মতামত

পাকিস্তানে সামরিক শাসনের অজুহাত খুঁজছে কি সেনাবাহিনী

ইমরান খানের গ্রেপ্তারের পর পাকিস্তানে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ
ছবি: এএফপি

জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তান জেনারেলদের হাতের পুতুল হয়ে আছে। আমাদের বুঝতে হবে রাষ্ট্রটির ভিত্তি যিনি স্থাপন করেছিলেন, তিনি আদতে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নন, তিনি মেজর জেনারেল ইসকান্দর মির্জা।

জিন্নাহ নামেই পাকিস্তানের স্থপতি; কারণ দেশটি জন্মের এক বছরের মধ্যেই জিন্নাহর মৃত্যু হয় এবং ইসকান্দর মির্জাই পাকিস্তানের প্রকৃত স্থপতি। কারণ, তিনি বাস্তবিক অর্থে পাকিস্তানকে শুধু শাসনই করেননি বরং জেনারেলদের হাতে সীমাহীন ক্ষমতা দিয়ে গেছেন। এই জেনারেলরা চার দশকের বেশি সময় ধরে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানকে শাসন করেছেন এবং এই সময়ের মধ্যে কথিত গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত বেসামরিক সরকারের কেউই নিজেদের মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি।

ইমরান খানের গ্রেপ্তার ও তাঁর সমর্থকদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে যা হচ্ছে তার কোনোটাই হতবাক করে দেওয়ার মতো কিছু নয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সম্পূর্ণ ঘটনা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাজানো এবং পূর্বপরিকল্পনামতোই একটার পর একটা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে।

এটি যে কারও পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন যে পাকিস্তানের মতো দেশে সেনাবাহিনীর সদর দপ্তরে উত্তেজিত জনতা ঢুকে পড়তে পারে, একজন অন্যতম কোর কমান্ডারের বাড়িতে তারা আগুন ধরিয়ে দিতে পারে এবং কোনো রকম বাধা ছাড়াই একটি সামরিক বিমান ঘাঁটিতে ঢুকে তোলপাড় করতে পারে। এটিও বিশ্বাস করা শক্ত, পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী লোকগুলো যে ভবনের বাসিন্দা, সেখানে বিক্ষোভকারীদের প্রায় বিনা বাধায় ঢুকতে দেওয়া হয়েছে।

এটি সন্দেহাতীত যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজেই পরিকল্পিতভাবে এসব বিক্ষোভ ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটিয়েছে, যাতে দেশে সামরিক আইন জারির একটা মোক্ষম অজুহাত দাঁড় করানো যায়। বলা হয়ে থাকে, ‘পৃথিবীর সব দেশের নিজ নিজ সেনাবাহিনী আছে আর পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে সেনাবাহিনীর একটি দেশ আছে।’ এখানে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকা ব্যক্তি থেকে শুরু করে নির্বিচার যেকোনো লোককে সেনাবাহিনী শাসন করে থাকে। পাকিস্তানই একমাত্র দেশ, যেখানে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তা সেনাবাহিনী ঠিক করে থাকে এবং নির্বাচন সেখানে সব সময়ই লোকদেখানো হয়ে থাকে।

ইমরান খান যখন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন, তখন ব্যাপকভাবে বলাবলি হচ্ছিল, সেনাবাহিনী ভোট কারচুপি করে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছে। আর যখন তাঁকে উৎখাত করা হলো, তখনো সেই সেনাবাহিনীর হাত থাকার বিষয়টি সবার কাছে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার ছিল। এমনকি, গত মঙ্গলবার ইসলামাবাদ হাইকোর্ট চত্বর থেকে যখন ইমরানকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার জের ধরে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকে, তখনো মনে হচ্ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অঙ্গুলি হেলন ছাড়া এসবের কিছুই ঘটা সম্ভব ছিল না।

তেহরিক-ই–তালেবান, বালুচ বিদ্রোহী ও অন্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনও এখন পাকিস্তানে সক্রিয়। এসব গোষ্ঠী দেশটির অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানে এখন যে ঘটনাপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে, তাতে সামনে আরও ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

ইমরান খানের গ্রেপ্তার পুরো দেশের দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। তাঁর সমর্থকেরা যে মুহূর্তে সরকারের বিরুদ্ধে কথিত জিহাদ ঘোষণা করে রাজপথে লড়াইয়ের জন্য নেমে এসেছেন, তখন সেনাবাহিনী সারা দেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে, দেশের গণমাধ্যমকে নজরদারির আওতায় রাখতে প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের অফিসে সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোক বসিয়েছে এবং রাজপথে বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাচ্ছে।

অনেক বিশ্লেষকের বিশ্বাস, পাকিস্তানি এস্টাবলিশমেন্ট (পাকিস্তানের সেনাবাহিনী এবং আমলাতন্ত্র, রাজনীতি, বিচার বিভাগ ও শিল্প খাতে থাকা সেনা সমর্থক গোষ্ঠীর শাসক চক্রকে বোঝাতে এই শব্দবন্ধ ব্যবহার করা হয়) এবং ইমরান খানের সমর্থকদের মধ্যে একটি গৃহযুদ্ধের দিকে দেশ যাচ্ছে এবং তাঁরা এটিও জানেন, সেই গৃহযুদ্ধে অনতিবিলম্বেই সেনাবাহিনী সব ধরনের আন্দোলন–বিক্ষোভ দমন করে ফেলতে সক্ষম হবে। তবে পরিস্থিতি এখন খারাপ এবং এই পরিস্থিতি পাকিস্তানের একাধিক খাতকে প্রভাবিত করতে চলেছে। ইতিমধ্যে তার ক্ষণগণনাও শুরু হয়ে গেছে।

ঘটনাগুলো দ্রুত মোড় নেওয়ার সঙ্গে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ অধিকতর খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশটি এখন এমন এক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যে তার বিদেশি ঋণ জিডিপিকে ছাড়িয়ে গেছে এবং দেশটির যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে, তার পাঁচ গুণ অর্থ বিদেশি ঋণের কিস্তি হিসেবে তাকে শোধ করতে হবে।

তেহরিক-ই–তালেবান, বালুচ বিদ্রোহী ও অন্য সশস্ত্র সংগঠনগুলোর পাশাপাশি অনেক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনও এখন পাকিস্তানে সক্রিয়। এসব গোষ্ঠী দেশটির অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানে এখন যে ঘটনাপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে, তাতে সামনে আরও ধ্বংসাত্মক কিছু ঘটতে পারে বলে মনে হচ্ছে।

টাইমস নাউ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • অমিত বানসাল ভারতের সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর এবং ভূকৌশল ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদির বিশ্লেষক