গাজায় ইসরায়েলি হামলা ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে খেলছে এক ফিলিস্তিনি শিশু
গাজায় ইসরায়েলি হামলা ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে খেলছে এক ফিলিস্তিনি শিশু

‘আমি তো ইসরায়েলে আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না’

যুদ্ধের সময়ে মা হয়ে চলার জন্য কেউ আপনাকে কখনো প্রস্তুত করবে না।
আমার শৈশবে একমাত্র যে ব্যক্তিটি আমাকে যুদ্ধ নিয়ে অনেক কিছু বলেছেন, তিনি হলেন আমার পিতামহ। দামেস্কে জন্ম তাঁর। অনেক পথ পাড়ি দিয়ে গোলান মালভূমিতে এসে বসতি গড়েছিলেন। তিনি আমাকে ইতিহাস, সাহিত্য ও আরবি কাব্য শিক্ষা দিয়েছেন, আমার মধ্যে বই পড়ার প্রতি ভালোবাসা গড়ে দিয়েছেন।

আমার আজও মনে পড়ে, বাড়ির ভেতর তাঁর লাইব্রেরিটা ঠাসা ছিল আরবি, ইংরেজি ও ফরাসি বইপত্রে আর সেখানে বসেই তিনি আমাদের বলতেন, ‘ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যের একটি অংশ। আর এটা হলো জ্বলন্ত সংঘাতের একটা অঞ্চল। একদিন তোমারা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে।’

এরপর দুই দশকের বেশি পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আমি আজও এতে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি। ১৯৯৭ সালে দুটি সেনা হেলিকপ্টারের সংঘর্ষে আমাদের পরিবারের একজন নিহত হওয়ার পর পারিনি। ২০০৬ সালে দ্বিতীয় লেবানন যুদ্ধের পরও পারিনি।

আমি যেখানে বেড়ে উঠেছিলাম, সেই কিসরা-সুমেইতে আমাদের বাড়ির কাছে লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর নিক্ষেপিত কাতেউশা রকেট এসে পড়েছিল তখন। আর গত বছর অক্টোবরের ৭ তারিখে যখন আমাদের এক আত্মীয় মারাত্মকভাবে আহত হলেন, তখনো পারিনি।

সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আমার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে। ছোটবেলায় পিতামহের কাছে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের কত গল্পই না শুনেছি। দামেস্কের পুরোনো শহরের উমাইয়া মসজিদের কাছে আল-হামিদিয়াহ সুক আর আল-জাহিরিয়া লাইব্রেরির কথা শুনেছি কতবার। এভাবে শুনতে শুনতে কখনো না গিয়েই আমি দামেস্কের প্রেমে পড়েছি।

যখন যুদ্ধ শুরু হলো, তখন আমার গর্ভে আমার প্রথম সন্তান। জন্মের পর মেয়েটির নাম রাখলাম শাম, দামেস্কের অপর নাম। আমার পিতামহ অবশ্য তত দিনে বেঁচে নেই। তবে এই নামকরণের মধ্য দিয়ে আমি আমাদের পরিবারের ইতিহাসকে শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছি, আর মনে রাখতে চেয়েছি যে আমাদের জীবন শিকড় থেকে উৎপাটিত হয়ে গিয়েছিল।  

শামের জন্মের পরও সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আমাকে একা থাকতে দেয়নি। সর্বত্রই যে বাস্তুচ্যুত সিরীয়দের সমাগম। জর্দানের জায়াতারি শরণার্থীশিবিরে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, এমনকি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে যেগুলো তখন আহত ব্যক্তিদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছিল। শরণার্থীদের চোখে তাঁদের অসহনীয় যন্ত্রণা আর তাঁদের মুখ থেকে বিবরণ শোনার পরও আমার এ শিক্ষা হয়নি যে এখনকার সবচেয়ে কঠিনতম যুদ্ধকালীন সময়গুলোতে একজন মাকে কী করতে হয়।

তবে গত অক্টোবর থেকে আমি যেন নিশ্চুপ বনে গেছি। আমি আমার নিজের কোনো শব্দ যেন খুঁজে পাচ্ছি না। যা পাচ্ছি, তা হলো গাজা উপত্যকা থেকে বয়ে আনা নিষ্ঠুর সাক্ষ্য।

গাজাসংক্রান্ত সংবাদগুলোতো সব বিশেষজ্ঞ, সেনা কর্মকর্তা আর রাজনীতিবিদদের ভাষ্যে, ভর্তি যাঁরা, প্রায় সবাই পুরুষ এবং তাঁদের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিও সামরিক। তাঁরা সব সময়ই খুব আত্মবিশ্বাসের কথা বলে যাচ্ছেন। যদি সপ্তাহখানেকের মাথায় তাঁদের কথাগুলো ভুল প্রমাণিতও হয়, এরপরও তাঁরা একই সুরে কথা বলছেন। বিপরীতে আমি এখনো নিশ্চিত নই যে আমি জানি ‘কী করা উচিত’ অথবা কোনটা ‘কৌশলগতভাবে সঠিক।

দুই কন্যার মা আমি এখন আবু সুনানে [ইসরায়েলের উত্তর দিকে গ্যালিলির একটি আরব অধ্যুাষিত মফস্‌সল] বসবাস করছি। আমার বর্ধিত পরিবার আরও উত্তরে থাকে। তারা এবং আমি প্রতিনিয়ত প্রতিটি সড়কে ও প্রান্তে এই যুদ্ধ টের পাচ্ছি। যুদ্ধবিমান, মিসাইল ছেদকারী, সাইরেন আর কখনো–বা মাটিতে এসে পতিত হওয়া মিসাইলের বিকট শব্দ ভোর থেকে রাত পর্যন্ত আমাদের কানে ভেসে আসে। এ রকম এক আতঙ্কময় ও গোলমেলে পরিস্থিতির মধ্যেও আমি এখন একটা রুটিন মেনে চলার চেষ্টা করছি।

প্রতিদিন আমি পোষা কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বের হই। আমার বড় মেয়ে শাম প্রায়ই আমার সঙ্গী হয়। তালগাছ ও জলপাইগাছের সারির মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা সবুজের সমারোহে আমরা হেঁটে চলি। কখনো–বা হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই আরেক এলাকায়, ক্লিল যার নাম। পানিতে ভিজে যাওয়ার পর মাটির কড়া গন্ধ কখনো নাকে এসে লাগে।  

শামের বয়স ১১ বছর হয়ে গেছে। ও একাধারে আরবি ও ইংরেজিতে চমৎকার কথা বলে যে দুটোই ওর মাতৃভাষা। পড়েও প্রচুর। আমার চেয়ে অনেক বেশি জানে যুদ্ধ সম্পর্কে, যা ওর বয়সে আমি জানতামও না। নিজের কোনো বিষয়ে মধ্যস্থতা করার জন্য মাকে ওর এখন আর দরকার পড়ে না!

যে সত্যটা আমি আমার কন্যাদের বলতে চাই অথচ পারছি না, তা হলো আমি তো ইসরায়েলে আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না। আরও সত্যি হলো আমি ভীত হয়ে পড়েছি আর তোমরা, আমার দুই মেয়ে, আমাকে সক্রিয় রেখেছ। কারণ, আমি একজন মা আর আমার কিছু কর্তব্য আছে।

হাঁটতে হাঁটতে আমরা অনেক কিছু নিয়ে কথা বলি। কখনো–বা চুপ থাকি। কখনো আমরা হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকি আর কুকুরটার ছোটাছুটি দেখি। তখন মনে হয়, সবকিছু স্বাভাবিকই আছে। কিন্তু অদূরে কোথায় কখনো কখনো মিসাইল ছেদকারীর শব্দে আমাদের আলাপ সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। [গাজা থেকে হামাসের বা লেবানন থেকে হিজবুল্লাহর ছোড়া রকেট বা ক্ষেপণাস্ত্র শূন্যে থাকতেই ইসরায়েলি বাহিনী আয়রনডোম দিয়ে পাল্টা আঘাত হেনে নিষ্ক্রিয় করে দেয়, যা ইন্টারসেপ্ট বা মিসাইল ছেদক হিসেবে পরিচিত]।

আমাদের সবকিছুর পটভূমিতেই যুদ্ধ। শাম প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করে, ‘মা, যুদ্ধ কবে শেষ হবে?’ আমার কাছে তো কোনো উত্তর নেই। আমি ওর সামনে কাঁদা থেকে নিজেকে সংযত করে চলি।

তবে গত শুক্রবারটা (২৯ জুন) বিশেষ একটা খারাপ দিনই ছিল। ভীষণভাবে সাইরেন বেজে চলা আর মিসাইল ছেদকগুলোর শব্দ এত কাছে হচ্ছিল যে নিরাপদ কক্ষে [ মূলত বাংকার] আমার পাঁচ বছরের ছোট মেয়ে হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, যুদ্ধ কবে শেষ হবে?’ কোনো উত্তর না দিয়ে আমি কান্নায় ভেঙে পড়লে  আমার দুই মেয়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিল। ওদের কাছে যে মা সুপারওমেন, সে এ রকম কাঁদছে! আমি অবশ্য দ্রুত সামলে নিই যেন ওরা ভীত হয়ে না পড়ে।

৯ মাস ধরে আমি তো এই মুখোশ ধারণ করে চলেছি। ওদিকে যাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন ও আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেই সব পুরুষ ক্রমাগত ঘোষণা দিয়ে চলেছেন যে ‘আমরা সবাই মিলে জয়ী হব।’

আমি গাজার শিশুদের নিয়ে লিখছি, আবার সাইরেন বেজে উঠলেই আমার কন্যাদের নিয়ে নিরাপদ কক্ষে চলে যাচ্ছি। আমি তো একটা মর্যাদাবান জীবনাচরণ করছি আর কন্যাদের বলছি যে সবকিছু ঠিক আছে। আর নিজেকে এই বলে প্রবোধ দিচ্ছি, ‘যা করছি, তা তো ‘আমার মেয়েদের জন্য।’

কিন্তু আমি জানি যে এটা  মিথ্যা। একজন সাংবাদিক হিসেবে, একজন মা হিসেবে এবং একজন নারী হিসেবে আমি এই যুদ্ধের সময় জীবনধারণ করছি। আমার আত্মা তো মৃত্যুভয়ে ভীত। যে সত্যটা আমি আমার কন্যাদের বলতে চাই অথচ পারছি না, তা হলো আমি তো ইসরায়েলে আর কোনো ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি না। আরও সত্যি হলো আমি ভীত হয়ে পড়েছি আর তোমরা, আমার দুই মেয়ে, আমাকে সক্রিয় রেখেছ। কারণ, আমি একজন মা আর আমার কিছু কর্তব্য আছে।

আমার মনে হয়, শাম ইতিমধ্যে এসব জেনে গেছে। দুই সপ্তাহ আগে আমরা যখন হাঁটতে যাই, তখন ও এসব পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিল। আমার চোখ দিয়ে পানি ঝরতে দেখে ও প্রশ্ন করেছিল, ‘কেন তুমি কাঁদছ?’ জবাবে আমি বলেছিলাম, ‘কারণ, তুমি খুব দ্রুত বড় হয়ে গেছ। কারণ, শিশুদের তো তাদের স্বপ্নগুলো কীভাবে ডানা মেলবে, সেটাই চিন্তা করার কথা, যুদ্ধ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কথা নয়।’

একটু চুপ করে থেকে ও বলেছিল, ‘মা, তুমি আমাদের নিয়ে লেখো।’ আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাতে ও যোগ করেছিল, ‘আমাকে নিয়ে, যুদ্ধের সময় আমার জীবনটা নিয়ে লেখো। লেখো, কীভাবে আমি মিসাইলছেদকের শব্দ শুনছি, কীভাবে ভয় পেয়ে কেঁপে উঠছি। তোমাকে এসব লিখতেই হবে।’

প্রতিদিন এই উত্তরে [লেবানন সীমান্তের কাছে] যুদ্ধের ছায়ায় আর গভীর হতাশার মধ্যে জীবন বয়ে চলা যে কতটা অসহনীয়, তা বেশির ভাগ ইসরায়েলির কাছে অদৃশ্য রয়ে গেছে। আমি জীবনে কখনো এতটা অসহায় বোধ করিনি।

সাধারণ ইসরায়েলি যারা বসতি ছেড়ে অন্যত্র সরে গেছে আর আমরা যারা ঝুঁকি নিয়ে এই উত্তরে রয়ে গেছি, তাদের ভোগান্তি নিয়ে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার কোনো বিদেশি পাসপোর্টও নেই, নেই অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা। আমার আছে শুধু আমার উচ্চারণগুলো।

আমার পাঠকদের কাছে আমার ব্যক্তিগত সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলা সহজ কাজ নয়। তাঁরাই–বা কেন এসব শুনতে চাইবেন? বরং আমার পিতামহের মতো তাঁরাও এটা প্রত্যাশা করেন যে আমরা এসবে অভ্যস্ত হয়ে যাব। কিন্তু আমি তা হতে চাই না। চাই না অভ্যস্ত হতে প্রতিনিয়ত হত্যাযজ্ঞ আর মৃত্যুভয়ে জীবনযাপনে; চাই না এমন পরিস্থিতিতে যেখানে মানুষের যন্ত্রণা অদৃশ্য থাকে; আর চাই না এমনভাবে দিন অতিবাহিত করতে, যেখানে যুদ্ধের নিনাদ স্থায়ীভাবে আমাদের সঙ্গী।  

  • শিরিন ফালাহ সাব একজন আরব-ইসরায়েলি সাংবাদিক। হারেৎজ–এ প্রকাশিত তাঁর লেখাটির ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তর করেছেন আসজাদুল কিবরিয়া