মতামত

আর্জেন্টিনার মায়েরা যখন ঢাকার রাস্তায়

সময়টা ১৯৭৬ সালের শেষভাগ। আজুসেনা ভিজাফ্লোর ও শ্রমিকনেতা পেড্রো ডি ভিনসেন্টির ছেলে নেস্টর হঠাৎ উধাও। কেন, কোথায়, কেউ জানে না। আজুসেনা আর্জেন্টিনার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ছুটলেন। সেখান থেকে সেনাশাসকের কাছে, যে যেখানে বলেছে সেখানে। যা দেখলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না আজুসেনা। আরও অনেক মা তাঁর মতো ছুটছেন। সবার আরজি একই। জলজ্যান্ত ছেলেরা হঠাৎ উধাও, তাদের খোঁজ চাই।

মাস ছয়েক পরও খোঁজ না পেয়ে আজুসেনা পথে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন আরও ১৩ জন মা। ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল মায়েরা বুয়েনস এইরেসের কেন্দ্র প্লাজা ডি মায়োয়, ঠিক প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে জড়ো হলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের সমাবেশ করার অনুমতি দিল না, তবে অনুমতি পাওয়া গেল বৃত্তাকারে দাঁড়ানোর। প্রথম কর্মসূচিটি পালিত হয়েছিল শনিবার, পরেরটি শুক্রবার। এর পর থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার মায়েরা ঠিক গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তেন বেলা সাড়ে তিনটায়। 

যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় আর্জেন্টিনায় সেনাশাসন চলছে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত একজনের পর একজন সেনাশাসক ক্ষমতায় বসছেন। একদিকে রুদ্ধশ্বাস সেনাশাসন, তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, অন্যদিকে ব্রিটেনের সঙ্গে ফকল্যান্ড দ্বীপ নিয়ে যুদ্ধ। এ পরিস্থিতিতে উত্থান বামপন্থী গেরিলা ও তাঁদের সমর্থকদের। তাঁদের থামাতেই এক অভিনব কৌশলের আশ্রয় নেন স্বৈরশাসকেরা। নির্বিচার গুম করতে শুরু করেন। এ নিয়ে প্রথমে চাপা অসন্তোষ ছিল। কিন্তু যখন সন্তানহারা মায়েরা রাস্তায় নামলেন, মাদারস অব দ্য প্লাজা ডি মায়ো নামে সংগঠন গড়ে তুললেন, তখন তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন অন্যরাও।

এ আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। ১৯৮৩ সালে জনরোষের মুখে পড়ে স্বৈরশাসক রেইনাল্ডো বেনিতো বাইনান নির্বাচন দিতে বাধ্য হলেন। আর নির্বাচিত হওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট রাউল আলফোনসো ‘ন্যাশনাল কমিশন অন দ্য ডিজঅ্যাপিয়ার্ড’ গঠন করেন। এই কমিশন গুম হয়ে যাওয়া ৮ হাজার ৯৬০ জনের ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করে।

আর্জেন্টিনার ওই সাত বছরের সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু বছরের মিলে যাওয়াটাকে কাকতাল বলে ধরে নিতে পারেন। মাদারস অব দ্য প্লাজা ডি মায়োর আজুসেনা, এস্থের বালাসত্রিনোর মতো ঢাকার রাস্তায় হাজেরা খাতুন, নিলুফা বেগম, আয়েশা আলী বা নাসিমা আক্তার মায়েদের দেখা যায় ৮ থেকে ৯ বছর ধরেই। তাঁরাও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, থানা-পুলিশ ও র‍্যাবের কাছে জবাব না পেয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়ান। কখনো তাঁদের কথায় ক্ষোভ ঝরে।

এই তো গত বছরের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় প্রেসক্লাবে এমন এক কর্মসূচিতে কথা বলেছিলেন কাঠ ব্যবসায়ী ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাসিমা আক্তার, ‘আমি থানায় গেছি, পুলিশ আমাকে থানা থেকে বের করে দিয়েছে। পুলিশের ডিসি আমার চিঠিটা একবার পড়ল না। বলে, র‍্যাবের বিরুদ্ধে অভিযোগ, আপনি র‍্যাবের কাছে যান। পুলিশ এখন তিন বছর পর এসে জিজ্ঞাসা করে আমার স্বামী আসলে গুম হয়েছে, নাকি কোথাও চলে গেছে।’

তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের কষ্ট লাগে, ঘেন্না আসে এখন। মন্ত্রীরা আরামে বসে থাকে, আমাদের বিরুদ্ধে যখন কথা বলে, হেলেদুলে বলে, “আরে না। বাংলাদেশে কখনো গুম হয় না। তারা ঋণের দায়ে চলে গেছে, বিয়ে করেছে।” এটা কতটা লজ্জার! আমার মনে হয় না সমাজে শ্বাস নিই। আমাদের এখন মেরে ফেলেন। তারা আমাদের চোখের পানি নিয়ে হোলি খেলে। উপহাস করে। আমার ঘরে কোনো উৎসব হয় না। আমার বাচ্চারা কখনো হাসে না।’

নারীদের কেউ কেউ অনুনয়-বিনয় করেন স্বজনের সন্ধান চেয়ে, কেউ শুধু কাঁদেন। আয়েশা আলীকে দেখা গেছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের নিয়ে গড়া সংগঠন মায়ের ডাকের প্রতিটি অনুষ্ঠানে তাঁর একমাত্র ছেলে আবদুল কাদের ভূঁইয়ার সন্ধান চেয়ে সরকারের কাছে অনুরোধ জানাতে। কিন্তু নিলুফা বেগম বলেন না কিছুই। দিগন্তবিস্তৃত সবুজ এক মাঠে ছেলে জাহিদুল করিমের হাসিমুখে তোলা ছবি সেঁটে ৯ বছর ধরে ঢাকার মানুষ তাঁকে শুধু কাঁদতে দেখেছেন।

আর এই মায়েদের যিনি একত্র করেছেন, সেই ৩৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা খাতুন বাড়ির সামনে কোনো ভবঘুরে, মানসিক রোগগ্রস্ত ব্যক্তিকে দেখলে খুঁটিয়ে দেখেন। ছেলেটি তাঁর কি না, তা নিশ্চিত হতে চান।

তাঁরা বিচার পাননি। স্বজন নিখোঁজ হওয়ার পর থানা-পুলিশ যেভাবে বলেছে, সেভাবে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। অপহরণের সব প্রমাণ হাতে থাকার পরও তাঁদের নিখোঁজ জানিয়ে জিডি করতে হয়েছিল। আদালতে রিট করেছিল কয়েকটি পরিবার। সেই রিট এগোয়নি।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বারবার ধরনা দেওয়ায় অন্তত একটা লাভ হয়েছে। সরকারের গুমসংক্রান্ত গল্প আর কেউ বিশ্বাস করছে না। এই মুহূর্তে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক কমিটির কাছে বাংলাদেশের ৮০টির কাছাকাছি গুমের তথ্য আছে। এর মধ্যে সরকার আটটি ঘটনার তথ্য সরবরাহ করেছে। জাতিসংঘ গুমের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বাংলাদেশ সরকারকে একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কোনো হেলদোল নেই।

তবে আশার কথা হলো, অপরাধ কখনো মুছে ফেলা যায় না। আর্জেন্টিনার গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম লেখাটা। শেষ করব সে দেশে কী ঘটেছিল, সে খবর দিয়েই।

কমিশন জানতে পেরেছিল, গুমের এই পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পেছনে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ভূমিকা ছিল। কিন্তু ডি ফ্যাক্টো প্রেসিডেন্ট জেনারেল রেইনাল্ডো গুমের ঘটনায় কোনোভাবেই যেন তাঁর সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা না যায়, সে উদ্দেশ্যে সব নথি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন, দায়মুক্তির আইনগত সুযোগ দেন অন্যদের। ভেবেছিলেন, তিনি ও তাঁর সঙ্গীসাথিরা পার পেয়ে যাবেন। 

তবে পরে ওই আইন রদ হয়। আবিষ্কৃত হয় অসংখ্য গণকবর। গুমের অভিযোগে ৭০০ জনের বিচার হয়। সন্তানের সন্ধান চেয়ে যে মায়েরা প্রতি শুক্রবার জড়ো হতেন, তাঁদের অনেকে জানতে পারেন সন্তানদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল। বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্তানেরা প্রায়ই অনুরোধ করেন বাবার কবরটা চিনিয়ে দিতে। সরকারকে বলব, কমিশন গঠন না করুন, অন্তত কবরটা তো চিনিয়ে দিন।

শেখ সাবিহা আলম প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক