৩ নভেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খানের হত্যাচেষ্টার ঘটনা পাকিস্তানকে আরেকটি রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিল। দেশটিতে আগামী দিনগুলোয় রাজনৈতিক সহিংসতা নিশ্চিতভাবে আরও বাড়বে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ খান ও পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ে কর্মরত মেজর জেনারেল ফয়সাল নাসিরকে এই হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসাবে দায়ী করেছেন ইমরান খান। অতি সত্বর তাঁদের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছেন ইমরান।
গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ইমরান খানের বার্তা পাকিস্তানের জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন পিটিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সদস্য আসাদ উমর। ইমরানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবরে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং ‘যা ভাবা হয়েছিল ঘটনাপ্রবাহ আর সেখানে স্থির নেই’।
আসাদ উমর বলেন, দুই দিন আগে ইমরান খানকে তাঁর নিরাপত্তা হুমকির ব্যাপারে তিনি সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু ইমরান খান তাঁকে বলেন, ‘আমরা এখন একটা জিহাদের মধ্যে আছি। এ পর্যায়ে আল্লাহর ওপর আমাদের বিশ্বাস রাখা প্রয়োজন।’ কথিত লংমার্চের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিকে ‘জিহাদের’ সঙ্গে তুলনা দিয়ে গতকাল শুক্রবার জুমার নামাজের পর বিক্ষোভের ডাক দেয় পিটিআই।
এ জনক্ষোভ ও প্রকাশ্যে সামরিক নেতৃত্বের বিরোধিতার এই ঘটনা থেকে যে ইঙ্গিত মিলছে, তা হলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবার রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না–ও করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে একটা সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় গভর্নরের শাসন জারি করা। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ ইমরানের সমর্থকদের ক্ষোভ উসকে দেবে।
পাকিস্তান সরকার ইমরানের হত্যাচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে পিটিআইয়ের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘এটা প্রকৃতির নিয়ম, যারা আগুন জ্বালায়, তারাও তাতে পুড়ে মরে।’ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার এ হামলার ঘটনা তদন্তের জন্য পাঞ্জাব সরকারের প্রতি যৌথ তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বানও জানিয়েছে।
অন্যরা আবার পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাঞ্জাব সরকারের দিকেই আঙুল তুলেছেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশটির সরকারের অন্যতম শরিক ইমরানের দল পিটিআই।
এ হামলাকে কেন্দ্র করে ষড়যন্ত্রতত্ত্বও ছড়িয়ে পড়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকে দাবি করেছেন, পিটিআইয়ের লোকজন নিজেরাই এ হামলা চালিয়েছেন, যাতে ইমরানের পক্ষে সমর্থন বাড়ে। ক্রিকেটার থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে যাওয়া ইমরান খান কয়েক দিন আগে দেশব্যাপী হাকিকি আজাদি বা প্রকৃত মুক্তি নামে লংমার্চ শুরু করেন। পাঁচ মাসের মধ্যে এটা তাঁর দ্বিতীয় লংমার্চ।
আবার কেউ কেউ ইমরান হত্যাচেষ্টার পেছনে বিদেশি শক্তির হাত রয়েছে বলে অভিযোগ করছেন। কেননা, প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের চীন সফরের প্রাক্কালে এ হামলা হয়েছে। বেইজিং সফরে শাহবাজ চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছেন এবং চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) নতুন করে পুনর্জীবিত করেছেন।
অভিযুক্ত হামলাকারী সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে যে প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত। তাঁর দাবি, ইমরানের লংমার্চে নামাজের সময়ও গানবাজনা বন্ধ হয়নি। পাঞ্জাবের সাবেক গভর্নর সালমান তাসির হত্যার ঘটনা মনে পড়ছে। সেই হত্যায় জড়িত ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা মুমতাজ কাদরি। অসংগতি থাকার পরও ওই হত্যাকাণ্ডের যে বয়ান পাওয়া যায়, তাতে সেটি রাজনৈতিক হিসাব–নিকাশের বাইরের ঘটনা।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে খুব দ্রুত প্রতিক্রিয়া জন্ম হয়েছে। পাকিস্তানের সব কটি প্রদেশে জনতা রাস্তায় নেমে এসে বিক্ষোভ করেছেন। তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, এই হামলার মধ্য দিয়ে সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে এবং তারা ইমরানের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। ইমরানের প্রতি বিশাল এই সমর্থন ও সরকারের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ পাকিস্তানকে ধারাবাহিক অস্থিতিশীলতা মধ্যে ফেলে দিল। এখন পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অনেক বেশি অনিশ্চিত হয়ে গেল।
১৯৪৭ সালে জন্মের পর পাকিস্তানের যে ৭৫ বছরের ইতিহাস, তাতে দেশটি যখনই এ ধরনের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে পড়েছে, তখনই সামরিক বাহিনী সরাসরি কিংবা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর এ ধরনের হস্তক্ষেপ খুব স্বাভাবিক। এমনকি কখনো যদি সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ অনুমোদিত না–ও হয়, তারপরও রাজনৈতিক নেতা ও সমাজ সাধারণত তাদের প্রতি প্রসন্ন থাকে। সামরিক নেতৃত্বের তৈরি করা রূপরেখার মধ্যে কাজ করতে তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
কিন্তু সমকালীন পাকিস্তানে রাজনৈতিক ও সামাজিক মেরুকরণ তীব্র আকার ধারণ করেছে। ইতিহাসে এতটা মেরুকরণ কখনোই দেখা যায়নি। এ বাস্তবতায় পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাদের ঐতিহ্যগত ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হচ্ছে না। পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়া এরই মধ্যে বলেছেন, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখবে।
পাকিস্তানে যদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকে আর সেনাবাহিনী যদি হস্তক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে একটা বিষয় নিশ্চিত যে পূর্বতন সেনা হস্তক্ষেপের সময় জনগণ যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তার তুলনায় ইমরানের সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া হবে ভিন্ন। ইমরান খানের হত্যাচেষ্টার পর জনগণ নিজেদের ওপর আরোপ করা সেন্সরশিপের দেয়াল নিজেরাই ভেঙে দিয়েছে।
লাহোরের পেশোয়ারে আঞ্চলিক সেনা সদর দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ হয়েছে। বিক্ষোভকারীরা আওয়াজ তুলেছেন, ইউনিফর্মের আড়ালে সন্ত্রাস ও গুন্ডামি কেন? অতীতে প্রকাশ্যে এ ধরনের প্রশ্ন শুধু পশতুন তাহহাফুজ মুভমেন্ট বা পশতুন সুরক্ষা আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু দেখা গেছে।
সম্প্রতি কেনিয়ায় খুনের শিকার হয়েছেন পাকিস্তানি সাংবাদিক আশরাফ শরিফ। পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ ছিলেন তিনি। তাঁর হত্যাকাণ্ডের পরও সেনাবাহিনীকে নিয়ে অনেকে একই ধরনের প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে দাবি করেছেন, এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সরাসরি সেনাবাহিনী জড়িত। পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই অবশ্য এ দাবি অস্বীকার করেছে।
এ জনক্ষোভ ও প্রকাশ্যে সামরিক নেতৃত্বের বিরোধিতার এই ঘটনা থেকে যে ইঙ্গিত মিলছে, তা হলো পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবার রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ না–ও করতে পারে। এ পরিস্থিতিতে একটা সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ায় গভর্নরের শাসন জারি করা। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপ ইমরানের সমর্থকদের ক্ষোভ উসকে দেবে।
ইমরান হত্যাচেষ্টার পর পাকিস্তান খুব দ্রুত একটি রাজনৈতিক অগ্নিকুণ্ডের দিকে যাত্রা শুরু করল।
সামিনা ইয়াসমিন ডিরেক্টর অব সেন্টার ফর মুসলিম স্টেটস অ্যান্ড সোসাইটিস, ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে