশনগুলোর দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যত দ্রুত ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবে, তত দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা সম্ভব হবে। তাঁর এ কথার মধ্যে ধোঁয়াশা আছে। রাজনৈতিক দলগুলো ঐকমত্য না হলে কি নির্বাচন হবে না? নির্বাচনের ধরন, পদ্ধতি ও সময় ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যত মতপার্থক্য থাকুক না কেন, নির্বাচনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সিদ্ধান্তে তো আসতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘অনেকে আশান্বিত হয়েছেন, আমি একটু আশাহত হয়েছি। আমি আশা করেছিলাম, প্রধান উপদেষ্টা তাঁর সব প্রজ্ঞা দিয়ে সমস্যাটা চিহ্নিত করে নির্বাচনের জন্য একটা রূপরেখা দেবেন।’
দ্রুত নির্বাচন দেওয়ার কথা উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘যত দ্রুত নির্বাচন হবে, তা দেশের জন্য, জাতির জন্য মঙ্গল। এটা বলছি আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে। এ ধরনের সরকার যত বেশি দিন ক্ষমতায় থাকে, তত সমস্যা তৈরি হয়। কারণ, এদের তো ম্যান্ডেট নেই, এরা তো নির্বাচিত সরকার নয়।’
আল-জাজিরার সঙ্গে দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কেন তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) এত লম্বা সময়ের কথা বলছেন। (সংস্কার) এটা তো এত লম্বা সময়ের কথা নয়। মনে হচ্ছে, সরকারের মধ্যে কোথাও কোনো জায়গায় ঘাপলা আছে। সরকারের মধ্যে কোথাও কোনো মাস্টারপ্ল্যান আছে কি না, এটা এখন আমাদের ভাবিয়ে তুলছে।’
প্রধান উপদেষ্টার কাছে আল-জাজিরার সাংবাদিকের প্রশ্ন ছিল, বাংলাদেশে আগামী নির্বাচনের সঠিক সময় কখন হবে, সে বিষয়ে ড. ইউনূসের কোনো ভাবনা আছে কি না। সে প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘না। আমার মাথায় এমন কিছু নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি রাজনৈতিক দলগুলো চায় এটা (সংস্কার) ভুলে যাও, নির্বাচন দাও। তাহলে সেটা করা হবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে ড. ইউনূস বলেন, সাধারণত নিয়মিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। মানুষ সরকারের মেয়াদ কম চায়। সংবিধানে নতুন করে চার বছরের প্রস্তাব করা হচ্ছে। সুতরাং এটা চার বছর বা তারও কম হতে পারে। এটা পুরোটা নির্ভর করছে মানুষ কী চায়, রাজনৈতিক দলগুলো কী চায় তার ওপরে।
তাহলে অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি চার বছর থাকছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমি তা বলিনি যে চার বছর। আমি বলেছি, এটা সর্বোচ্চ মেয়াদ হতে পারে। তবে আমাদের উদ্দেশ্য তা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা।’
প্রধান উপদেষ্টার সাক্ষাৎকারের নানা প্রতিক্রিয়া দেখে তাঁর প্রেস উইং থেকে একটি ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে যাঁরা বেশ সক্রিয়, তাঁদের মধ্যে আসিফ নজরুল একজন। বলা যায় অগ্রগণ্য। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক। তাঁকে যেসব মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাদের কাজের ধরনের সঙ্গে তিনি আগেই কিছুটা পরিচিত।
মঙ্গলবার ‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে আইন মন্ত্রণালয়ের বিগত ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা।
আইন উপদেষ্টার কাছে প্রশ্ন ছিল আপনি আপনার কাজের জন্য ১০-এর মধ্যে কত নম্বর দেবেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ৪ নম্বর। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাঁর অভিজ্ঞতার হয়তো ঘাটতি আছে বা যোগ্যতারও হয়তো ঘাটতি আছে। কিন্তু বারবার একটা কথা বলেন, সেটা হলো, তাঁর প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই।
উপদেষ্টা হিসেবে আসিফ নজরুলের কাজ বেশ দৃশ্যমান। আরও কয়েকজন উপদেষ্টার কাজও দৃশ্যমান। তাঁদের নম্বরও চারের নিচে হবে না। কেউ কেউ পাঁচ–ছয়ও পেতে পারেন। কিন্তু যাঁদের কাজ একেবারেই দৃশ্যমান নয়, যাঁদের মন্ত্রণালয়ে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না, তাঁরা কত পাবেন?
কয়েক দিন আগে খবরে পড়েছিলাম প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস সব উপদেষ্টার কাজের হিসাব চেয়েছেন। তিনি সবার কাজের হিসাব পেয়েছেন কি না, জানি না। পেলে তিনি কাকে কত নম্বর দিয়েছেন?
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি