এখানে সব উল্টোমুখী। এখানে অস্বাভাবিকতাই নিয়ম। এখানে সাধারণের জীবন প্রতিনিয়ত বাধাগ্রস্ত হবে, এটাই নিয়তি। যাদের সেবা করার কথা, তারা এখানে নির্যাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যারা পাহারা দেবে, তারা চুরি করে। যারা আশ্রয় দেবে, তারা উৎখাত করে। যাদের ওপর শান্তি রক্ষার দায়িত্ব, তারাই অশান্তির কারণ হয়। যাঁর সত্য বলার কথা, তিনিই সবচেয়ে বেশি সত্য গোপন করেন। কোনো কিছুই যেন ঠিক নেই বাংলাদেশের। ফলে সাধারণ মানুষেরও কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই আর। যার যা করার কথা, সে তার উল্টোটা করবে—এটাই এখন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, কিন্তু পুলিশই আইন ভাঙছে।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ পুলিশের সহজে দ্বারস্থ হতে চান না। কেননা পুলিশ সম্পর্কে মানুষের ভীতি আছে, সেই ভীতি তৈরি করায় পুলিশেরই দায় বেশি। ছোটখাটো চুরি, ছিনতাই, সহিংসতা, নির্যাতন ইত্যাদির অভিযোগ মানুষ বলতে গেলে করেনই না, কেননা মানুষের বিশ্বাস হলো ফল তো পাওয়া যায়ই না; বরং কিছু আক্কেলসেলামি যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সেবা পাওয়া সহজ নয় এখানে। সেবার জন্য ‘খরচ’ করাই দস্তুর। ‘উপরি পাওনা’ হিসেবে হয়রানিও জোটে।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রিজার্ভ ও কল্যাণ ফোর্সে কনস্টেবল হিসেবে কর্মরত তিন পুলিশ সদস্য সম্প্রতি চাঁদা আদায় করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাসায় ঢুকে গৃহকর্তাকে মাদকসেবী বলে এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করতে গেলে মুগদা থানা-পুলিশের একটা দল তাঁদের গ্রেপ্তার করে। (প্রথম আলো অনলাইন, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২)
চাঁদাবাজির শিকার হতে যাওয়া পরিবারটি সচেতন বলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ কল করেছিল। পরিবারটি হয়তো এত টাকা দেওয়ার মতো অবস্থায় ছিলও না, হয়তো দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া তারা অভিযোগ করতে বাধ্য হয়েছিল। যদি সেটা না হতো, তাহলে হয়তো এ খবর আমরা জানতেও পারতাম না এবং পরিবারটি রক্ত–ঘামের উপার্জিত টাকা দিতে বাধ্য হতো। এমন আরও অনেক ঘটনা আমাদের জানার বাইরে রয়ে যায়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে সংঘাতের সাহস সবার হয় না। এ সুযোগে দেখা মেলে ভুয়া পুলিশেরও। পুলিশ পরিচয় পাওয়ার পর মানুষ অন্যায়ের শিকার হলেও উচ্চবাচ্য করতে চান না। কেননা পুলিশের অভিযোগ জানাতে যেতে হয় সেই পুলিশেরই কাছে। এমনিতেই যাঁরা থানায় যেতে চান না, তাঁরা পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে সেখানে যাবেন কোন ভরসায়!
পুলিশ বাহিনীর এই তিন সদস্য এর আগে সাধারণ মানুষকে গাড়িতে তুলে অর্থ আদায় ও ডাকাতি করার অভিযোগে বরখাস্ত হন। তাঁদের বিরুদ্ধে একাধিক থানায় এ–সংক্রান্ত মামলাও রয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আগে থেকেই ছিল, তাঁরা যে আবারও এমন ঘটনা ঘটানোর সাহস পান, তার কারণ হলো সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তাঁরা এমন প্রতিরোধ আশা করেননি। তাঁরা জানেন, সাধারণের সঙ্গে যা খুশি করা যায়। ক্ষমতাবান ও বিত্তশালীরা হলেন অসাধারণ। তাঁদের কাছে যাওয়ার সাহস তাদের হয় না।
সিলেটের বন্দরবাজার ফাঁড়িতে পুলিশের হেফাজতে মৃত্যু হওয়া ৩৪ বছরের যুবক রায়হানও অসাধারণ কেউ ছিলেন না, অসাধারণ হলে ফাঁড়িতে ধরে এনে যাচ্ছেতাইভাবে নির্যাতন করে মেরে ফেলা যেত না। সাধারণ মানুষ নির্যাতিত হবেন, ভুগবেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলে মার খাবেন, অন্যায় না করলেও মার খাবেন, কারণে–অকারণে মার খাবেন, এটাই নিয়ম। মার খেয়ে তবু ধুকে ধুকে টিকে থাকেন মানুষ। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে, খেতে না পেয়ে, গাড়ির নিচে পড়ে, কংক্রিটে চাপা পড়ে, পানিতে ডুবে, মহামারি সয়ে টিকে থাকেন সাধারণ মানুষ। কেননা সাধারণের জীবনীশক্তি ‘অসাধারণ’। তাই সাধারণ মানুষ মারা না যাওয়া পর্যন্ত সামান্য প্রতিবাদও হয় না।
সাধারণের মধ্যেও সাধারণ যাঁরা, ধরা যাক সেই কৃষকের কথা। সারের দাম বাড়ে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ে, বীজের দাম বাড়ে, সেই তুলনায় ধানের দাম বাড়ে না। অন্যদিকে আবার চালের দাম বাড়ে। কী জাদুমন্ত্রবলে তাহলে কৃষকের কম দামের ধান ক্রেতার কাছে খোলস ছাড়িয়ে চাল হয়ে যেতে যেতে নিজের এতটা দাম বাড়িয়ে ফেলে? কারা করেন চাল নিয়ে এই চালিয়াতি? এক সাধারণ (কৃষক) বঞ্চিত হন ন্যায্যমূল্য থেকে, আরেক সাধারণ (ক্রেতা) কেনেন অযৌক্তিক মূল্যে। মাঝের ‘অসাধারণ’ ব্যবসায়ীরা উভয় পক্ষের টাকা পকেটে পোরেন।
ব্যবসায়ীরা মৌসুমে চাল কিনে মজুত রেখে সারা বছর ভোক্তার কাছে বিক্রি করেন। চাহিদা আর জোগানের পাল্লাটা ঠিক থাকে এভাবেই। ব্যবসা শুধু টাকা বানানোর বিষয় নয়, এটা সেবাও। কিন্তু সেবাটা এখন আর মুখ্য নয়, ব্যবসায়ীরা একচেটিয়া সিন্ডিকেট বানিয়ে নিজেদের লাভ বাড়িয়ে নিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। লাভের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁদের লোভও।
সেপ্টেম্বরের ২ তারিখে খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, চালের বাজারে সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব নয়। খোদ সরকারের পক্ষ থেকে যদি এমন কথা বলা হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের আশার জায়গাটা কোথায় থাকে? ব্যবসায়ীরা মুনাফা করবেন, এটাই রীতি। কিন্তু সেটা হতে হবে যৌক্তিক। সেটা এত বেশি হবে না যে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাবে। এ জায়গাটা সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ—দুটোই করবে সরকার। সাধারণ মানুষের পক্ষে ভূমিকা পালন করাই সরকারের কাজ। সরকার দেখবে, ব্যবসায়ীরা যেন লাগামছাড়া মুনাফা না করতে পারেন, বাজার যেন অস্থিতিশীল করতে না পারেন। না হলে সরকারের উপযোগিতা কী?
খাদ্যমন্ত্রী কত অনায়াসে স্বীকার করলেন, ব্যবসায়ীরা সরকারের চেয়ে শক্তিশালী এখন। সরকার না পারছে কৃষককে ন্যায্যমূল্য দিতে, না পারছে সাধারণ মানুষকে ন্যায্যমূল্যে খাবার খাওয়াতে। অথবা জনগণের স্বার্থ দেখা যাঁদের কাজ, তাঁরা ব্যবসায়ীদের স্বার্থ সংরক্ষণে ব্যস্ত আছেন। উল্টোমুখী চর্চায় এমনই হওয়ার কথা।
সাধারণ মানুষ যে এখন ‘অসাধারণ’ ভোগান্তিতে আছেন, তা স্বীকার না করে বারবার আমাদের উন্নয়নের চকচকে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড আর সুবিশাল স্তম্ভ দেখানো হয়। কিন্তু তাতে কি সাধারণের দুর্দশা কমে? উন্নয়নের জোয়ার কি রূপগঞ্জের হালিমা-স্বপনের বুকের মানিকের বিক্রি আটকাতে পারে?
সাধারণ মানুষ যে এখন ‘অসাধারণ’ ভোগান্তিতে আছেন, তা স্বীকার না করে বারবার আমাদের উন্নয়নের চকচকে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ড আর সুবিশাল স্তম্ভ দেখানো হয়। কিন্তু তাতে কি সাধারণের দুর্দশা কমে? উন্নয়নের জোয়ার কি রূপগঞ্জের হালিমা-স্বপনের বুকের মানিকের বিক্রি আটকাতে পারে? তাঁদের সাত রাজার ধন দুর্মূল্যের বাজারে বিকিয়েছেন মাত্র ৩০ হাজার টাকায়। প্রসবব্যথা উঠলেও পরিবহনভাড়ার টাকার অভাবে সরকারি হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়া যায়নি হালিমাকে। নোংরা মেঝেতে কারও সাহায্য ছাড়া ভূমিষ্ঠ হয় তাঁর সন্তান। সরকারি হাসপাতালে যাওয়ার ভাড়া পর্যন্ত যাঁরা দিতে পারছেন না, তাঁদের তো সন্তান বিক্রি করারই কথা।
সাধারণের মধ্যে আরও সাধারণ থাকেন এমন, যাঁরা এক মণ ধান বেচেও এক কেজি গরুর মাংস কিনতে পারেন না। কেননা জনশুমারিতে মাথা গোনা ছাড়া আর কোনো গণনায় তাঁরা নেই। হিসাবের বাইরের এই মানুষেরা উন্নয়ন আর ক্ষমতার রাজনীতিতে তাঁরা শুধু সংখ্যার হিসাব হয়ে টিকে আছেন। তাঁরা জানেন, হাতভর্তি খেলনা নিয়ে খেলবে না তাঁদের সন্তান, শূন্য থালার প্রান্তে বসে উদরভর্তি ক্ষুধা নিয়ে কেঁদেকেটে নোংরা মেঝেতে ঘুমিয়ে পড়াই তাদের নিয়তি।
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
Mehedirasel32@gmail.com