অনেক আলোচনা, সমালোচনা, বিতর্ক এবং অনেকের মতে, নাটকীয়তার পর নির্বাচন কমিশন অর্থাভাবের কারণে আগামী নির্বাচনে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ব্যবহার বাদ দিয়ে প্রচলিত প্রথা কাগজের ব্যালটে ভোটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে বৃহৎ বিরোধী দলসহ বহু দলের একটি দাবির সমাপ্তি হয়েছে। প্রথম থেকেই বেশ কিছু দল, যার মধ্যে বিএনপিই প্রধান, ইভিএম ব্যবহারে কারিগরি ভোট চুরির আশঙ্কা ব্যক্ত করে ইভিএমের জন্মলগ্ন থেকেই বিরোধিতা করে এসেছে। এবারও কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। নির্বাচন কমিশন যখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করে তখন বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আলোচনায় অংশগ্রহণ না করলেও, ইভিএমের বিরোধিতা করেছে।
তবে এসব দলের ইভিএম বাতিলই দাবি ছিল না। তাদের প্রধান দাবির কোনো সুরাহার পথ এখনো দৃশ্যমান নয়। কাজেই ইভিএম বাদ বলেই এরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে, সে নিশ্চয়তা এখনো দেখা যাচ্ছে না। এদের দাবি নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা। এ দাবির মোদ্দাকথা হলো, ‘নির্বাচনকালীন সরকার দলীয় হতে পারবে না। সরকারের চরিত্র হতে হবে নিরপেক্ষ, যা বর্তমানের সংবিধান ও দলীয় সরকারের কাছ থেকে বিরোধীরা আশা করে না।’ বস্তুত এখন পর্যন্ত সরকার নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে পারেনি, যেমন পারেনি ২০১৪ ও ২০১৮-এর নির্বাচনে।
ওই দুটি নির্বাচন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। যা হয়েছে, তা এখন ইতিহাস এবং প্রাসঙ্গিক (রেফারেন্স) হয়ে আছে। যদিও ওই দুই নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের আলোকেই ক্ষমতাসীন সরকারের তত্ত্বাবধানেই হয়েছিল। তথাপি নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার, তেমনটা দৃশ্যমান হয়নি। এমনকি গুরুতর অভিযোগগুলোও তারা আমলে নেয়নি। যে কারণে এ দুই নির্বাচনের অনিয়মের বোঝা ঘাড়ে নিয়ে দুই কমিশনকে বিদায় নিতে হয়েছে। তলানিতে নেমেছে নির্বাচন কমিশনের ওপর মানুষের আস্থা। শুধু এটাই নয়, এই পরিস্থিতিই এখন বর্তমান কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। আলোচিত এই প্রধান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে নির্বাচন কমিশনকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভবিষ্যতে নির্বাচনী ইতিহাসে তারা কীভাবে চিহ্নিত হবে!
ডা. জাফরুল্লাহর অন্যতম ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখা এবং ভবিষ্যতে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার। কিন্তু তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। যথেষ্ট সংগ্রাম করেছেন জনমানুষের ন্যূনতম স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অবদান আর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। তিনি যে ওষুধনীতি প্রণয়ন করেছেন, সেটার জন্য সাধারণ মানুষ কৃতজ্ঞ থাকবে। কৃতজ্ঞ থাকবে জাতি তাঁর বহুমুখী অবদানের জন্য।
ব্যালট পেপারে নির্বাচন একদিকে যেমন প্রচলিত, তেমনি যদি কোনো কারণে তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে তাহলেও আইনের সঠিক প্রয়োগ এবং নির্বাচন কমিশনের সঠিক তৎপরতার মাধ্যমে তাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এ কথা অনস্বীকার্য যে নির্বাচন কমিশন যেমন একা করাতে পারে না, তেমনি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের নিশ্চয়তাও দিতে পারে না। যদি মাঠপর্যায়ের নিয়োজিত কর্মকর্তা, কর্মচারী তাঁদের দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন না করেন তা হলে তা সম্ভব নয়। অতীতের দুই নির্বাচনে তা দেখা যায়নি।
ভেবেছিলাম, আমার এ লেখা আগামী নির্বাচন এবং এর চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েই শেষ করব। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে না। কারণ, অকস্মাৎ না হলেও আমরা এমন একজনকে গত ১১ এপ্রিল ২০২৩-এর দিবাগত রাতে হারালাম, যিনি একটি সুষ্ঠু নির্বাচন এবং উদার গণতন্ত্রের সংগ্রামের সৈনিক ছিলেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষের ডাক্তার, কণ্ঠস্বর এবং গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ব্যাপক এবং এক ব্যতিক্রমী অবদান, পরবর্তী সময়ে গণমানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ অত্যন্ত সাহসী ও স্পষ্টবাদী আমার অগ্রজতুল্য জাফরুল্লাহ নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে যে সাহসের সঙ্গে জীবনযুদ্ধ করেছেন, তা এক বিরল দৃষ্টান্ত। তিনি দেশের বাইরে চিকিৎসা নেওয়ার কথা একবারও ভাবেননি। এমনকি কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি বিদেশে যেতে রাজি হননি। অথচ আমাদের দেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য বিষয়ে বিদেশে চিকিৎসা নেওয়ার হিড়িক তো লেগেই আছে।
আমার সৌভাগ্য যে এমন মানুষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পেরেছিলাম। তাঁর মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে গিয়েছিলাম তাঁরই প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে দোয়া মাহফিলে। সেটাই শান্তি।
ডা. জাফরুল্লাহর সঙ্গে আমার সামাজিক পরিচয় প্রায় ২৫ বছরের। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, সেমিনারে, টেলিভিশন টক শোতে অংশ নিয়েছি। আমার সঙ্গে অনেকটা ঘনিষ্ঠ হন যখন নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ পেয়েছিলাম, তখন থেকে। তিনি সময়-সময় সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠা ও বজায় রাখতে বহু মূল্যবান সুপারিশ রেখেছিলেন। তাঁর এই ধারা তিনি অব্যাহত রেখেছিলেন।
তাঁর সঙ্গে পরবর্তী সময়ে আরও ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁরই প্রতিষ্ঠানে কয়েকটি অনুষ্ঠান ও আলাপচারিতার মাধ্যমে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের আগেও তিনি নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ নিয়ে সোচ্চার ছিলেন। বর্তমান সিইসির নামসহ অনেক নাম তিনি প্রস্তাব করেছিলেন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। আলাপচারিতায় বলেছিলেন যে আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়। সে জন্য নির্বাচন কমিশন নিয়ে বেশ সরব ছিলেন।
আমার সঙ্গে তাঁর প্রতিষ্ঠানে বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আগামী নির্বাচন নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। তিনি জানতে চাইতেন, কীভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে। তিনি চাইতেন যে বাংলাদেশ যেন একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়ায়। জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবনের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন। দারুণ শারীরিক সমস্যা নিয়েও হুইলচেয়ারে বসে জনগণের কাতারে দাঁড়াতেন। এমন আত্মবিশ্বাস ও জীবনী শক্তিসম্পন্ন মানুষ কমই দেখা যায়।
ডা. জাফরুল্লাহ মানুষের কল্যাণে কতখানি নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন, তা তাঁর প্রতিষ্ঠানগুলো না দেখলে বোঝা যায় না। সাধারণ মানুষকে সস্তা স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে গেলেই দেখা যায়। বিশেষ করে যাঁরা জটিল কিডনি রোগে ভুগছেন, তাঁদের জন্য সস্তায় ডায়ালাইসিসের ব্যবস্থা, সাভারে গণস্বাস্থ্য সমাজ ভিত্তিক মেডিকেল কলেজ, গণফার্মেসি এবং গণ বিশ্ববিদ্যালয়-এসবই অতি সাধারণ ও দরিদ্র মানুষের জন্য করেছেন। যে কারণে ডা. জাফরুল্লাহ একজন জনগণের ডাক্তার হিসেবে উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো থাকবেন।
একাধিক দেশ ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত এই কর্মবীর শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও তাঁর গণমুখী কর্মকাণ্ডের জন্য স্বীকৃত ছিলেন। ম্যাগসাইসাই, স্বাধীনতা ও অন্যান্য পুরস্কারপ্রাপ্ত আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই নমস্য ব্যক্তিত্ব দেশে অনেক নিগৃহীত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ আর অভিযোগও উত্থাপিত হয়েছিল। যদিও তিনি এগুলো নিয়ে চিন্তিত ছিলেন না। তবে অবশ্যই দুঃখ পেয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, আমরা সম্মানিত ব্যক্তিদের সম্মান জানাতে কুণ্ঠা বোধ করি। অথচ গুণী ব্যক্তিদের তাঁর প্রাপ্য সম্মান জানালে কেউ ছোট হয় না; বরং জাতি হিসেবে গর্বিত হয়। এসব দুঃখের কথা তিনি মাঝেমধ্যে একান্তে প্রকাশ করতেন।
ডা. জাফরুল্লাহর অন্যতম ইচ্ছা ছিল, বাংলাদেশকে একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দেখা এবং ভবিষ্যতে একটি গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন দেখার। কিন্তু তা তিনি দেখে যেতে পারেননি। যথেষ্ট সংগ্রাম করেছেন জনমানুষের ন্যূনতম স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অবদান আর গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার। তিনি যে ওষুধনীতি প্রণয়ন করেছেন, সেটার জন্য সাধারণ মানুষ কৃতজ্ঞ থাকবে। কৃতজ্ঞ থাকবে জাতি তাঁর বহুমুখী অবদানের জন্য।
ডা. জাফরুল্লাহ পরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু এ দেশের তাঁর আরও প্রয়োজন ছিল। এমন সৎ, নিঃস্বার্থ ব্যক্তিত্ব এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর সমৃদ্ধ ব্যক্তিকে হারালাম এমন সময়, যখন তাঁর প্রতিবাদী জনমুখী কণ্ঠস্বরের প্রয়োজন ছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে একজন সুহৃদ হারালাম, জাতি একজন বলিষ্ঠ বিবেকবান মানুষ হারাল। প্রশ্ন হচ্ছে যে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে তিনি সোচ্চার ছিলেন, যা তিনি দেখে যেতে পারেননি, তা তাঁর বিদেহী আত্মা দেখতে পারবে কি না? আমি এমন একজন সুহৃদ ও অগ্রজকে হারালাম। জাতি হারাল একজন বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর আত্মার মাগফিরাত ও শান্তি কামনা করি।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com