আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলায় ১৬ বছর ১০ মাসের এক কিশোরকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। ১ আগস্ট জামিনে মুক্ত হয়েছে সে। মামলা থেকে অব্যাহতি পায়নি। সে রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থী। প্রকাশ্যে যে পুলিশের উপর্যুপরি গুলিতে আবু সাঈদ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে নিহত হয়েছে—ওই মামলার প্রাথমিক তথ্যবিরণীতে সেই পুলিশের নামই নেই। থাকবেই–বা কেন? গুলি করেছে পুলিশ, মামলা করেছে পুলিশ, তদন্ত করবে পুলিশ! চরম অসাধু উদ্দেশ্যে এই তথ্যবিরণী কি না, জানা যাবে মামলার পূর্ণ তদন্তে। সেই মামলায় কিশোরকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠেছে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলার বিবরণী যেভাবে সাজানো হয়েছে, যে কেউ পড়লে বিভ্রান্ত হবেন। আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেছেন ১৬ জুলাই ৩টা ৫ মিনিটে। উপাচার্যের বাসভবনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ হয়েছে তার অনেক পরে, বিকেলে। মামলার তথ্যবিরণী পড়লে দুপুর-বিকেলের ঘটনা আলাদা করে বোঝার উপায় নেই। মনে হবে সব ঘটনা একই সময়ে ঘটেছে। মনে হবে গুলির সময়ে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে পড়েছিল।
পুলিশের গুলি করার বিষয়টি যদি সামনে আসেও তখন যেন এটাও প্রতীয়মান হয়—প্রচুর ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ হওয়ার মুহূর্তে গুলি করেছে পুলিশ। অথচ ভিডিও চিত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ গুলি করার মতো ছিল না। উপাচার্যের বাসভবনে তখন কোনো আক্রমণ হয়নি। আবু সাঈদকে অনেক কাছে থেকে গুলি করা হয়েছিল। আবু সাঈদ নিহত হয়েছেন ১৬ জুলাই। সেদিন ওই কিশোর সেখানে ছিল কি না, এসব আর যাচাই করেনি পুলিশ।
গ্রেপ্তার কিশোরের বড় বোন রংপুরের একটি কলেজের স্নাতকের শিক্ষার্থী। ভাইকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়ে ৩১ জুলাই ফেসবুকে আক্ষেপ করে তিনি একটি পোস্ট দেন। তাঁর দেওয়া পোস্টসূত্রে জানা যায়, তাঁর ছোট ভাই কারাগারে আছে। তাঁর পোস্ট ফেসবুকে সাড়া ফেলে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার পর কিশোরের বাবাকে ডেকে পাঠান রংপুরের পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান।
তিনি ৩১ জুলাই আন্তরিকতার সঙ্গে বিষয়টি দেখার প্রতিশ্রুতি দেন এবং ১ আগস্ট তার জামিনের ব্যবস্থা করেন। ধারণা করি, পুলিশ কমিশনার আগে জানলে তিনি আগেই জামিনের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু যে পুলিশ সদস্য তাকে বয়স বাড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্ক দেখিয়ে অপরাধ বিচার না করে কোর্টে চালান করেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে? নাকি এখানেও পুলিশের চোখে পুলিশ নিরপরাধই থাকবে? নাকি এই কিশোরের ১৪ দিন কারাবাস দেওয়া কোনো অপরাধই নয়।
রংপুর জজ আদালতের আইনজীবী রায়হান কবিরের কাছে জানতে পারি, শিশু হওয়ার পরও মাহিমকে পূর্ণবয়স্ক হিসেবে চালান দেওয়া হয়েছিল। পরে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে আবেদন করা হলে জামিন শুনানির বিষয়টি শিশু আদালতে স্থানান্তরিত হয়। ৪ আগস্ট এই মামলার শুনানি ছিল। পুলিশ কমিশনারের চেষ্টায় তারিখ এগিয়ে ১ আগস্ট করা হয়।
