সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি ঘুরেফিরে আসছে। সেই দাবি জোরালো হচ্ছে। সরকারের সায় না মেলায় এর আগে কয়েক দফায় দাবির বিষয়টি ঝিমিয়ে পড়েছিল। তবে সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৩৫ বছর করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সুপারিশ করেছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। ফলে চাকরিপ্রত্যাশীরা আবারও সেই দাবি জোরালোভাবে তুলেছেন।
এই দাবি এক দশক আগের। প্রথম যাঁরা এই দাবিতে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকের বয়স এখন ৪০ বছর পেরিয়ে গেছে। সুতরাং এখন চাকরির বয়স ৩৫ বছর করা হলেও তাঁরা কোনো সুবিধা পাবেন না। এরপরও সেই আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ দেশের বেকার যুবকদের স্বার্থে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার পক্ষে। তবে সদ্য যাঁরা একাডেমিক পড়ালেখা শেষ করে চাকরির যুদ্ধে নেমেছেন, তাঁদের হাতে বেশ কয়েক বছর সময় আছে। তাই তাঁদের চাওয়া, বয়স বাড়ানো না হোক। কারণ, বয়স বাড়লে প্রতিযোগীর সংখ্যা বাড়বে, চাকরি পাওয়া আরও কঠিন হবে।
চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় স্বচ্ছতার বিষয়ে গত কয়েক বছরে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি বেশ আস্থা অর্জন করেছে। কিন্তু অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নিয়োগপ্রক্রিয়া, পরীক্ষা ও চূড়ান্ত নিয়োগ নিয়ে আছে নানা অভিযোগ। বিশেষ করে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরিতে (১৩ থেকে ২০ গ্রেড) দুর্নীতি, জালিয়াতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ সবচেয়ে বেশি।
গত বছরের ৮ ডিসেম্বর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে প্রথম ধাপের নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে ১২৪ জনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্রতারণা চক্রের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে পরীক্ষার হলে ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষা দেওয়ার অভিযোগে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। অথচ ওই নিয়োগ পরীক্ষা বাতিল বা স্থগিত করা হলো না। বহুল সমালোচিত নিয়োগ পরীক্ষাটির ইতিমধ্যে ভাইভা শেষে প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা চাকরি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
৩০ বছরের মধ্যে চাকরি না পেয়ে কোনো কোনো যুবক উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ হয়তো ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। এসব করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থসংস্থানের জন্য সবার পক্ষে পারিবারিক সামর্থ্য থাকে না। সে জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের প্রয়োজন পড়ে। সেই ঋণ আবার সহজে মেলে না।
চাকরির বয়স বাড়ানো হলে কিংবা চাকরি বয়সসীমা না থাকলে এসব জালিয়াতি চক্র আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মীদের প্রভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের চাকরি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে। তবে নিয়োগপ্রক্রিয়া ও পরীক্ষায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়; বরং অনেক বেকারের কপাল খুলবে। সেই আশায় চাকরিপ্রার্থীরা ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বয়স বাড়ানোর দাবি অব্যাহত রেখেছেন।
চাকরিপ্রার্থীদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে করা শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশে বলা হয়েছে, ৩৩ বছর আগে ১৯৯১ সালে ২৭ বছর থেকে ৩০ বছরে উন্নীত করা হয়, যখন বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫৭ বছর। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭৩ বছর, তাই চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধি করা যৌক্তিক।
সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। অনেক নীতিনির্ধারক বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর কিংবা উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে তুলনা করেন। সেখানে দেশের চাকরির বাজার ৩০ বছর বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা কতটা যৌক্তিক, সে প্রশ্নও তুলেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। অবশ্য কেউ কেউ মনে করেন, উন্নত দেশগুলোর মতো চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা তুলে দেওয়া উচিত। এ নিয়ে কিছুদিন ধরেই ফেসবুক বেশ উত্তপ্ত। তর্ক-বিতর্কও বেশ চলছে।
এ বিষয় নিয়ে ৬ মে কথা বলেছিলাম শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের সঙ্গে। প্রশ্ন করেছিলাম, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা না থাকলে কী সমস্যা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা, সততা ও নিয়োগপ্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা থাকলে চাকরিতে বয়সসীমা না থাকলে কোনো সমস্যা নেই। তবে দেশে বর্তমান বাস্তবতায় যেহেতু এসবের ঘাটতি আছে, সে জন্য চাকরিতে বয়সসীমা থাকা ঠিক আছে।
আবুল কাসেম ফজলুল হক আরও বলেন, কিছুদিন পরপর সরকারি চাকরিতে প্রবেশসীমার বয়স বাড়ানোর দাবি ওঠে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে চাপের মুখে বয়স বাড়ানো ঠিক হবে না। বয়স বাড়াতে হলে জাতীয় সংসদে বিষয়টি উত্থাপন করে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা করতে হবে, সুবিধা-অসুবিধা বিশ্লেষণ করতে হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ, বিশিষ্টজন ও সব পক্ষের আলোচনার ভিত্তিতে ২ থেকে ৩ বছর বয়স বাড়ানো যেতে পারে। তবে একই সঙ্গে চাকরি থেকে অবসরের বয়সসীমাও ৩ কিংবা ৫ বছর থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।
৪ মে প্রথম আলো অনলাইন জরিপে প্রশ্ন করা হয়, ‘চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ বছর করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রীর সুপারিশ আপনি সমর্থন করেন কী?’
এমন প্রশ্নসংবলিত গ্রাফিক কার্ড প্রথম আলোর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সেই পোস্টের নিচে ৩০ হাজারের বেশি মানুষ লাইক ও প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। মন্তব্য পড়েছে ৩০ হাজার ৭০০-এর বেশি। পোস্টটি শেয়ার হয়েছে সাড়ে ছয় শতাধিক। হাতে গোনা কিছুসংখ্যক বাদে বেশির ভাগ মানুষ ‘হ্যাঁ’ সমর্থন করেছেন। এর মাধ্যমে সহজে অনুমান করা যায়, কত বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরির বাজারে বয়সের ফাঁদে আটকা পড়েছেন। সেই সঙ্গে হাহাকার করছেন রুটিরুজি ও জীবিকার সন্ধানে।
৩০ বছরের মধ্যে চাকরি না পেয়ে কোনো কোনো যুবক উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করেন। কেউ হয়তো ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করানোর উদ্যোগ নেন। এসব করতে অর্থের প্রয়োজন হয়। অর্থসংস্থানের জন্য সবার পক্ষে পারিবারিক সামর্থ্য থাকে না। সে জন্য ব্যাংক থেকে ঋণের প্রয়োজন পড়ে। সেই ঋণ আবার সহজে মেলে না। অর্থের যদি কোনোভাবে ব্যবস্থা হয়েও যায়, ট্রেড লাইসেন্স নেওয়ার জন্য ধরনা দিতে হয়। সরকারি কোনো অফিসে কাজের জন্য গেলে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে মেলে অসহযোগিতা ও প্রতিবন্ধকতা।
একপর্যায়ে যুবক বা তরুণীর উপলব্ধি হয়, এখানে টাকা বা ঘুষ ছাড়া কোনো কাজই হয় না। ত্যক্ত-বিরক্ত ও অতিষ্ঠ হয়ে স্বদেশটা তাঁর কাছে বসবাসের অযোগ্য মনে হয়। তাই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিদেশে পাড়ি জমাতে পাসপোর্ট অফিসে গিয়েও নানা ফন্দিফিকিরের শিকার হন। এভাবে নিজের দেশ নিয়ে চূড়ান্ত মাত্রায় হতাশ হন। অসীম হতাশা ও দুঃখবোধ নিয়ে যুবসমাজের একটি শ্রেণি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
উন্নত জীবন ও ক্যারিয়ার গঠনের লক্ষ্যে মানুষ বিদেশে যেতেই পারেন। তাই বলে গভীর দুঃখবোধ ও দেশের প্রতি ধিক্কার নিয়ে যুবকদের দেশ ছেড়ে যাওয়া শুভ লক্ষণ নয়। এই যুবকদের হতাশা কাটানো ও দেশের প্রতি আস্থা ফেরানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বেকার যুবসমাজকে বোঝা নয়, সম্পদে পরিণত করতে পথ খুঁজে বের করতে হবে সরকারকেই।
তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোর সহসম্পাদক
towhidul.islam@prothomalo.com