মতামত

ফ্যাসিবাদী শাসকের পতন হলেও ফ্যাসিবাদ যেভাবে থেকে যায়

ফ্যাসিবাদ কী? আমাদের সমাজে কি ফ্যাসিবাদ রয়েছে? বাংলাদেশের সমাজে ফ্যাসিবাদ কি ভবিষ্যতের গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে? কেমন করে ফ্যাসিবাদকে প্রতিরোধ করা যায়? এই প্রশ্নগুলোকে সামনে রেখে ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তার উপস্থিতি নিয়ে আলোচনা খুব জরুরি।

সহজ করে লেখা যায়, ফ্যাসিবাদ হলো একটি চরম দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক আদর্শ। একজন ফ্যাসিস্ট বা ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাস করেন। নিজেকে ‘জাতীয়তাবাদী’ দাবি করেন। একনায়কতন্ত্রের প্রতি সমর্থন দেন। তিনি সামরিক শক্তির প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করেন।

একটা ফ্যাসিবাদী-ব্যবস্থায় সাধারণত একনায়ক বা একক দলের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ফ্যাসিস্ট সরকার দেশে বিক্ষোভ দমন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার অধিকার দমন করার জন্য সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদের মূল লক্ষ্য হলো একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখা হয়। এখানে রাষ্ট্রের স্বার্থ মানেই কিন্তু জনগণের স্বার্থ নয়। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় রাষ্ট্রের স্বার্থ বলতে ক্ষমতায় থাকা একনায়ক ও তাঁর সমর্থক দলের সুবিধাভোগী অংশের স্বার্থকে বোঝানো হয়।

ফ্যাসিবাদের উত্থান ও বৈশ্বিক রূপ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটে। এ ক্ষেত্রে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি ও তাঁর ফ্যাসিস্ট পার্টির ইতিহাস ফ্যাসিবাদের আলোচনায় সবার আগে চলে আসে। ১৯২০ সালে মুসোলিনি ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়কে আধুনিক ফ্যাসিবাদের সূচনাকাল হিসেবে ধরা হয়। যুদ্ধ-পরবর্তী ইতালির সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে মুসোলিনি জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করেন ও তার ফ্যাসিস্ট আদর্শ প্রচার করেন। ১৯২২ সালে মুসোলিনি নিজেকে একনায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।

ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ দেখা যায় জার্মানিতে। ১৯৩৩ সালে জার্মানিতে অ্যাডলফ হিটলার ক্ষমতায় আসেন। হিটলারের নাৎসি পার্টি ফ্যাসিস্ট নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে থাকে। হিটলারের ফ্যাসিবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ইহুদিবিদ্বেষ।

হিটলার সমাজে চরম জাতিগত ঘৃণা প্রচার করে ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পাঠিয়ে হত্যা করতে থাকে। আমরা পরে দেখতে পাই, হিটলার ও মুসোলিনির চরমপন্থী আদর্শ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্ম দেয়। ফ্যাসিবাদের শিকড় শুধু ইতালি এবং জার্মানিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কো এবং আরও কিছু ইউরোপীয় এবং দক্ষিণ আমেরিকান দেশে ফ্যাসিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠা পায়।

রবার্ট ও. প্যাক্সটনের লেখা দ্য অ্যানাটমি অব ফ্যাসিজম বইটি ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে একটি সহায়ক বই। প্যাক্সটন ফ্যাসিবাদের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণের সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন। ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা নির্ধারণ সহজ নয়। কারণ এটি বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রূপ নিয়েছে। তবে ইতালি, জার্মানি ও স্পেন প্রভৃতি দেশের উদাহরণ থেকে আমরা ফ্যাসিবাদ বোঝার জন্য কিছু মূল উপাদান পাই। সেই মূল উপাদানগুলো নিয়ে প্যাক্সটন বলেন, ফ্যাসিস্ট আন্দোলনগুলোর মধ্যে সাধারণভাবে চরম জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের বিরোধিতা এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সহিংসতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিবাদ গণমানুষের সমর্থনের ওপর ভিত্তি করে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাস্তবে ফ্যাসিবাদ জনসমর্থন নিয়ে একটি চরম জাতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এর অর্থ হলো ফ্যাসিবাদ জনসমর্থন ছাড়া গড়ে উঠতে পারে না। আপনি যদি মনে করেন, ফ্যাসিবাদ জনগণের সমর্থন ছাড়া গড়ে উঠতে পারে, তবে তা সঠিক নয়। আসুন দেখি, কেমন করে জনগণের মধ্যে ফ্যাসিবাদ লক্ষণ থাকতে পারে।

যে দেশে বা সমাজে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে জনগণের বড় অংশের মধ্যে ফ্যাসিবাদপন্থী মতামত বর্তমান থাকে। হতে পারে সেই দেশের জনগণ কর্তৃত্ববাদে বিশ্বাস করেন এবং এর পক্ষে সমর্থন উৎপাদন করেন। অথবা জনগণ নিজেদের জাতীয়তাবাদী দাবি করেন ও অন্য জাতির প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেন।

রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন দেন অথবা সামরিক শক্তির প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখান এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করেন। অথবা জনগণের একটি বড় অংশ অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করেন এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈরিতা ছড়ান ও বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। অথবা জনগণের একটি বড় অংশ সমাজে নারীর ভূমিকা সীমিত করে দিতে চান এবং তাদের প্রধানত মাতৃত্ব ও পরিবার দেখাশোনার দায়িত্বে রাখতে চান।

সমাজে ফ্যাসিবাদের লক্ষণ

এবার একটি প্রশ্ন করি—আমরা আমাদের সমাজে কি এই লক্ষণগুলো দেখতে পাই?  একজন সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কাজ করতে গিয়ে আমি আমার আশপাশে এই লক্ষণগুলো দেখেছি। যেমন আমাদের সমাজে চরম জাতীয়তাবাদ রয়েছে এবং অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা পোষণ করার এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈরিতা ছড়ানোর ও বৈষম্যমূলক আচরণ সমর্থন করার মতো মানুষের অভাব নেই।

আমাদের সমাজে জনগণের একটি বড় অংশ সমাজে নারীর ভূমিকা সীমিত করে দিতে চায়। আমাদের সমাজে অন্যের মতাদর্শ বা মতকে মেনে না নেওয়ার প্রবণতা আছে। আমি যা ভাবি, যা মনে করি, যা বলি সেটিই একমাত্র ঠিক—এমন চিন্তাই এখানে প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের সমাজে ক্ষমতাকে পূজা করা হয়। বৈধ-অবৈধভাবে ক্ষমতাচর্চাকে মানুষের মাঝে বা সমাজে বা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়।

আমাদের সমাজে অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন দেন, মনে করেন শাসকের কোনো বিকল্প নেই। অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা সামরিক শক্তির প্রতি অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখান। আশপাশে যদি আমরা ভালো করে দেখি, তবে দেখব, আমাদের সমাজে আমরা অনেকেই ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন করি।

আমরা দেখতে পাই, আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এই সুযোগকে কাজে লাগায় এবং আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করে। এ ক্ষেত্রে সব থেকে সফল হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিল। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অন্য কোনো দলকে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি। আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদের মূল ভিত্তি ছিল উগ্র জাতীয়তাবাদ, কর্তৃত্ববাদ (শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত সরকার), রাজনৈতিক বিরোধিতা দমন এবং অন্য জাতি বা গোষ্ঠীর প্রতি শত্রুতা।

শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে ব্যবহার করেন। নিজেকে তাঁর বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার হিসেবে উপস্থাপন করেন; যা তাঁর জনপ্রিয়তার অন্যতম হাতিয়ার ছিল। পাশাপাশি তিনি গণমাধ্যমকে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ক্ষমতা ও আদর্শ প্রচার করতে এবং জনগণের মনে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা উসকে দিতে। উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে হাসিনা সরকার ১৫ বছর ধরে দেশে এক কর্তৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল। অবশেষে ৫ আগস্ট, বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে, এক গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে। অর্থাৎ তারা জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসে এবং পরে যখন নিজেদের ফ্যাসিস্ট মতবাদ প্রতিষ্ঠা করছিল, তখন জনগণের একটি অংশের সমর্থন লাভ করে। আওয়ামী লীগ তার ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারত না, যদি না জনগণের এক অংশের মধ্যে ফ্যাসিবাদের পক্ষে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন থাকত।

ফ্যাসিবাদ এত সহজে যায় না

তাহলে এই জনগণ কারা? এই জনগণ আমি, আপনি এবং আমরা সবাই। ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় নিয়েছে, ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেছে; কিন্তু জনগণের মধ্যে থেকে কি ফ্যাসিবাদ চলে গেছে? না, যায়নি। ফ্যাসিবাদ এত সহজে যায় না।

ফ্যাসিবাদ যেমন একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তেমনি সমাজ থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূল করতেও দীর্ঘমেয়াদি প্রচেষ্টার প্রয়োজন। আর এ ক্ষেত্রে ফ্যাসিবাদ দূর করার মাধ্যম হলো উদারনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন; যা সবাইকে সম্পৃক্ত করে, মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দেয় এবং সহমর্মিতার, দরদ ও দায়িত্বের কথা বলে।

দীর্ঘ মেয়াদে ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করার উপায় হলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা। ফ্যাসিবাদ তখনই সফল হয়, যখন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে বা ভেঙে যায়। পাশাপাশি বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনীপ্রক্রিয়া ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, শক্তিশালী সংসদীয় ব্যবস্থা এবং সংবিধানগত অধিকারগুলোর সুরক্ষা প্রয়োজন। স্বচ্ছ নির্বাচন এবং জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে, যা ফ্যাসিবাদ বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকা রাখে।

আমরা যদি সত্যিই ফ্যাসিবাদের ফিরে আশা বন্ধ করতে চাই তবে আমাদের কাজ করতে হবে বহুত্ববাদী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের জন্য। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিয়ে জাতি ও ধর্মগত সব সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অধিকারের সুরক্ষা দিতে হবে। সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে সমাজে ঐক্য বজায় রাখা যায়। অন্যথায় বিভক্তির সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদ ফেরত আসে।

কেবলমাত্র বৈষম্যমুক্ত সমাজই পারে ফ্যাসিবাদী আদর্শের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। পাশাপাশি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদী সরকার যে নির্যাতন করেছে, নাগরিকদের হত্যা করেছে, সেই বর্বরতা এবং নির্মমতার ইতিহাস সব স্তরের জনগণকে দেখাতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যায়। শেষ পর্যন্ত সচেতন জনগণই পারে ভবিষ্যতের ফ্যাসিবাদ রুখে দিতে। অন্যথায়, সমাজে ফ্যাসিবাদ থাকলে রাষ্ট্রে বারবার ফ্যাসিবাদ ফিরে আসে।

  • আসিফ বিন আলী বর্তমানে কাজ করছেন আমেরিকার জর্জিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে। তিনি পেশায় শিক্ষক, গবেষক ও স্বাধীন সাংবাদিক।