সরকারিভাবে কয়েক দিন ধরে বলা হচ্ছে, ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হবে না। এ কথার সত্যতা কোথায়? ফেসবুকে কেউ কেউ লিখেছেন, ‘দিনে নাটক, রাতে আটক।’ তার মানে কি সম্মুখে ছাত্র ধরা নিষেধ আর আড়ালে নির্দেশ দেওয়া আছে? এভাবে তো সরকারের ওপর বিশ্বাস ও আস্থা—দুটোই কমছে।
আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের মামলায় পুলিশ মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে যে তথ্য দিয়েছে, তাতে পুলিশের গুলি করার বিষয়টি স্পষ্টতই এড়িয়ে গেছে। যদি একটি প্রশ্ন করা হয়, আবু সাঈদ কীভাবে মারা গেছে? তাহলে জগৎসুদ্ধ যাঁরা ভিডিও চিত্র দেখেছেন, তাঁরা একযোগে বলবেন পুলিশের গুলিতে। নিরক্ষর, মূক, বধিরও এর উত্তর দিতে পারবেন। এই মামলায় অপরাধী চিহ্নিত করা খুবই সহজ। তারপরও মামলার ফল ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্য মিথ্যা কাহিনি সাজানো হচ্ছে।
অভিযুক্ত কিশোরের বাবা কয়েক দিন ধরে আদালতে, আইনজীবীর চেম্বারে চেম্বারে, জেলগেটে ঘুরেছেন। ছেলেকে একনজর দেখতেও পারেননি। ১ আগস্ট ওই কিশোর জামিনে মুক্ত হয়েছে। আমরা একজন-দুজনের খবর জানতে পারছি। কিন্তু এমন কত যে কিশোর ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছে, তার কি প্রকৃত খবর আছে?
আমার এক শিক্ষার্থী হাতে রাবার বুলেট লেগে আহত হয়েছিল। ওর খবর নিতে ফোন করেছিলাম। সে বলছিল, ‘স্যার আমার হাতে তো আঘাতের চিহ্ন, পুলিশ কি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে?’ আবু সাঈদ যেদিন নিহত হলো, সেদিন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল অর্ধশতাধিক ছাত্র। তাদের মধ্যে অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। সন্ধ্যা হতেই অনেকে ভয়ে ভয়ে পালিয়ে গেছে। খবর নিয়ে জানলাম চিকিৎসারত ছাত্রদের আশঙ্কা, পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করতে পারে, নয়তো ঢাকা মেডিকেলের মতো হামলা হতে পারে। পুলিশের আতঙ্কে হাসপাতালও ছেড়েছে আহত শিক্ষার্থীরা।
রক্ত আর অশ্রুর স্রোতে শোকার্ত জনপদে কিশোরদের বয়স বাড়িয়ে মামলা দিয়ে কোর্টে চালান দেওয়া হচ্ছে, কখনো কখনো রিমান্ড মঞ্জুর করা হচ্ছে, বাড়ি থেকে ধরে আনা হচ্ছে। কোটি কোটি ছাত্র-শিক্ষক-জনতা ভয়াবহ অনিশ্চয়তা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। আবু সাঈদ হত্যা মামলায় ওই কিশোরকে আসামি করার বিষয় নিয়ে আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সবকিছু শুনে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘দেশে তো বিচার নেই। সাঈদের বিচারের জন্য দেশের সবাইকে নেমে আসতে হবে। আমরা সাঈদ হত্যার বিচার চাই।’
যখনই কোনো ছাত্র কিংবা কিশোরকে গ্রেপ্তার করার খবর পান কোনো পিতা-মাতা, নিশ্চয়ই অজান্তে সেখানে নিজের সন্তানের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে। তখন মা–বাবার কাছে সব গ্রেপ্তারকৃত সন্তানের জন্য এ রকম সব মা–বাবার মনের মধ্যে তীব্র ব্যথা অনুভব করেন। একইভাবে যখনই কোনো মৃত্যুর খবর আসে, তখন অগণিত মা–বাবার বুক টনটন করে ব্যথা করে। আমরা আর কত ভয়-শঙ্কা-অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকব?
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক