‘মাকাল ফল’ হতে চাইলে আপনাকে পস্তাতেই হবে

যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম (১৯১৩-২১) প্রেসিডেন্ট ছিলেন থমাস উড্রো উইলসন। রাজনীতিকের পাশাপাশি একাডেমিশিয়ান হিসেবেও পরিচিত ছিলেন তিনি। তাঁর বিখ্যাত কিছু উক্তি রয়েছে। এসব উক্তির মধ্যে অন্যতম হলো চরিত্র গঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করে করা একটি উক্তি। তিনি বলেছেন, ‘যদি তুমি তোমার সম্পদ হারাও, (মনে রেখো) তুমি কিছুই হারাওনি; যদি তোমার স্বাস্থ্য হারায়, (যেনে রেখো) তুমি অল্প কিছু হারিয়েছ; কিন্তু যদি তুমি তোমার চরিত্র হারাও, (তবে মনে রেখো) তুমি তোমার সব হারিয়েছ।’

স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তাহলে শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩) তাঁর স্বভাবকবিতায় চরিত্রের স্বরূপ বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘গোলাপ কুঁড়ি পাপড়ি খুলি/ ছতরে দেখায় রূপরাশি/ উদার হিয়ায় সুবাস বিলায়/ সবায় সমান সম্ভাষি। মাকাল ফলটা হিঙুল বরন/ দেখতে বড়ই চমৎকার/ অন্তরে তার পুরীষ পোরা/ বদবু সহে সাধ্য কার। সরল সুজন জীবন যাঁদের/ করেন সবার হিতসাধি/ দুর্মতিজন স্বার্থ খুঁজে/ ন্যায় কাজে হন ঘোরবাদি।’

কবি এখানে গোলাপের সঙ্গে হিতকামী তথা ভালো মানুষের তুলনা করেছেন। গোলাপ যেমন জাত-পাতনির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে তার সুগন্ধ বিলিয়ে বেড়ায়, তেমনি ভালো মানুষেরা সবার কল্যাণ করেন। অন্যদিকে মাকাল ফল দেখতে লাল টকটকে (হিঙুলবরন) হলেও এর ভেতরটা দুর্গন্ধময়। মাকালের মতো অন্তর পোড়া মানে হলো চোখ দর্শনধারী খারাপ মানুষেরা। এঁদের প্রথম দেখায় ভালো মনে হলেও এঁরা নিজেদের স্বার্থের জন্য ভালো কাজেরও ঘোর বিরোধিতা করে থাকেন।

আমাদের সমাজে এখন মাকালমার্কা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। মাঠে-ঘাটে, হাটে-পাঠে, অন্দরে-বন্দরে, পাড়াগাঁ-মসনদ, সরকারি-বেসরকারি, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, রোগী-চিকিৎসক, বাদী-বিবাদী, শিশু-বয়োজ্যেষ্ঠ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ছাত্র-শিক্ষক, কমজান্তা-সবজান্তা—সর্বত্রই এ ধারা বিরাজমান। বিশ্বায়নের এ ধারা দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমানভাবে বিরাজমান।

নৈতিকতা হলো একজন মানুষের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তি যদি ঠিক না থাকে তাহলে বহুতল ভবনের মতো একদিন তা মুখ থুবড়ে পড়বেই। নিজ নিজ খাতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে তাঁদের আত্মীয়-পরিজন গর্ব করে থাকেন। তাঁদের পরিচয়ে তাঁরা বুক ফুলিয়ে চলে থাকেন। কিন্তু এই এ মানুষগুলোর পরিচয় যখন অমানুষ হিসেবে সামনে চলে আসে, তখন এই নিকটজনেরা তাঁদের পরিচয়ে আর পরিচিত হতে চান না। তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেন তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বজনের সম্পর্ক অস্বীকার করতে বা লুকিয়ে রাখতে।

পত্রিকার পাতা ওলটালে ও টিভি খুললে হালকা বিরতিতে সামনে আসছে নয়া নয়া মহারথীর নাম। যাঁরা খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে ধপাস করে তলানিতে পৌঁছে গেছেন শুধু চারিত্রিক ত্রুটির কারণে। উদাহরণ হিসেবে আমরা, শাহেদ-সেব্রিনা, ওসি প্রদীপ-ডিআইজি মিজান, পদচ্যুত সংসদ সদস্য শহীদ, কারাগারে যাওয়া সংসদ সদস্য হাজি সেলিম, ক্যাসিনো–কাণ্ডের সম্রাট গংদের কথা বলতে পারি। আরও বড় বড় নাম বলা যাবে। তবে সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণে এখন তা বলা যাচ্ছে না। ডেসটিনি, হলমার্কসহ কয়েকটি ব্যাংক ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান কেলেঙ্কারিও এই কাতারে রয়েছে। দেশ ছাপিয়ে প্রতিবেশী দেশের পশ্চিমবঙ্গের মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথাও এ উদাহরণ থেকে বাইরে রাখা যাবে না।

শুধু নৈতিক স্খলনের জন্য এই মানুষগুলো এখন পস্তাচ্ছেন। আমাদের জন্য এখান থেকে ঢের শিক্ষা নেওয়ার আছে। কারণ, নৈতিকতা হলো একজন মানুষের মূল ভিত্তি। এই ভিত্তি যদি ঠিক না থাকে তাহলে বহুতল ভবনের মতো একদিন তা মুখ থুবড়ে পড়বেই। নিজ নিজ খাতে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের নিয়ে তাঁদের আত্মীয়-পরিজন গর্ব করে থাকেন। তাঁদের পরিচয়ে তাঁরা বুক ফুলিয়ে চলে থাকেন। কিন্তু এই এ মানুষগুলোর পরিচয় যখন অমানুষ হিসেবে সামনে চলে আসে, তখন এই নিকটজনেরা তাঁদের পরিচয়ে আর পরিচিত হতে চান না। তাঁরা যথাসম্ভব চেষ্টা করেন তাঁদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট স্বজনের সম্পর্ক অস্বীকার করতে বা লুকিয়ে রাখতে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, পরিমল-সানিদের মতো যৌন নিপীড়ক শিক্ষকদের কথা। আচ্ছা, পরিবারের সদস্যরা কি উঁচু গলায় তাঁদের পরিচয় আর সামনে আনবে? সন্তানের পরিচয় কি সমাজে উঁচু করে বলবেন বুয়েটের আবরার ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়ের হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের মা-বাবারা? খুব বাধ্য না হলে সন্তানের পরিচয় কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে দেবেন বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের অভিভাবকেরা? কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন হালের হেলমেটবাহিনীর সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা, যাঁরা নিউমার্কটে সংঘর্ষে নাহিদের মতো খেটে খাওয়া তরুণের প্রাণ নিয়েছেন? নিশ্চয় সন্তানদের পরিচয় নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছেন সিলেটের এমসি কলেজে তরুণীকে ধর্ষণকারীদের মা–বাবারা।

পরিশ্রম করলে মানুষ একদিন না একদিন একটা জায়গায় পৌঁছায়ই। কিন্তু সেই পরিশ্রমের সঙ্গে যদি নৈতিকতা না থাকে তাহলে দিন শেষে তা ব্যর্থ বলেই গণ্য হবে। কারণ, আমার উপার্জিত সম্পদ যদি আমি নিজে বা সমাজ ভোগ না করতে পারে তাহলে লাভ কী? লাভ নেই। মৃত্যুর পরও মানুষ আমাকে ঘৃণাভরেই দেখবে। আমার পরিচয় নিয়ে মুখ লুকাবেন স্বজনেরা। তাই আসুন, আমরা আমাদের মূল ভিত্তি নৈতিকতা শক্ত করি, চরিত্র গঠন করি। না হলে একদিন না একদিন পস্তাতেই হবে।

  • মো. ছানাউল্লাহ প্রথম আলোর সহসম্পাদক