যে রাজনৈতিক দল নির্বাচন ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করে একটি দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে থাকে, সে দলগুলোর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত? এই প্রশ্নের সর্বসম্মত না হলেও সুপ্রতিষ্ঠিত একটি জবাব হলো, ক্ষমতায় আসার আগেই দলটিকে নিষিদ্ধ করা উচিত।
সেই একই কাজ যদি কোনো নির্দিষ্ট রাজনীতিবিদ করেন, তাহলে তাঁর বিষয়ে কী ফয়সালা হতে পারে?
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে বিদ্রোহের ঘটনায় ভূমিকা রাখার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থিতার অযোগ্য করার ঘোষণা চেয়ে মামলা করার পর এই প্রশ্নে আমেরিকানদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়।
অনেকেই যুক্তি দিয়ে বলেছেন, ওই ঘটনার পর ট্রাম্পের নির্বাচন করার কোনো আইনি বৈধতা থাকা উচিত নয়।
জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থীদের উত্থান ঠেকাতে সেই একই ধরনের প্রশ্ন জার্মানিদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেখানে একটি প্রস্তাবে কট্টর দক্ষিণপন্থী স্বতন্ত্র রাজনীতিকদের রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার এবং চরম ডানপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফুর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) পার্টিকে সরাসরি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ওপর এই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণকে গুরুতর নিষেধাজ্ঞা হিসেবে দেখতে হবে। এটিকে একেবারে শেষ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। তবে যখন কোনো ব্যক্তিকে বারবার সতর্ক করার পরও যদি তিনি গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে সরব প্রচারণা চালিয়ে যান, তখন তাঁকে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে অযোগ্য ঘোষণা প্রকৃতপক্ষেই ন্যায়সংগত হয়ে ওঠে।
এর ব্যত্যয় হলে গণতন্ত্র একটি ভঙ্গুর ও নাজুক অবস্থার মধ্যে নিজেই নিজেকে ঠেলে দেবে।
গণতন্ত্রের এই মারাত্মক দুর্বলতাকে স্বীকার করে নিয়ে জার্মান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্ল লোভেনস্টাইন (যিনি নাৎসিরা ক্ষমতায় আসার পর জার্মানি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন) ‘মিলিট্যান্ট ডেমোক্রেসি’ বা ‘জঙ্গি গণতন্ত্র’ এর ধারণা দিয়েছিলেন।
‘জঙ্গি গণতন্ত্র’ বলতে তিনি এমন একটি ব্যবস্থাকে বোঝাতেন যে ব্যবস্থাটি নিজেকে রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনে অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না। মূলত উগ্র দলকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তিনি জোর দিয়েছিলেন।
লোভেনস্টাইন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, এ বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আগুন দিয়ে আগুন মোকাবিলা করার মতো। এ কারণে যাঁরা নিজেদের ‘জঙ্গি-গণতন্ত্রের’ হাতিয়ার মনে করেন, তাঁদের অবশ্যই গণতন্ত্রহীনতার ঝুঁকির বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে।
কারণ, যে গণতন্ত্র অগণতান্ত্রিক উপায়ে নিজেকে রক্ষা করতে চায়, তা হয়তো শেষ পর্যন্ত নিজেকেই ধ্বংস করে দিতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা সেই যুক্তি এখন যেন প্রতিশোধ হিসেবে ফিরে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চতুর্দশ সংশোধনীর ভিত্তিতে কলোরাডো এবং মেইন অঙ্গরাজ্যে ব্যালট থেকে ট্রাম্পকে (অস্থায়ীভাবে) সরিয়ে দেওয়া হয়েছে (অবশ্য পরে সুপ্রিম কোর্টে সেই আদেশ খারিজ করে দেওয়া হয়েছে)।
জার্মানিতে সংবিধানে শুধু দলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিধান রাখা হয়নি; বরং সেখানে কোনো ব্যক্তিও যদি গণতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করে, তাহলে তাঁকে রাজনৈতিক অধিকার হারাতে হতে পারে।
জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও সম্পূর্ণভাবে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করাটা সাফল্য আনতে পারবে না। আমেরিকায় এখন কার্যত দ্বিদলীয় গণগন্ত্র চলছে। ফলে সেখানে রিপাবলিকান পার্টিকে নিষিদ্ধ করা গণতন্ত্র বিলোপেরই শামিল হবে (এমনকি যদি বেশির ভাগ রিপাবলিকান ভোটার ট্রাম্পের গণতন্ত্রবিরোধী আচরণকে গ্রহণ করে থাকে, তাহলেও)।
কোনো গণতন্ত্রেরই আগুনকে আগুন দিয়ে প্রতিহত করাটাকে হেলাফেলাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। যদি একজন প্রার্থী বারবার গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ করতে থাকেন এবং তাঁকে সতর্ক করার পর তাঁর সেই আচরণ দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা ন্যায়সংগত হবে।
জার্মানিতে উগ্র ডানপন্থী দল এএফডি এত বেশি জনসমর্থন অর্জন করেছে যে জাতীয় জরিপে দেখা গেছে এই দল নিষিদ্ধ করাকে প্রায় ২০ শতাংশ ভোটার গণভোটবিরোধী অস্ত্র হিসেবে মনে করছে।
এই সমস্যা যে প্যারাডক্সকে সামনে আনে তা হলো: যখন গণতন্ত্রবিরোধী দলগুলো ছোট হয়, তখন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কিন্তু যখন তারা বড় হয়ে যায়, তখন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া সম্ভব বলে মনে হয় না।
দেখা যাচ্ছে, যেখানে গণতন্ত্রের সমর্থনে ঐকমত্য রয়েছে, সেখানে ‘জঙ্গি গণতন্ত্র’ চাইলে প্রতিষ্ঠা করা যায়। কিন্তু সেখানে তা না থাকলেও চলে। (যেমন: পশ্চিম জার্মান গণতন্ত্র সম্ভবত নব্য নাৎসি ও কমিউনিস্টদের নিষিদ্ধ না করলেও পারত)। কিন্তু একবার যদি বড় ধরনের মেরুকরণ হয়েই যায়, তাহলে ‘জঙ্গি গণতন্ত্রের’ পক্ষে আর ব্যাপক জনসমর্থন থাকে না।
এর কারণ, এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে রাজনীতিবিদেরা এই চিন্তায় পড়ে যান যে এর হাতিয়ার তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে।
যাঁরা জঙ্গি গণতন্ত্রের বিরোধিতা করেন, মূলত তাঁরা বিকল্পধারাকে সমর্থন করেন। তাঁদের ধারণা, একটি পরিচ্ছন্ন রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। ভোটের একটি নিষ্পত্তিমূলক ফলাফল পাওয়া যাবে। এর মধ্য দিয়েই ট্রাম্পের আরেকটি পরাজয় সূচিত হবে। এর মধ্য দিয়েই তাঁকে জাতীয় মঞ্চ থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
ট্রাম্প ভালোভাবে স্পষ্ট করেছেন, তিনি প্রচারণাকে বর্ণবাদ দিয়ে দূষিত করবেন এবং সম্ভবত প্রচারের সময় সহিংসতার আহ্বান জানাবেন। নির্বাচনের ফলাফল যা–ই হোক না কেন, তিনি জয়ের দাবি করবেন।
ফলাফল কাছাকাছি হলে তিনি জালিয়াতির অভিযোগ তুলে চিৎকার–চেঁচামেচি করবেন। ফল যদি তাঁর বিরুদ্ধে ভূমিধস মাত্রার হয় তাহলে তিনি দাবি করবেন, পুরো বিষয়টি কারচুপি করা হয়েছে।
সে কারণে কোনো গণতন্ত্রেরই আগুনকে আগুন দিয়ে প্রতিহত করাটাকে হেলাফেলাভাবে নেওয়া ঠিক হবে না। যদি একজন প্রার্থী বারবার গণতন্ত্রবিরোধী আচরণ করতে থাকেন এবং তাঁকে সতর্ক করার পর তাঁর সেই আচরণ দ্বিগুণ হয়ে যায়, তাহলে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা ন্যায়সংগত হবে।
● জ্যঁ ভার্নার ম্যুলার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত