মতামত

সুষ্ঠু নির্বাচন নাগরিক অধিকারের সূচনাবিন্দু

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ এবারই প্রথম নয়। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন করেছিল আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় পার্টি।

ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপি সরকারের একতরফা নির্বাচনের পর ওই আন্দোলন আরও তীব্র হয়। এ আন্দোলন একপর্যায়ে ধারাবাহিক হরতাল ও অবরোধে রূপ নেয়। বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দল এখন হয়তো সেই পথই গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আসলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে, যুক্তিতর্ক কাজ করলে, প্রতিষ্ঠানগুলো চলতে পারলে এসব দরকার হয় না। কিন্তু বাংলাদেশে এসব কাজ করে না বলেই জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে জনগণের জীবনই বিপদগ্রস্ত হয়।

১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে দলীয় সরকারের অধীনে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হয়নি। এ কারণে ৮০–এর দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা গ্রহণযোগ্যতা পায়। ১৯৭৫ সাল থেকে দীর্ঘ দেড় দশক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক শাসন এবং প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকারের পর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯১ সালে দেশে নির্বাচিত সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের যাত্রা শুরু। এর আগে আন্দোলনের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে—নির্বাচন কার অধীনে হবে?

এরশাদের অধীনে প্রশ্নই নেই। ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতিগত জটিলতা নিরসন এবং সবার সম্মতি অর্জনের চেষ্টায় একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে বাধ্য হওয়ার পর প্রথমে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন। তারপর আন্দোলনকারী আট দল, সাত দল, পাঁচ দলসহ সব কটি জোটের সম্মতিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ পান।

এরপর এরশাদ পদত্যাগ করলে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ তখন সবার সম্মতিক্রমে একটি উপদেষ্টামণ্ডলী গঠন করেন, যাঁদের দায়িত্ব নির্ধারিত হয় তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন করা। তাঁরা সেটা দক্ষতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছিলেন।

সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি। তাদের মেয়াদের পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালে আরেকটি নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে, এই বিশ্বাস সৃষ্টির মতো কোনো কাজ সেই সরকার করেনি।

সংবিধানেও এ রকম কোনো বিধান তখন ছিল না। তাই সংবিধানে এই ধারা যোগ করে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আওয়ামী লীগ আন্দোলন শুরু করে। প্রথমে বিএনপির সঙ্গে থাকলেও পরে জামায়াতও আওয়ামী লীগের সঙ্গে এই আন্দোলনে যোগ দেয়, যোগ দেয় জাতীয় পার্টিও। আন্দোলনের চাপে একতরফা নির্বাচনে গঠিত সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান যুক্ত হয়।

এই দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার পর কেউ আর ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চায় না। কেননা তাতে ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা এবং বাইরে থাকার মধ্যে অনেকের জন্য স্বর্গ-নরকের ব্যবধান। বর্তমান সরকার বলছে, তাদের সঙ্গেই জনগণ আছে কিন্তু তাদের ভোটে নির্বাচিত হতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যেতে তারা রাজি নয়!

সাংবিধানিকভাবে গঠিত প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তাঁর পদবি ছিল প্রধান উপদেষ্টা। এই ধারায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়, যেখানে সবার অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ, ২০০১ সালে বিএনপি জোট, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জোট নির্বাচিত হয়। মোটামুটি গ্রহণযোগ্য যে কটি নির্বাচন হয়েছে, তার কোনোটিতেই ক্ষমতাসীন দল পুনর্নির্বাচিত হতে পারেনি।

সেই শিক্ষা নিয়ে বিএনপি নিজের সুবিধামতো তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের চেষ্টা করে ২০০৬ সালে। সে বছর সরকারের অনমনীয়তায় এবং আওয়ামী লীগের অব্যাহত আন্দোলনে যে অচলাবস্থা তৈরি হয়, তার সমাধান হিসেবে আসে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং এর দুই বছর পর নির্বাচন হয়।

একই শিক্ষা নিয়ে ২০০৮ সালে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ একক ক্ষমতাবলে সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারাটিই বাদ দিয়ে দেয়। তারপর দলীয় সরকারের অধীনে দুটি নির্বাচন হয়েছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে।

প্রথমটিতে একতরফা হয়েছে, সংসদের অধিকাংশ পদে কোনো নির্বাচনই হয়নি, আর দ্বিতীয়টিতে অবিশ্বাস্য দক্ষতা ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে আগের রাতে অধিকাংশ ব্যালট পূর্ণ করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে এত বছর পরও প্রমাণিত হয় যে দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দেশে এখনো সক্ষমতা তৈরি হয়নি। সেই কারণে এখন যে তত্ত্বাবধায়ক বা তদারকি বা অস্থায়ী বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি উঠেছে, তা খুবই যৌক্তিক।

কিন্তু এই দেশে ক্ষমতায় যাওয়ার পর কেউ আর ‘সুষ্ঠু নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে চায় না। কেননা তাতে ক্ষমতা হারানোর আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশে ক্ষমতায় থাকা এবং বাইরে থাকার মধ্যে অনেকের জন্য স্বর্গ-নরকের ব্যবধান। বর্তমান সরকার বলছে, তাদের সঙ্গেই জনগণ আছে কিন্তু তাদের ভোটে নির্বাচিত হতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে যেতে তারা রাজি নয়!

প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। এ সময় অনেকগুলো পরিবর্তন হয়েছে। অবকাঠামোতে নতুন দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন হয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। উড়ালসড়ক হয়েছে বেশ কিছু, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, টানেল, সড়ক নির্মিত হয়েছে। স্যাটেলাইট কেনা হয়েছে, নতুন ভবন হয়েছে অনেকগুলো, কয়লাভিত্তিক বেশ কয়েকটি এবং পারমাণবিক একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র হয়েছে। বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় অধিক কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক গুণ ব্যয়বহুল এই মেগা প্রকল্পগুলো সরকারের সাফল্য হিসেবে প্রচারিত।

পাশাপাশি কম উচ্চারিত বা উপেক্ষিত বিষয়গুলো হলো দেশের অসংখ্য সড়ক ও সেতু জরাজীর্ণ অবস্থায়, অনেক যন্ত্রপাতি ও ভবন অব্যবহৃত, বহু জায়গায় রেললাইন ঝুঁকিপূর্ণ। কম ব্যয়বহুল, পরিবেশবান্ধব পথ গ্রহণ না করে ব্যয়বহুল, ঋণ ও আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের পথ গ্রহণ করায় পুরো অর্থনীতি ভয়াবহ চাপে পড়েছে, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত হয়নি। যুক্তিতর্ক, বিশেষজ্ঞ মত, জনমত সব উপেক্ষা করে সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প এবং পুরো দেশের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ফেলে রূপপুর প্রকল্প করা হয়েছে।

জিডিপি বেড়েছে, নদী ও বন খুনও বেড়েছে, বেড়েছে বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বেড়েছে, কিন্তু স্বাধীন চিন্তা, জ্ঞান উৎপাদন, মতপ্রকাশ বিতর্কের পরিসর ভয়াবহভাবে সংকুচিত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বন্দিদশা, শিক্ষকদের মধ্যে বেড়েছে জ্ঞানচর্চার বদলে তোষামোদি সংস্কৃতি।

এ সময়ে দেশে বিপুল সম্পদশালী একটি গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে। তাদের সম্পদের প্রধান উৎস ব্যাংকঋণ লোপাট, জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদ বানানোর জন্য ব্যাংকব্যবস্থার ব্যবহার, নদী-বন দখল, সরকারি মেগা প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়ের সুবিধাভোগ, ক্ষতিকর বা অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ভাগীদার হওয়া, রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদ দখলের ব্যবস্থা, অভূতপূর্ব অনিয়ম, চুক্তিসহ বড় বড় দুর্নীতি। এর কোনোটাই সরকারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়।

গত দেড় দশকে দেশে রাষ্ট্রনৈতিক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতেও বড় পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণত সরকার যা-ই করুক, তার পর্যালোচনা, ভালো-মন্দ দেখার জন্য আরও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান দরকার হয়। সেই ভূমিকা থাকে বিচার বিভাগ, মিডিয়া, বিদ্বৎ-সমাজের। প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিচারালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, দুর্নীতি দমন কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল ইত্যাদিরও এ ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু এ সরকারের দীর্ঘ শাসনকালে বড় ঘটনা হলো সব প্রতিষ্ঠানকে প্রায় অকার্যকর করে ফেলা।

সুষ্ঠু নির্বাচনের অনুপস্থিতিতে বলপ্রয়োগ, নজরদারি, ত্রাস, জুলুম, খুন, গুম, বিজ্ঞাপনী প্রচার সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রধান অবলম্বন। সরকারের থাবার নিচে রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান, অবিরাম সরকারি মিথ্যাচারে সহযোগী সংবাদমাধ্যম ও বিদ্বৎ-সমাজের বড় অংশ। দেশি-বিদেশি কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষায় বিপন্ন দেশ ও মানুষের জীবন। অধিকার রক্ষায় দাঁড়ালে, চিন্তা-মত-ভিন্নমত প্রকাশ করলে দমন-পীড়ন, হয়রানি, শাস্তির নানা ব্যবস্থার উদ্ভাবন দেখা যায়।

সুষ্ঠু নির্বাচনসহ মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার শেষ কথা নয়, এটা মানুষ হিসেবে বিকশিত একটি সমাজ গড়ে তোলার সূচনাবিন্দু। দেশের বয়স ৫২ বছর, এ সময়ে এসে নির্বাচনের মতো প্রাথমিক বিষয় নিয়ে মানুষকে বঞ্চনা আর প্রতারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়! এ সময়ে আমাদের তো আরও বড় বিষয় নিয়ে ভাবার কথা—শ্রেণিগত, লিঙ্গীয়, ধর্মীয় ও জাতিগত বৈষম্য ও আধিপত্যের ব্যবস্থা থেকে সব মানুষের মুক্তির পথ তৈরি; দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিক্ষা, ক্রীড়া সব ক্ষেত্রে নিজেদের বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচন; সৃজনশীলতার সব পথের বাধা দূর করা ইত্যাদি। এগুলোর দিকে মনোযোগ দেবে কখন মানুষ, যখন নাগরিক হিসেবে তার প্রাথমিক অস্তিত্বই হুমকির মুখে?

  • আনু মুহাম্মদ অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

    anu@juniv.edu