ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে যা বলছে পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি

ইউক্রেনে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে দুই পক্ষের কারোরই সরে যাওয়ার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।
ছবি: রয়টার্স

গত সপ্তাহে পেন্টাগনের শ্রেণিকৃত যে নথি ফাঁস হয়েছে, সেখানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথ কোন দিকে যাচ্ছে, তার খুব বিষণ্ন একটি চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। এক দশক আগে মাইকেল স্নোডেন কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সির নথি ফাঁসের পর সাম্প্রতিক এই ফাঁস হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।

নথি ফাঁসের এই ঘটনা একটি গুরুতর বিষয় সামনে নিয়ে আসছে। সেটা হলো যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটির নিম্নস্তরের কর্মকর্তাও কীভাবে সরকারের অতি সংবেদনশীল তথ্যে প্রবেশের সুযোগ পান এবং সেগুলো তাঁরা ফাঁসও করে দিতে পারেন। তুলনামূলক বিচারে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যে নথি ফাঁস হয়েছে, তা ধরনের দিক থেকে কম বিস্ফোরক প্রকৃতির। এতে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁদের মূল্যায়ন তুলে ধরেছেন। ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে বসন্তকালে যে আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করতে চলেছে, শেষ পর্যন্ত তা কোনো ফলাফল দিতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন মার্কিন গোয়েন্দারা।

ইউক্রেনের প্রধান খামতি হলো অস্ত্র ও গোলাবারুদের সংকট এবং আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নাজুক দশা। অবশ্য এটা নতুন কোনো খবর নয়। ফাঁস হওয়া নথি আবার নিশ্চিত করল, ইউক্রেন সোভিয়েত জামানার অস্ত্রশস্ত্রের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল এবং তাদের গোলাবারুদের মজুত ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। ইউক্রেনের কাছে পশ্চিমা অস্ত্রশস্ত্র খুব ধীর গতিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। ইউক্রেনীয় বাহিনীকে এই অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষিত করতে সময়ও লাগছে। ইউক্রেনে যে পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রয়োজন, সেই পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনের সক্ষমতা এখন পশ্চিমাদের নেই।

রাশিয়ার সুরক্ষিত প্রতিরক্ষার বিপরীতে পাল্টা আক্রমণ চালানোর মতো প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি রয়েছে ইউক্রেনের। এ বাস্তবতায় ইউক্রেন তাদের বসন্তকালীন পাল্টা আক্রমণে বেশি কিছু অর্জন করতে না পারলে সেটা বিস্ময়ের কিছু নয়।

রাশিয়াও গত কয়েক মাসের আক্রমণ থেকে খুব সামান্য ভূমিই নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে। ইউক্রেনের বাখমুত শহর ঘিরে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক মাস ধরে যে তুমুল প্রতিযোগিতা চলছে, তাতে করে এই যুদ্ধে কী সম্ভব আর কী সম্ভব নয়, তার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। একইভাবে সোলেদার শহরে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলছে এবং সেই যুদ্ধে যে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি, তাতে এটা স্পষ্ট যে কৌশলগত দিক থেকে খুব গুরুত্বহীন কোনো ভূখণ্ড জয় করতে হলেও এই যুদ্ধে কতটা মূল্য দিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন হলো, ইউক্রেনের দিক থেকে পরিচালিত কোনো পাল্টা আক্রমণে যুদ্ধের বাঁক্‌বদল হবে না। এই যুদ্ধ আরও কয়েক বছর স্থায়ী হবে। কেউ কেউ মনে করছেন, এই যুদ্ধ অনন্তকাল ধরে চলবে।

যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে দুই পক্ষের কারওরই সরে যাওয়ার ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না। পেন্টাগনের যে নথি ফাঁস হয়েছে, সেখান থেকেই দেখা যাচ্ছে, গত বছর ৪০ হাজারের বেশি রুশ সেনা নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ৮০ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। ইউক্রেনের পক্ষে হতাহতের সংখ্যা কিছুটা কম। তাদের সাড়ে ১৭ হাজার সেনা নিহত হয়েছেন এবং ১ লাখ ১৩ হাজার সেনা আহত হয়েছেন। কিন্তু হতাহতের এই সংখ্যাও তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু দুই পক্ষই সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যুক্ত হওয়ার জন্য কড়াকড়ি আরোপ করছে। রাশিয়া ও কিয়েভ দুই পক্ষেরই উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি করা।

ইউক্রেনের প্রেক্ষাপট থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পশ্চিমা মিত্রদের সহযোগিতা অব্যাহতভাবে পাওয়া। পশ্চিমা দেশগুলো তাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে সমস্যায় পড়েছে এবং ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা সরবরাহের ক্ষেত্রেও সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। তা সত্ত্বেও যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনের পরাজয়ের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে, এতটা কম অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ তারা করছে না।

যুদ্ধে অচলাবস্থা সৃষ্টির আংশিক কারণ অবশ্য মস্কো সামরিক দিক থেকে এতটা অগ্রসর নয় যে তারা কিয়েভকে পরাজিত করার মতো বড় আঘাত হানতে পারবে।

অচলাবস্থা চলছেই

এই যুদ্ধে গত বছরের শেষ দিকে ইউক্রেনের দিক থেকে পরিচালিত পাল্টা আক্রমণ যখন শেষ হয়েছিল, সে সময় থেকেই কৌশলগত অচলাবস্থা চলছে। এরপর কোনো পক্ষই দাবি করতে পারবে না যে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার মতো বড় কিছু অর্জন করতে পেরেছে।

ফাঁস হওয়া নথি অনুসারে, রাশিয়া অন্য কোনো দেশ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সামরিক সহায়তা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। মস্কোকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা কারখানাগুলো পুনরায় চালু করার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। সেসব কারখানা থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদের জোগান আসতে সময় লাগছে। কিন্তু রাশিয়ার সামরিক উৎপাদন বিঘ্নিত হওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ হলো অত্যাধুনিক সেমিকন্ডাক্টর পণ্যের মতো ক্রিটিক্যাল পণ্যের ঘাটতি রয়েছে তাদের। মস্কোর সবচেয়ে প্রধান মিত্র চীনের এ ধরনের পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা নেই কিংবা তারা এ ব্যাপারে অনিচ্ছুক।

যত সময় গড়াবে, রাশিয়ার নিজস্ব সামরিক সক্ষমতা ততই বাড়বে। দেশটির হাতে প্রচুর সম্পদ আছে, পর্যাপ্ত জনশক্তিও আছে। রাশিয়ার অর্থনীতি দুর্বল হবে কিন্তু ভেঙে পড়ার অবস্থায় যাবে না। রাশিয়া ও এর নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর ওপর পুতিনের নিয়ন্ত্রণ কোনো অংশেই কমেনি। রাশিয়ার মধ্যে তাঁর ক্ষমতার সবচেয়ে মৃদু বিরোধিতাও যাঁরা করছেন এবং তাঁর যুদ্ধ বয়ানের বিপরীতে যাঁরা কথা বলছেন, তাঁদের দমন করার সক্ষমতা পুতিন দেখিয়ে চলেছেন।

রাশিয়ার সক্ষমতা বাড়ার এই চিত্রের সঙ্গে ইউক্রেন ও তার পশ্চিমা মিত্রদেরও মেলানো যায়। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল কী হবে এবং তার প্রভাব কী পড়বে, তা নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা আছে। এরপরও ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান—দুই দলেরই শক্ত সমর্থন থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যেও ইউক্রেনের প্রতি জোরালো সমর্থন থাকবে।

চীন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয় ইউরোপ। কিন্তু ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার প্রশ্নে ইউরোপের দেশগুলোর খুব সামান্যই সংশয় আছে।

চূড়ান্ত বিচারে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দুই পক্ষই নিজেদের সক্ষমতা যত বাড়াচ্ছে, ততই যুদ্ধের অচলাবস্থা বাড়বে। একটু একটু করে যতই তারা সামর্থ্য অর্জন করবে, ততই এই যুদ্ধে বিজয় অর্জন অসাধ্য হয়ে উঠবে। পেন্টাগনের ফাঁস হওয়া নথি এই ধারণাই তুলে ধরেছে। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় তুলে ধরেছে, ওয়াশিংটন ও কিয়েভ এই যুদ্ধে হারতে চায় না অথবা আলোচনার মাধ্যমে সমাধানও চায় না। সময়ই বলে দেবে, এটা কোনো টেকসই লক্ষ্য কি না।

  • স্টেফান ওলফ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ে অধ্যাপক